somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অর্পিতার মৃত্যুর আগে...

২৮ শে জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শ্রাবণের ডায়েরি থেকে
------------------------------
রেললাইন ধরে অর্পিতার সাথে হেঁটেছিলাম সেদিন বহুদূর পর্যন্ত। মৃত্যুর আগে অর্পিতার সাথে আমার শেষ দেখা সেদিনই ছিল।

’এ অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয়!’ একটু অধৈর্য প্রকাশ পেয়েছিল আমার কন্ঠে।

ম্লান হাসি হাসলো অর্পিতা, ’হয়তো...কিংবা হয়তো না। ভাবছি, আমার সঙ্গোপন আমিটার কোন মূল্যই কি তোমার কাছে ধরা দেবে না?’

’কিন্তু মূল্যহীন অপ্রয়োজনীয় আদর্শ জিইয়ে রেখেই বা কি লাভ? এ ক্ষতিকরও বটে।’

’তোমার যুক্তি অনুসারে শেষপর্যন্ত সবই মূল্যহীন। তোমার উপলব্ধিও অর্থহীন। এর থেকে এ আর বেশি কি অর্থহীন?’

’সত্যকে মেনে নেবার ক্ষমতা যাদের নেই তারা চিরকাল নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজে থাকে কিংবা ভান করে...আমি পারছি না- হয়তো সে আমারই ব্যর্থতা।’

’সত্যকে তুমি যে দৃষ্টিকোন থেকে দেখছো তাকে ভিন্ন কোন মহৎ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে তার সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপও আবিষ্কার করা যেতে পারে...যাকে চোখ খোলা রাখা বলে ভ্রম করছো সেটা হয়তো চোখ বুঁজে থাকা প্রকৃতপক্ষে।’

’মহীয়সীর মহান দর্শন আমার কাছে আজো বিভ্রান্তিকর...’

বিকেলের আলো প্রায় নিভে এসেছে। বসন্ত-বাতাসের প্রাবল্য অনেকটাই কমে এসেছে চৈত্রসায়াহ্ণে। অর্পিতার মুখে একটি অপার্থিব প্রশান্তি নেমে এল যেন,

’দেখো, আমি এ বলবো না তোমার দেখাটা পুরোপুরি ভুল, কিংবা তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস কর না সে নিয়ে আমি অধৈর্য...একটি তত্ত্বের সাথে আরেকটি তত্ত্বের বিরোধ থাকবেই, সংঘর্ষে কোনটি টিকে থাকবে, কোনটি লুপ্ত হয়ে যাবে, মিশ্রিত হয়ে সংশ্লেষিত তত্ত্বে বেঁচে থাকবে...কিংবা জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকবে বহুকাল। কিন্তু এই যে জগতের এই সৌন্দর্যকে একটি চেতনস্রোত দেখছে, নিজের মাঝে প্রতিবিম্বিত করছে, জগতের শৃঙ্খলাটিকে বুঝতে চেষ্টা করছে- এ আমার কাছে খুবই বিস্ময়কর মনে হয়; হতে পারে এ হয়তো এক নিছক দুর্ঘটনা, কিন্তু তার ভিন্ন কোন তাৎপর্য নেই- এ বলে আমি কোন কিছু হেসে উড়িয়ে দিতে পারি না। আবার জন্মলগ্ন থেকে মানুষ হতাশার জগতে বিস্মরণের যে বলয় তৈরি করেছে তার অলীক আশাবাদে অন্ধ ডুবে থাকবো- সেও আমাকে দিয়ে হবে না। প্রতিদিনকার কাজে, অন্তরের ধ্যানে, এই পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্যের উপলব্ধির মাঝেই আমার ঈশ্বরের মাঝে নির্বাণ লাভের প্রক্রিয়া। আর সেই পথে জগতের সবকিছু, হোক সে তুচ্ছ- সবই মূল্যবান আমার কাছে। জগতের সমস্ত অনুভূতি, সমস্ত আলো, শব্দ এমনকি বস্তু- সবই আমার কাছে তাৎপর্যময়; কারণ এইভাবে আমি উপলব্ধি করি রূপ আর অরূপের মাঝ দিয়ে ঈশ্বর তাঁর ব্যাখ্যাতীত স্বরূপের দিকে আহবান জানাচ্ছেন একই সাথে গোপন এবং উচ্চকিত স্বরে। এর চেয়ে অদ্ভূত অলৌকিক আর কী হতে পারে!’

