পানি কী কখনো বর্জ্য হয়? হয় কীভাবে? পানি বর্জ্য হয় যখন আমরা ভালো পানিটাকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছি; কিন্তু তার একটি বৃহদাংশ অব্যবহৃত রেখে যাচ্ছি। রেখে যাওয়া পানিটি হয়ে যাচ্ছে নোংরা বা বর্জ্য। এই বর্জ্য পানি আর ব্যবহারের উপযোগি থাকছে না। সাধারণত আমরা দু’ভাবে পানিকে বর্জ্য করে তুলছি। এক. গৃহস্থলীতে পানির অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের মাধ্যমে। অন্যভাবে বললে আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজে পানির যে অপচয় করছি সেটিকেই বর্জ্য পানি বলছি। আর দুই. কৃষি, কলকারখানা এবং অপরিকল্পিত নর্দমার মাধ্যমে পানি দূষণের মাধ্যমে পানিকে বর্জ্য পানিতে পরিণত করি। পানিকে বর্জ্য পানিতে রূপান্তর করার প্রক্রিয়াটি আমরা অনেক সময় অজান্তে বা জেনে করে আসছি। আমরা যদি একটু সচেতন হই এবং আমাদের নিত্যদিনের পানি ব্যবহারের চিত্রটি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো আমরা প্রতিদিনই নানাভাবে বিশুদ্ধ পানিকে বর্জ্য পানিতে রূপান্তর করে আসছি। পানির এই অপচয় (বর্জ্য পানি) সম্পর্কে সচেতন করার জন্য ২০১৭ সালে ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক পানি দিবস এর প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে “পানি কেন বর্জ্য”? প্রতিবছর ২২মার্চ আন্তর্জাতিক পানি দিবস পালন করা হয় বিভিন্ন ইস্যু এবং সেই ইস্যু কেন্দ্রিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য। এবারের প্রতিপাদ্যের মূল বক্তব্য হচ্ছে পানির অপচয় (বর্জ্য) কমানো এবং ব্যবহার্য পানির পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করা।
আপনি কি পানি অপচয় করেন? বুকে হাত দিয়ে বলুন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে যে, আমরা কেউ পানি অপচয় করি না। কিন্তু আমাদের ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে পানির অপচয় করি নানাভাবে। আমাদের নাগরিক জীবনে সকালে উঠে ব্রাশ করার সময় পানির কল (ট্যাপ) খুলে রাখি। রান্নাঘরের সিঙ্কে পানি অনবরত পড়তেই থাকে। গোসলের সময় শাওয়ার কিংবা পানির কল থেকে পানি পড়তেই থাকে প্রয়োজন ছাড়াই। এতো গেলো শহুরে জীবন। গ্রামের জীবনেও পানির অপচয় কম নয়। টিউবওয়েল থেকে এক গ্লাস পানি সংগ্রহ করতে গেলে কমপক্ষে আরো ১০ গ্লাস পানি অপচয় করি। টিউবওয়েলে গোসল করতে গিয়ে কতো পানি অপচয় করি তার হিসাব কে রাখে। পুকুরের পানিকে থালা-বাসন, কাপড় ধোয়া কিংবা পশুপাখির অবাধ বিচরণে খাবার উপযোগী আর থাকেই না। এটি শুধু গৃহস্থালীতে ব্যবহার্য পানির অপচয়ের (বর্জ্য পানিতে পরিণত হওয়া) চিত্র। এই চিত্র আরো বেশি ঘনীভূত হয় কৃষিক্ষেত্র এবং কলকারখানায়। এটি শুধু বাংলাদেশের কথা নয়; সারা পৃথিবীতে পানি অপচয় হচ্ছে। প্রতিদিন আমরা নানাভাবে পানির অপচয় করে থাকি। যে পানি আমাদের প্রাণ, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাই বিনামূল্যে। সেই বিনামূল্যের পানিই আমরা অপচয় করি এবং পুনরায় কয়েকগুণ বেশি মূল্যে কিনে পান করি।
