প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স নগরের আগোরা। Agora শব্দটি গ্রিক। এবং আমরা এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। তবে আমরা আগোরা বলতে কেবল হাটবাজার বুঝি, অথচ এই কথাটি পুরোপুরি সত্য না। কেননা, কেবল হাটবাজারই না, আগোরা ছিল এথেন্স নগরের জনজীবনের কেন্দ্র। যুদ্ধযাত্রার আগে সৈন্যরা জড়ো হত এখানে, প্রশাসনিক ভবনগুলোও সব আগোরাতেই ছিল, ধর্মীয় সমাবেশেও অনুষ্ঠিত হত । অবশ্য, আগোরায় বিকিকিনিও হত- মাছ মাংস থেকে শুরু করে নুন -সবজি -তৈজষপত্র সবই পাওয়া যেত আগোরায়। তবে, বিকিকিনির হাটের এক পাশে চলত দর্শন চর্চা ... এবং এই বুদ্ধিবৃত্তিক দিকটাই এথেন্সকে অন্যদের চেয়ে পৃথক করে রেখেছে ... যেমনটা লালনের গান ক্রমশ বিশ্ববাসীর কাছে জাতি হিসেবে বাঙালির স্বাতন্ত্র তুলে ধরছে ...
আগোরার মানচিত্র
আগোরার অবস্থান ছিল আথেন্স নগরের সুবিখ্যাত পাহাড় অ্যাক্রোপলিস-এর উত্তরপশ্চিমে। আগোরার দক্ষিণে ছিল আরিওপাগাস টিলা এবং পশ্চিমের টিলার নাম কলোনাস আগোরায়েউস ।
আগোরার মানচিত্র
আগোরায় ছিল অনেকগুলি স্টোয়া।
স্টোয়া কি?
স্টোয়া হল বড় বড় থামওয়ালা প্রশস্ত টানা বারান্দা। এথেন্সবাসী স্টোয়ায় বসে গুলতানী মারত, মানে আড্ড দিত। বেশিরভাগ আড্ডার বিষয়ই ছিল -আজকের দিনের মতো-পলিটিক্যাল। মেয়েরা কি করত? ঘরে বন্দি জীবন যাপন করত। মেয়েদের, বিশেষ করে স্বচ্ছল এবং অভিজাত ঘরের মেয়েদের আগোরায় দেখা যেত না। হাট-বাজার করত দাসরা। তবে গরীর দুঃস্থ আর বিধবা মেয়েরা আগোরায় রুটি ও ফুল বিক্রি করত।
স্টোয়া পয়েকিল।
আগোরার উত্তর দিকে ছিল স্টোয়া পয়েকিল । এবং এটি নির্মাণ করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে। গ্রিক শব্দ ‘পয়েকিল’ মানে রং করা বা রঙীন। কেন এই নাম? মাইকন নামে এক ভাস্কর এবং চিত্রশিল্পী স্টোয়াটিকে নানা রঙীন ছবি দিয়ে সাজিয়েছিলেন। তাঁকে এই কাজে সাহায্য করেছিল থাসস এর পলিগনোটোস। এরা কাজ করেছিলেন ৪৫০ খ্রিস্টপূর্ব। এদের আঁকা ছবির বিষয় ছিল: ট্রয় এবং ম্যারাথন যুদ্ধ। পরবর্তী কালে অবশ্য আরও অনেক চিত্র আঁকা হয়।
স্টোয়া পয়েকিল। এটি লালনের ছেঁউরিয়ার আখড়াবাড়ির সঙ্গে তুলনীয়। ...