’হুমম! কিন্তু এই উপলব্ধির সমস্ত প্রক্রিয়াতো শুধুমাত্র তোমার চেতনেই। কিভাবে নিশ্চিত হতে পারবো যে এর কিছুটা হলে ব্যক্তিনিরপেক্ষ গ্রহনযোগ্যতা আছে? একা মানুষের মস্তিষ্ক নিরর্থক কত কিছুই ভাবে! আমার মনতো এভাবে দেখে না...’

’আমার হতাশাটা এইখানেই’, ম্লান হয়ে এলো অর্পিতার স্বর, ’...তুমি যদি কিছুটা হলেও দিতে...নচেৎ সার্থকতাটা সম্পূর্ণ হচ্ছে না ওর; কারণ তীর্থক্ষেত্রে পৌঁছানোর পথে তোমাকে ছাড়া আমি বড্ড অসহায়।’, গলার হারটা আঙ্গুল দিয়ে পেঁচাতে লাগলো অর্পিতা। বলল, ’এই হারটা আমার মায়ের। মা মারা গিয়েছিলেন আমার জন্মের কয়েক বছর পর। কিন্তু আজও এটার মাধ্যমে তার সাথে আমার যোগাযোগ অটুট আছে। তোমার কাছে যা এক ধরনের মানবীয় ভাবালুতা কিংবা...,’ বিষাদের হাসি দিল অর্পিতা, ’...মস্তিষ্কের রাসায়নিক আলোড়ন বৈ ভিন্ন কিছুই নয়।’

আমি একটু বিপন্ন বোধ করলাম, ’আসলে প্রত্যেকটা ব্যক্তির কাছে তার প্রাপ্ত সূত্রাবলী অনুযায়ী জগতটা ব্যাখ্যাযোগ্য হয়ে উঠে। এজন্যই মানবিক সমস্ত আবেগ-অনুভূতিকেও একদিন ’থিওরি অব এবরিথিং’-এ ফেলে ব্যাখ্যা করার স্বপ্নে অনেক বিজ্ঞানী বিভোর...’, আমার অধৈর্য ধীরে ধীরে কমে আসছিল, ’হয়তো ভুল করেছি এতদিন ধরে। তোমার যে বিষয় তার গভীরে গিয়ে যে মহান সত্য তুমি পেলে আমার কাছে তা তোমার মতন করে কিভাবে ধরা দেবে? আমি প্রকৌশলবিজ্ঞানের ছাত্র, হয়তো সমস্ত কিছুকে ব্যাখ্যাযোগ্য রসকষহীন সূত্রের মাঝে দেখতে দেখতে জীবনের গূঢ় অর্থবহ সূত্রগুলো তোমার মতন আমার সামনে ধরা দেয়নি। কিন্তু আমি যে অসহায়। তুমিতো আমাকে চেন। তোমার কাছে আজ যে সত্য ধ্রুব হয়ে ধরা দিয়েছে সেটি ধরতে পারার কপটতা আমার দ্বারা যে কখনোই হবে না।’

’আমি জানি...সে দ্বন্ধ চিরন্তন।,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্পিতা। ’আচ্ছা শ্রাবণ, যদি হঠাৎ কখনো মারা যাই আমি...।’, অর্পিতা হাঁটার গতি কমিয়ে দিল, ’মানে আমার মৃত্যুর পর তুমি কি করবে? তোমার ঈশ্বরবিহীন তত্ত্ব তোমাকে কি বলে?’

থমকে দাঁড়ালাম হঠাৎ, ’এ কথা কেন হঠাৎ?'

'যেহেতু তুমি কার্যকারণ সূত্রের পূজারী; যেহেতু তোমার ফিলোসফি অনুযায়ী...।’

'এভাবে কখনো ভাবিনি।', দ্রুত অর্পিতাকে থামালাম আমি, ’আক্রমণ করতে চাইছো বেশ।’, ইতস্তত: করছি আমি, ’হার মানলাম।’

’অথচ বিস্মরণ-বলয়ে যারা ঘুমাচ্ছে তাদের ব্যঙ্গ করছিলে কিছুক্ষণ আগেও। তাহলে কি মৃত প্রেমিকার জন্য আমরণ এক নিরর্থক ভাবালুতা নিয়ে বসবাস করে যাবে? যদিও তুমি জানো মৃত্যুর পর আর দ্বিতীয়বার তাকে পাবে না?’, বিদ্রুপাত্নক স্বর অর্পিতার, ’এটাতো অবসেশন, তাই না! একধরনের অসুস্থতা?’