পানি এ মাহাবিশ্বের সবচেয়ে স্বাতন্ত্র্য একটি উপাদান। এটি এখনো পর্যন্ত কেবল আমাদের এই পৃথিবীতেই সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই আমাদের এই নীল গ্রহেই কেবল পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পানি আছে বলেই আমাদের পৃথিবীতে প্রাণ আছে। পৃথিবীর মোট ভুখন্ডের ৩ ভাগ পানি এবং ১ ভাগ স্থল। আবার এই ৩ ভাগ পানির প্রায় পুরোটাই (৯৬.৫%) সমুদ্রের লবণাক্ত পানি। আর পানযোগ্য পনি মাত্র ৩.৫%। এই স্বল্প পরিমাণ পানি সম্পদের প্রাকৃতিকভাবে সুষম বণ্টিত নয় পৃথিবীর সমগ্র এলাকায়। কোথাও পানির প্রাচুর্য্যতা রয়েছে (কানাডা, বাংলাদেশ); তো কোথাও তীব্র সংকট (সাহারা মরুভুমি বা উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু)। সমান্তরালভাবে একটি দেশের প্রতিটি অঞ্চলেও পানি সম্পদের সমান প্রাপ্যতা নেই। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এর সাথে যখন সামাজিক-সাংস্কৃতিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বণ্টন ব্যবস্থা জড়িয়ে পড়ে তখন এই পানি সম্পদ সত্যি সত্যি হয়ে ওঠে সম্পত্তি (!)। সাথে সাথে আরোপিত হয় ব্যবসা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতার দ্বান্দ্বিকতা। এই যখন সুপেয় পানির পরিস্থিতি; আর এর সাথে যদি পানির আপচয়যুক্ত হয় তাহলে সেটি কতটা ভয়াবহ হতে পারে- সেটি সকলেরই বোধগম্য।
পানি খুবই সহজপ্রাপ্য এবং বিনামূল্যে প্রাপ্য বলে আমরা এটি নিয়ে ভাবিই না। যথেচ্ছভাবে পানির অপচয় করে থাকি। পানি যে আজও কিনে খেতে হয়-সেটি আমরা মানতে নারাজ। কিন্তু আমাদের অগোচরেই এই পানি আমাদের কাছে মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। ঢাকা শহরের একটি পরিবার যে টাকা পরিশোধ করে সারা মাসের সবচেয়ে নিরাপদ পানি পায় সেই পানি দিয়ে পরিবারটি গৃহস্থালীর সকল কার্যক্রম (খাওয়া, রান্না করা, গোসল, পোশাক পরিষ্কার, ঘরবাড়ি ধোঁয়ামোছা এমনকি নির্মাণসহ নানাবিধ কাজ) সম্পাদন করে। সেই পানিটি কিন্তু নিরাপদ ও পানযোগ্য! ঠিক উল্টোই ঘটে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল যেখানে সুপেয় পানির স্বল্পতা রয়েছে। বিশষ করে উপকূলীয় অঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চল, উচ্চ বরেন্দ্রভূমি, বর্ষাকালে হাওড় অঞ্চলসমুহে। এছাড়াও আর্সেনিক, পানিতে আয়রন, লবণাক্ততা এবং ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার এই সমস্ত এলাকার সুপয়ে পানির সংকটকে আরো বেশি তীব্র করে তুলেছে। এই সমস্ত এলাকার একটি পরিবারের শুধু খাবার পানি সংগ্রহ করতেই ঢাকার চেয়ে কয়েকগুন বেশি টাকা (শ্রম এবং সময়ের মূল্য বিচেনায়) পরিশোধ করতে হয়। আবার একই এলাকার ধনী ও গরিবের মধ্যে পানির প্রাপ্যতা এবং সেটি সংগ্রহের ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈষম্যমূলক চিত্র। তাই এই পরিস্থিতিকে আরো বেশি ভয়াবহ করে তুলছে আমাদের দৈনন্দিন পানির আপব্যবহার। উদাহরণ হিসেবে শহরের একটি টয়লেট একবার ফ্লাশ করার ফলে যে পরিমাণ (সুপেয় পনি) পানি অপচয়/অপব্যবহার করি। এই পরিমাণ পানি দিয়ে গ্রামের একটি চারজন সদস্যের পরিবারে এক দিনের খাবার পানির চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে পানির এমন অপব্যবহার তো আরো ভয়াবহ।
