রামপাল নিয়ে কত বাদ-প্রতিবাদ।
কত লেখনি রামপাল নিয়ে যত পোষ্ট.... আপডেটেড..
উত্তপ্ত রাজপথ।
সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম!
সব জল্পনার অবসান ঘটলো- বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি সই-এর মাধ্যমে!
কি করবে দেশবাসী? সুন্দরবনের বৃক্ষদেরতো নিরবে আত্মদান ছাড়া অন্য পথ খোলা নেই! দুর্লভ রয়েল বেঙ্গল টাইগারার জীবন বাঁচাতেই বিনা ভিসায় বিনা পাসপোর্টই ওপারের সুন্দরবন অংশে মাইগ্রেট করবে-সারভাইবাল কোশ্চেন! কয়লা খনির যে সমস্যা সারা বিশ্ব একে ব্যাকফুটে রেখেছে বাঙালীরা মিলেনিয়ামে এসে সেই সব রোগে ভুগে উন্নয়নের মাশূল দেবে! ফসলী জমি উর্বরতা হারিয়ে, নদী, জীব প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে মূল্য চুকাবে রাজনৈতিক অবিমৃশ্যকারীতার।
আর আমরা চেতনায় বিভক্ত হয়ে একে অন্য দোষারুপ করতে করতেই পক্ষে-বিপক্ষের টকশো করবো! টেবিল চাপড়ে ভেঙ্গে ফলবো! দেশের জন্য, দেশের স্বার্থে এক হবো না!!!!!!!!!!!
দিনমজুর ভাইয়ের পোষ্টের সুন্দরবন এতদিন আমাদের বাচিয়েছে কিন্তু এখন সুন্দরবনকে কে বাচাবে?পিক পয়েন্ট গুলো আবারো তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছি-আমাদের গোল্ডফিস মেমোরি যদি তাজা হয়!
যে ভারতীয় কোম্পানি এই বিদুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনা করবে, নিজ দেশ ভারতে হলে কিন্তু এইভাবে সুন্দরবনের এত কাছে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারতো না। ভারতের ওয়াল্ড লাইফ প্রটেকশান এক্ট অনুসারে কোন সংরক্ষতিত বনাঞ্চলের ১৫ কিমি এর মধ্যে কোন বিদুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা নিষেধ। ১ কিমি কিন্তু কম না, সুন্দরবন ধ্বংস করার জন্য এই ১ কিমিই যথেষ্ট। মালয়েশিয়ায় এই দূরত্ব ২০ কিমি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এইসবের কোন বালাই নাই। ভারতের মধ্য প্রদেশে এনটিপিসি কোম্পানিরই একই আকারের অর্থাৎ ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয় নাই ভারত সরকার কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আবাসিক এলাকার কাছে, দুই ফসলী জমির উপর অবস্থিত এবং যে নদীর পানি ব্যাবহার করবে সেই নদীতে পানির সংকট। অথচ বাংলাদেশে সুন্দরবনের পাশে বিদুৎ কেন্দ্রটি নিয়ে আপত্তি এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি সিরিয়াস। যেমন:
১) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাইঅক্সাইড(SO2) ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড(NO2) নির্গত হবে যার ফলে পরিবেশ আইনে বেধে দেয়া পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার সীমার(প্রতি ঘনমিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রাম) তুলনায় এইসব বিষাক্ত গ্যাসের মাত্রা অনেক বেশি হবে(প্রতি ঘনমিটারে ৫৩ মাইক্রোগ্রামের বেশি) যার ফলে এসিড বৃষ্টি, শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি সহ গাছপালা জীবজন্তুর জীবন বিপন্ন হবে। অথচ জালিয়াতি করে সুন্দরবনকে পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার বদলে ‘আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা’ হিসেবে দেখিয়ে বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ নিরাপদ মাত্রার মধ্যেই থাকবে বলে প্রতারণা করা হচ্ছে।
২) সাড়ে চার বছর ধরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কালে নির্মাণের মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদী পথে পরিবহন করার সময় বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নি:সরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নি:সরণ, ড্রেজিং ইত্যাদির মাধ্যমে সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
৩) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৪ ৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এই ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূতি ছাই বা স্লারি ইত্যাদি ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করে কারণ এতে বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। এই দূষণকারী ছাই দিয়ে ১৪১৪ একর জমি ৬ মিটর উচু করা হবে। ফলে এই ছাই উড়ে, ছাই ধোয়া পানি চুইয়ে আশপাশের নদী খাল এবং আন্ডারগ্রউন্ড ওয়াটার টেবিল দূষিত করবে।
৪) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন, জেনারেটর, কম্প্রেসার, পাম্প, কুলিং টাওয়ার, কয়লা উঠানো নামানো, পরিবহন ইত্যাদির কাজে ব্যাবহ্রত যন্ত্রপাতি ও যানবাহন থেকে ভয়াবহ শব্দ দূষণ হয়। বলা হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশে সবুজ বেষ্টনি তৈরী করে সুন্দরবনকে রক্ষা করা হবে। কিন্তু সবুজ বেষ্টনি বেড়ে উঠতে তো সময় লাগবে। ঐ কয় বছর শব্দ দুষণ প্রতিহত করা হবে কি ভাবে কিংবা সবুজ বেষ্টনির বাইরে যন্ত্রপাতি ওমালামাল পরিবহন, ড্রেজিং ইত্যাদি কাজের সময় যে শব্দ দূষণ হবে তার ক্ষতিকর প্রভাবে কিভাবে মোকাবিল করা হবে।