আজ এতদিন পর লিখতে বসে ভাবছি, সেদিন কি আমি সূক্ষ্ণ একটু আঘাত পেয়েছিলাম অহমে? হয়তো না। হয়তো হ্যাঁ। এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। বুঝিনি ওই বিদ্রুপের মাঝেই প্রচ্ছন্ন ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। ধীরে ধীরে বললাম, ’এমন কি হতে পারে না যে শেষকালে ফ্রয়েডই হাসবেন? অবচেতনে তুমিও হয়তো জানো সত্য কি। প্লেটোনিক লাভাররা নিশ্চয় কবির সান্ত্বনা। হয়তো কপটতা তোমারই...’

সূর্য ডুবে গিয়েছে তখন। প্রায়ান্ধকার আকাশে পাখিরা শঙ্কিত রব তুলে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত আলো নিভে যাচ্ছে- এই হয়তো ওদের নিকট এক অমোঘ সত্য; অস্তাচলে পরাস্ত সূর্যের পতন হয়তো ওদের নিকট আসন্ন ভয়াবহ কিছুর প্রতীক, এর চেয়ে বেশি সত্য কিছু নয়। অর্পিতার যে কী হল ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি ওর হাত ধরলাম। হঠাৎ বুঝতে পেরে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। অর্পিতা কাঁদছে।

’আমি দু:খিত। সত্যিই...’ বিব্রতবোধ করলাম, ’এভাবে বলা উচিৎ হয়নি আমার...।’

অর্পিতা কথা বললো না। জলের স্রোত মনে হল আরো ফুলে-ফেঁপে উঠছে। আমি ওর চোখে-মুখে হাত বুলিয়ে পরশ নিলাম। আসলেই কপটতা কার? একদিন কি তবে আমি পরাজিত হবো ওর মৃত্যুর পর? কারণ ঈশ্বরবিহীন পৃথিবীতে কেন আমি অপেক্ষা করে যাবো আজীবন? কিন্তু...

কৃষ্ণবিবরে পদার্থবিদ্যার সমস্ত সূত্র ভেঙ্গে পড়ে- কে জানে সে কি তত্ত্বগত কল্পনার চূড়ান্ত রূপ ধরে শুধুই ভ্রম কি না। তেমনি ভাবি, মানব-মানবীর প্রেম...তার রহস্যের কি আদি-অন্ত আছে? সমস্ত জাগতিক যুক্তি-তর্ক অচল হয়ে পড়ে। সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত রেললাইন, দূরে বহুদূরে মিলেছে বলে ভ্রম হয়...যদিও আমার সূত্র বলছে, ওটা অসীমে...কিন্তু মানুষকেতো আজো গাণিতিক সূত্রে ফেলা সম্ভব হয় নি। আমি অর্পিতাকে জড়িয়ে ধরে বুঝতে চাইলাম তার রহস্যের গভীরতা।

এই রেললাইনের দু’পাশে কতদিন হাত ধরাধরি আমরা দুইজন হেঁটেছি, কিন্তু কখনো এতটা নিবিড়ভাবে নিজেদের কাছাকাছি এসেছি বলে মনে হয় না। আমি অর্পিতার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতে চাইলাম। না, অর্পিতা। জগতের সমস্ত তত্ত্ব মিথ্যে হোক; আমি-তুমিই আমাদের অনুভবে আজ একমাত্র সত্য ।

’নক্ষত্রেরা বাতি জ্বেলে জ্বেলে নিভে গেলে’...গেলে হয়তো একসময় শীতল হয়ে আসবে মহাবিশ্ব, কবির দর্প আমার বস্তময় চেতনায় আসে না; কিন্তু আমার চেতনে যে সত্য হয়ে তুমি নাক্ষত্রিক প্রভা ছড়ালে তা যুগ-যুগান্তরে, ঈশ্বর থাকুক বা নাই থাকুক, অমর অক্ষয় হয়ে থাকবে। মহাকাল তোমার-আমার কোন মূল্য না দিক; তবুও অর্থহীনতাকে অর্থময় করে তোলার নিরন্তর সাধনার মাঝেই মানুষের টিকে থাকা। তাই মানুষ ভালোবাসে। তাই সে চন্দ্রাহত হয়, তাইতো নাক্ষত্রিক আলোয় পাল তুলে তার তীর্থযাত্রা।

পরবর্তী পর্বে সমাপ্ত : অর্পিতার মৃত্যুর পরে...


সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×