ব্লগার চাঁদগাজীর প্রশ্ন যে, ফেরাউন বাংলার মানুষের শত্রু কিভাবে হয়ে গেলো...- পোস্টটা পড়ে মনে হলো ঘটনাটা উল্টো দিকে ঘোরা সম্ভব। আমি আশাবাদী। কেন তাই এইবার খোলাসা করি। তার আগে বলে নেই, দুষ্ট ফেরাউনের হাত থেকে ইহুদিদের বা আল্লাহর অনুসারীদের সাগর দু'ভাগ করে উদ্ধারের কাহিনীতে বিশ্বাসী ঈমানদার বান্দাদের সাথে খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কিত তর্কে লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
মুসার একেশ্বরবাদী ধর্মের সাথে "ফেরাউন" আখেনাতেনের সংস্কারধর্মী ধর্মের প্রচুর সাদৃশ্য আছে। আখেনাতেন মিশরীয়দের প্রচলিত সকল দেব-দেবতার বাতিল করে, এক ঈশ্বরের উপাসনা চালু করেছিলো। এক্ষেত্রে, বলা চলে- আখেনাতেন ইজিপ্টে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলো। ওদিকে খৎনা করার প্রথা আখেনাতেন-প্রবর্তিত নয়, এইটা মিশরীয়দের নিজস্ব রীতি। এইটাও ইহুদিরা গ্রহণ করেছিলো। সুতরাং সব মিলিয়ে বলা যায়, ইহুদি ধর্মের শেকড় মিশর থেকে আসা বিচিত্র নয়।
নবী মুসা মানেই আমাদের ঘেঁটে দেখতে হবে তোরাহ (মুসলিমদের ভাইদের কাছে যেটা তাওরাত নামে পরিচিত), খ্রীস্টীয় ধর্মতত্ত্ব থেকে যেটা ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম পাঁচটা পবিত্র বই। তোরাহ্ -এর প্রথম বই জেনেসিস এর পরের বই এক্সোডাস থেকে আমরা মুসার গল্প শুনি। এক্সোডাসের বর্ণনা যদিও আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাথে খাপ খায় না। এজন্য প্রত্নতাত্ত্বিক, ইজিপ্টোলজিস্ট প্রফেসর রেডফোর্ড মোজেসকে উড়িয়ে দিয়েছেন; উনার মতে, ইজিপ্ট থেকে হিক্সসদের বিতাড়নের ঘটনাই এক্সোডাসে উঠে এসেছে। তারপরও ওল্ড টেস্টামেন্ট ইহুদি জাতির বিকাশের ইতিহাস; সেই ইতিহাসের ওপর ভরসা রেখে ইহুদি ধর্মের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, পরিণতি- এসব নিয়ে আলোচনা সামনে এগিয়ে নেওয়া যায়। ফ্রয়েড তাই টেক্সট-বেইজড্ ইতিহাসের ওপর ভরসা রেখে এক দু:সাহসী বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর মতে, আখেনাতেনের নিযুক্ত কোন এক উচ্চপদস্ত সেনাপতি হওয়া বিচিত্র নয় মুসার পক্ষে...আখেনাতেন তার সংস্কারধর্মী লড়াইয়ে মিশরীয় প্রাচীন পুরোহিতদের কাছে হেরে গিয়েছেন, কিন্তু মোজেস আখেনাতেনের লড়াইকে এগিয়ে নিয়েছেন দেশত্যাগ করে নিজের কিছু অনুসারী যোগাড় করে। সাম্প্রতিক কালের ইজিপটোলজিস্ট আহমেদ ওসমান সমস্ত ধাঁধাঁর সমাধান করেছে আরো দু:সাহসী মন্তব্য করে- আখেনাতেন আর মুসা একই ব্যক্তি। নিজ দেশে টিকতে না পেরে আখেনাতেন নিজের কিছু অনুসারী নিয়ে কানানে চলে যান, পরে মোজেস/মুসা নাম ধারণ করেন।
কী আশ্চর্য! ইতিহাস খুঁড়ে দেখতে পাচ্ছি, ফেরাউন আমাদের শত্রু-- এই ধারণা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
মেইনস্ট্রিম ইজিপটোলজি কিংবা ইতিহাসে ফ্রয়েড এবং ওসমান- কেউই পুরোপুরি গ্রহণযোগ্যতা পাননি; তবে চিন্তার ইতিহাসে নতুন খোরাক যুগিয়েছেন তাঁরা।
দেখা যাক- সামনে কি হয়।
আমরা জানি যে, আখেনাতেনের আমলে বহির্বিশ্বে (মিশরসহ) একেশ্বরবাদের প্রবর্তন ছিল না, ফলে আখেনাতেনের উদ্যোগ অবশ্যই উগ্র ছিল। এটা ঠিক, মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আখেনাতেনকে অনেক সহনশীল দেখা গেলেও তিয়ের মৃত্যুর পর পরই বেপরোয়া হয়ে উঠেন ফারাও। এমনও হতে পারে থেবিয়ান পুরোহিতরা হয়তো বিদ্রোহ করেছিল এ সময় বা ভিন্ন কোন উপায়ে রাজাকে বাধ্য করেছিলো সরাসরি ময়দানে নামার ।
কেন আখেনাতেন "সহসা আতেনের প্রতি গভীর আবেগ" অনুভব করে একেশ্বরবাদী এক ধর্মের প্রবর্তন করতে গেলেন, সেইটা বের করতে হলে আগে বুঝা দরকার আখেনাতেন-পূর্ব আমলের মিশরের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আধিপত্যের হিসাব-নিকাশ। তিয়ে ইসরায়েলী হিসেবে সিংহাসনের বৈধ উত্তরাধিকারিণী ছিলেন না। তাই তিনি রাষ্ট্রদেবতা আমনের সহধর্মীণিরূপে গৃহীত হতে পারেন না। তিয়ের সন্তান সিংহাসনের বসার অর্থই হল মিশরে অ-আমেনীয় শাসনের প্রতিষ্ঠা যা থেবিয়ান পুরোহিতের শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবে পর্যবসিত হয়। আবার মিশরের দুই হাজার বছরের ইতিহাসে অজস্র দেব-দেবীভিত্তিক ধর্মতত্ত্বের শেকল ভেঙ্গে বেরোনোর জন্য আখেনাতেন কালের চাহিদারূপে মানুষের চিন্তার বিকাশের পথে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছিলেন- এভাবেও চিন্তা করা যায়। মানুষের আদিম স্তরে বহু দেব-দেবীকেন্দ্রিক ধর্মতত্ত্ব থেকে এক সুপ্রীম ঈশ্বরের দিকে রওনা হবার পথে এই ফেরাউন আমাদের ত্রাতারূপে হাজির ইতিহাসে।
বাংলার মানুষ সেই বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে একদিন পৌঁছাবে যেখানে "ফেরাউন" তাদের বন্ধুও হয়ে যেতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৫৭