জাতিসংঘের পানি বিষয়ক অধিদপ্তর এর তথ্য মতে, বিশ্বে গৃহস্থালীতে যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হয় তার ৮০ শতাংশই বর্জ্য (অপচয়) হয়ে যায়। এই বর্জ্য পানি কোনভাবেই পুনঃব্যবহার বা প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রতিবেশে ফিরে আসে। এই তথ্য আমাদেরকে বেশ নাড়িয়ে দেয়। আমরা আমাদের পরিবারে প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করি তার বেশিরভাগই অপচয় হয়ে নোংরা বা বর্জ্য পানিতে পরিণত হয়।শুধু গৃহস্থলীতে নয়; কৃষি ক্ষেত্রেও নানাভাবে পানি নষ্ট হয়ে যায়। কৃষিক্ষেত্র পানি নোংরা হওয়ার ঘটনাটা অপচয় হওয়ার চেয়ে ব্যতিক্রম। কৃষিতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক বা সার ব্যবহারের ফলে কৃষিতে ব্যবহৃত পানি বিষাক্ত হয়ে ভূগর্ভস্থ এবং ভূপৃষ্ঠস্থ পানিকে বিষাক্ত করে তোলে। ফলে এই পানি আর ব্যবহারের উপযুক্ত থাকে না এবং বর্জ্য পানিতে পরিণত হয়। সেই হিসাবে কৃষি পানিকে বেশি বর্জ্য পানিতে পরিণত করে।কৃষি ক্ষেত্রের ন্যায় শিল্প কলকারখানাও একটি বড় অংশ বর্জ্য পানি তৈরি করে। কলকারখানায় ব্যহহৃত উচ্ছিষ্ট পানি সরাসরি ভূপৃষ্ঠ এবং জলাশয়ে নিষ্কাশনের ফলে ভূগর্ভস্থ এবং ভূপৃষ্ঠস্থ উভয় পানিই আজ বিষাক্ত এবং বর্জ্য পানিতে পরিণত হয়। কলকারখানার উচ্ছিষ্ট পানি কী পরিমাণ বর্জ্য পানি তৈরি করে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ। এছাড়াও কলকারখানা সংলগ্ন অসংখ্য জলাশয়ও আজ বর্জ্য পানিতে পরিণত হয়।
পানি বর্জ্য, নোংরা, অপচয় কিংবা অপব্যবহার হয় আমাদের দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমেই। কেন আমরা আমাদের অমূল্য এবং স্বাতন্ত্র্য এই সম্পদকে বর্জ্যে পরিণত করছি- সেটি আজ ভাবনার বিষয়। আমাদের টেকসই পৃথিবীর জন্য, দীর্ঘস্থায়ী ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমাদের এই স্বল্প সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। পানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য আমাদের দু’টি কাজ করতে হবে। প্রথমত, পানির অপচয় এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কমাতে হবে; যেন পানি কম পরিমাণে বর্জ্য পনিতে পরিণত হয়। আর দ্বিতীয়তঃ বর্জ্য পানিকে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুনঃব্যবহারের উপযোগি করে তুলতে হবে।
বর্জ্য পানিকে সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ এবং সম্ভবনা প্রচুর। বর্জ্য পানির নিরাপদ ব্যবস্থাপনার জন্য খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়ে না। পাশাপাশি এই বর্জ্য পানি ব্যবহার বেশ টেকসই এবং শক্তি, পুিষ্ট ও নানা রকম উপাদানের উৎস। অনেকেই ভাবতে পারে বর্জ্য বা নোংরা পানিকে পুনরায় ব্যবহার করে টাকা নষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু মানুষের সুস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং টেকসই পরিবেশের নিরীক্ষে এই টাকার পরিমাণ কিছুই না। পাশাপাশি, বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনা নতুন নতুন ব্যবসায়িক ক্ষেত্র তৈরি করবে, যা হতে পারে সবুজ পৃথিবীর সবুজ পেশা।
ছবিগুলো ইন্টারনেট এর মুক্ত সোর্স থেকে সংগৃহীত
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়- barciknews এ
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৩:২৩