"গোরা।" এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের "ভাব"-এর রসাধিক্য স্বভাবতই একবিংশ শতকের আপনার "আধুনিক" মনে প্রচন্ড বিরক্তির উৎপাদন করতে পারে, তবে তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতা এবং রবিবাবুর মানসচেতনা মনে রেখে পড়া গেলে বইটা উপভোগ্য।
রবীন্দ্রনাথের wit অসাধারন- এ স্বীকার করতেই হবে। আর ঊনিশ-শতকের মধ্যবিত্ত হিন্দু-সমাজচেতনায় বাইরের ঘাত-প্রতিঘাত এসে যে আলোড়ন তুলছিল তা গোরায় দুর্দান্তভাবে উঠে এসেছে। সুচরিতার সাথে একজায়গায় রবিবাবুর আরেক মাস্টারপিস "শেষের কবিতা"-র নায়িকা লাবণ্যের মিল পাওয়া যায়; গোরার কথায়-বাক্যে উদ্দীপ্ত সুচরিতার মনে এই ভয়টিও কাজ করে যে সে গোরার যোগ্য কি না!
হয়তো তার দৈন্যতা একদিন গোরার নিকট নগ্নভাবে ধরা পড়বে- এই ভয় ঠিক অমিতের নিকট লাবণ্যের নিজের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয়ের মতনই।
(লাবণ্যের জবানিতে ব্যাপারটা হল- অমিত শুধুই কথার জালে নিজকে ভুলিয়ে রাখে, কিন্তু এমন একদিন হয়তো আসবে যখন অমিতের কথা ফুরিয়ে আসবে; সেক্ষণে দু'জনের মাঝখানে বিরাজ-করা নৈ:শব্দের মাঝ দিয়ে প্রকাশ পাবে লাবণ্য কতটা নি:স্ব আর রিক্ত)।
তবে "গোরা" উপন্যাসের শেষদিকে যখন গোরা জানতে পারে সে আইরিশ-ম্যানের ছেলে তখন তার মতাদর্শ ভোজবাজির মতন পাল্টে যায় ঠিক অমিতের মতনই যখন সে জানতে পারে লাবণ্য তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে শারীরি পৃথিবীতে। কিন্তু তারপরও সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, খৃষ্ট-চেতনায় প্রাচ্যকে হেয় করার মানসিকতাবিরোধী গোরার মতাদর্শ এবং ভারতবর্ষের যা কিছু তার অগৌরব, যা কিছু তার সংস্কার সেগুলিকেই আপন করে নিয়ে সে থেকে প্রাচ্যের পথেই উত্তরণের প্রচেষ্টা...পশ্চিমকে অন্ধ অনুকরণ নয়। আমাদের লড়াই আমাদেরকেই করতে হবে, পশ্চিমের তথাকথিত আধুনিকতা নকল করে আমরা "আধুনিক" হতে পারবো না প্রকৃতরূপে। তবে বুদ্ধিমান পাঠকমাত্রই অনুমান করে নেবেন যে, গোরার এই বৈপ্লবিক ইউনিক চিন্তায় বিবর্তন এনে কবিগুরু শেষপর্যায়ে তাঁর চিরাচরিত স্বভাবজাত বৈশ্বিক চিন্তায় উপনীত হবেন যেখানে তা 'কিছুটা হলেও' প্রকারান্তরে পশ্চিমের অনুকরণই...। এগুলো আসলে সবই দার্শনিক সঙ্কট।
ব্যক্তির চাহিদা যদি সমাজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয় তবে সেই ব্যক্তি সমাজ নয়, নিজ বিবেকের দ্বারা বিচার করবে তার নিজস্ব ভালো-মন্দ। কিন্তু সমস্যা হল, ব্যক্তির একক 'চিন্তা'-র সঠিকতাই বা কিভাবে যাচাই করবো আমরা যেখানে ভালো-মন্দের কোন পরম মানদন্ড নেই?
আজ হয়তো আমি রামমোহনবাবুর নামটি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বরণ করি, কিন্তু চিন্তা করুনতো তাঁর নিজস্ব সমাজ-বাস্তবতার কথা যখন তাঁকে স্বকীর্তির জন্য দুয়োধ্বনি শুনতে হয়েছিল? রামমোহনবাবু স্বচেষ্টায় আজ প্রতিষ্ঠিত বিধায় তাঁর সমাজ-বাস্তবতা অসঙ্গতিপূর্ণ বলে প্রতিভাত হচ্ছে "আমার" বর্তমান চিন্তায়, লক্ষ্য রাখতে হবে এখানে নীতি-নৈতিকতার মতন বিমূর্ত জিনিসের আদৌ স্থান নেই। ঠিক তেমনি আজকের আমাদের সমাজ-বাস্তবতার সাথে দৃশ্যমান কোন অসঙ্গতিপূর্ণ কর্মকান্ড (যেমন ধরুন: সেম সেক্স ম্যারিজ) যদি কোন এক বা একাধিক সংখ্যালঘু ব্যক্তির নিকট গ্রহনীয় হয় তখন আমাদের করণীয় কি?
এ স্থলে পরেশের জবানিতে কবিগুরু সঙ্কটটির সঠিক সমাধানটি দিয়েছেন। পরেশের মতে, সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের (বিনয় ও ললিতা) প্রতিকূল সমাজ-বাস্তবতায় নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, কারণ 'বাহির' তাকে সর্বদাই যন্ত্রণা দেবে, পেছনে ঠেলবে; সুতরাং সমাজের ঠেলা অতিক্রম করে নিজকে সাধারণের চেয়ে উপরে উঠতে হবে। না হলে, সাধারনের ভিড়েই 'নিকৃষ্ট' নাম নিয়ে হারিয়ে যেতে হবে।
তবে ভালো হত, যদি উপন্যাসের প্রথমে গোরা খৃষ্টান এই তথ্যটুকু সরাসরি না জানিয়ে দেওয়া হত, প্রয়োজনে পাঠকের আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য কিছু পরোক্ষ ঈঙ্গিত দেওয়া যেত। গোরার আসল পরিচয় প্রথম দিকে পাঠক না জানলে উপন্যাসটা আরো জমতো।
গোরা সম্ভবত রবিবাবুর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২০ রাত ১২:৩৬