৫) প্ল্যান্ট পরিচালনার জন্য পশুর নদী থেকে ঘন্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার পানি সংগ্রহ করা হবে এবং পরিশোধন করার পর পানি পশুর নদীতে ঘন্টায় ৫১৫০ ঘনমিটার হারে নির্গমন করা হবে। পরিশোধন করার কথা বলা হলেও বাস্তবে পরিশোধনের পরও পানিতে নানান রাসায়নিক ও অন্যন্যা দূষিত উপাদান থেকে যাওয়ার ঝুকি থাকেই। তাছাড়া নদী থেকে এই হারে পানি প্রত্যাহার, তারপর বিপুল বেগে পানি আবার নদীতে নির্গমন, নির্গমনকৃত পানির তাপমাত্রা ইত্যাদি নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ, পানির প্লবতা, পলি বহন ক্ষমতা, মৎস ও অন্যান্য প্রানী ও উদ্ভিদের জীবন চক্র ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বেই যা নদী নালা খাল বিলের মাধ্যমে গোটা সুন্দরবনের জলজ বাস্তুসংস্থানের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
৬) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনী থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস যা চারপাশের পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
৭) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আমদানী করা কয়লা সুন্দরবনের মধ্য দিয়েই পরিবহন করা হবে। এ জন্য বছরে ৫৯ দিন কয়লা বড় জাহাজ এবং ২৩৬ দিন লাইটারেজ জাহাজ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লার মতো দূষণ কারি কার্গো নিয়ে চলাচল করবে। ফলে কয়লা পরিবহন, উঠানো –নামানো, জাহাজের ঢেউ, নাব্যতা রক্ষার জন্য ড্রেজিং, জাহাজ থেকে নির্গত তরল কঠিন বিষাক্ত বর্জ্য, জাহাজ নি:সৃত তেল, দিন রাত জাহাজ চলাচলের শব্দ, জাহাজের সার্চ লাইট ইত্যাদি সুন্দরবনের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ও জীব বৈচিত্র বিনাশ করবে।
এগুলো আমাদের নিজেদের বানানো কথা না, প্রকল্পের কাজ শুরু করে দিয়ে তারপর প্রকল্প জায়েজ করার জন্য যে পরিবেশ সমীক্ষা বা ইআএ করা হয়েছে, শত জালিয়াতি করেও এইরকম ভয়ংকর ফলাফলগুলোকে ঢেকে রাখা যায় নি। অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় স্বার্থ বিরোধী। বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ না করেই চুক্তি করা হয়েছে। ইআইএ সমীক্ষাতে প্রাথমিক ভাবে যে দামের কথা বলা হয়েছে তা প্রায় ৯ টাকা প্রতি ইউনিট যা অনেক কুইক রেন্টালের চেয়ে বেশি। তাছাড়া ৫০:৫০ জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি বলা হলেও ৭০ ভাগ পুজি আসবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে, বাকি ৩০ ভাগ এনটিপিসি ও পিডিবি সমান দুই ভাগ করে দেবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাও এনটিপিসি করবে। এমনকি মুনাফার উপর থেকে করও মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিবেচনাতেও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রটি সুফল বয়ে আনবে না।
যে সুন্দরবন আমাদেরকে আইলা সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করেছে, কাঠ দিয়ে মাছ দিয়ে খাদ্য দিয়ে আমাদের বাচিয়ে রেখেছে, সে সুন্দরবন যে নিজেই এখন বিপন্ন, সেটা স্পষ্ট। সুন্দরবনকে ভালোবেসে অষ্টমাশ্চার্য বানানোর জন্য আমরা লাখ লাখ ভোট দিয়েছি, রাস্তায় নেমে ক্যাম্পেইন করেছি। আজ যখন আমাদের প্রিয় সেই সুন্দরবনের অস্তিত্বটাই বিপন্ন তখন কি আমরা সুন্দরবন বাচানোর জন্য প্রতিবাদ করব না? সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, ইরাবতি ডলফিন থেকে শুরু করে সুন্দরী বৃক্ষদের মিছিল সমাবেশ করার ক্ষমতা থাকলে এতদিনে তারা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসত, সব কিছু অচল করে দিত। এদের হয়ে সুন্দরবন রক্ষার দ্বায়িত্ব এখন আমাদেরই বন্ধুগণ, চুক্তি কিন্তু হয়ে গেছে, সরকার কিন্তু কাজ শুরু করে দিয়েছে:
'বাগানের চারা গাছ রে, ডেকে ডেকে বলি, ডেকে ডেকে বলি, রাস্তায় নেমে আয়।' ফেসবুকে, ব্লগে, টুইটে.. প্রতিবাদের প্রতিটি পথে, পথের মোড়ে...অস্তিত্বের প্রয়োজনে। সময়ের প্রয়োজনে!
বাঁচাতে নিজেরে, বাঁচাতে রামপাল, বাঁচাতে সুন্দরবন! বাঁচাতে রয়েল বেঙ্গল! বাঁচাতে পরিবেশ প্রতিবেশ! বাঁচাতে দেশ!!!
হায় রামপাল! হায় সুন্দরবন! সুন্দরবনের, সুশীল চেতনার আর দেশপ্রেম ও প্রেমিকের!!! সুশীল মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর হয়েই গেল!!!!
আপডেট:
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি বাতিল করতেই হবে: সুলতানা কামাল
জেগে উঠো বাঙালী। রুখে দাও দেশের, সুন্দরবনের, আমজনতার, ফসলী জমির. নদীর প্রকৃতির বিরোধী এই আত্মঘাতি চুক্তি!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৪