স্টোয়া পয়েকিল যে কারণে স্মরণীয় এবারে সে কথায় আসি।
গ্রিসের ইতিহাসে Hellenistic period বলে একটি কথা রয়েছে। এই সময়টায় গ্রিসের জীবনধারা, দর্শন ও সাংস্কৃতিক চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছিল। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্দারের মৃত্যু হয়েছিল ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বে। তখন থেকে ১৪৬ খ্রিস্টপূর্ব রোমান সাম্রাজ্য কর্তৃক গ্রিস দখল অবধি সময়কালকে ‘হেলেনিস্টিক সভ্যতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
হেলেনিস্টিক সভ্যতার মানচিত্র
হেলেনিস্টিক সভ্যতার দর্শন হল স্টোয়িক দর্শন । এথেন্স-এর আগোরার স্টোয়া থেকে স্টোয়িক দর্শন নামকরণ করা হয়েছে। কারণ, স্টোয়া থেকে- বিশেষ করে স্টোয়া পয়েকিল থেকে স্টোয়িক দর্শন প্রচার করা হয়েছিল । দার্শনিক যেনো স্টোয়া পয়েকিল-এ বসে স্টোয়িক দর্শন প্রচার করেছিলেন।
স্টোয়িক দার্শনিক যেনো (৩৩৪-২৬২ খ্রিস্টপূর্ব)। ইনিই স্টোয়িক দর্শনের প্রবক্তা। তাঁকে যেনো অভ সিটিয়াম বলা হয়। কারণ তিনি সিটিয়াম নগরে জন্মেছিলেন। সিটিয়াম জায়গাটি বর্তমান সাইপ্রাসের দক্ষিণাঞ্চলে।
পরিনত বয়েসে যেনো এথেন্স চলে আসেন এবং ৩০৮ খ্রিস্টপূর্ব থেকে স্টোয়া পয়েকিল থেকে স্টোয়িক দর্শন প্রচার করতে থাকেন।
স্টোয়িক দর্শনের মূলকথা হল: সব কিছুই (বস্তু কিংবা সম্পর্ক) অনঢ় প্রাকৃতিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জ্ঞানী মানুষের লক্ষ হওয়া উচিত পূণ্য অর্জন করা। তিনি যুক্তি এবং বিচারবুদ্ধির সাহায্যে চারপাশের ঘটনার প্রতি উদাসীন থাকবেন। আবেগশূন্যতাই স্টোয়িক দর্শনের আরেকটি মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এ ছাড়া, নৈতিকতা বা এথিক্স হল স্টোয়িক দর্শনের মূল ভিত্তি। স্টোয়িক দর্শন কেবলি তাত্ত্বিক দর্শন নয়, স্টোয়িক দর্শনকে জীবনে প্রতিফলিত করতে হয়। যে কারণে আপৎকালীন সময়ে ধৈয্য ধরা, অভিযোগ না করে সহনশক্তি দেখানো-এসব একজন স্টোয়িক দার্শনিকের গুণ বলে বিবেচিত হয়। যেনো মনে করতেন: প্রাকৃতিক জগতের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রন নেই। (বর্তমানে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ অস্ট্রেলিয়বাসী এমনই ভাবছে সম্ভবত) ... তুলনীয় লালনের গান:
বিধাতা সংসারের রাজা
আমায় করে রাখলেন প্রজা।
কর না দিলে দেয় গো সাজা
কারও দোহাই মানে না ...
যেনোর ওপর পূর্বতন গ্রিক দার্শনিকবৃন্দের প্রভাব পড়েছিল। যেমন, তিনি ভাবতেন, অগ্নি বা আগুন হল আদিবস্তু। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসও তাইই মনে করতেন। প্রকৃতিকে যে স্বর্গীয় শক্তি ধরে রাখে-তার নাম লোগোস। স্টোয়িকরা এই লোগোস এর ধারণা গ্রহন করেছিল। তারা মনে করতেন লোগোস হল শক্তি, আইন এবং যুক্তিবোধ। লোগোস হল বাস্তবতার ‘সক্রিয় নীতি।’ লোগোস হল যুক্তগ্রাহ্য স্বর্গীয় শক্তি, যা মহাবিশ্বের ঐক্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখে। ঈশ্বর, প্রকৃতি এবং নিয়তি। মানব-এর যুক্তিবোধ এবং মানবাত্মা উভয়ই স্বর্গীয় লোগোস এর অবিচ্ছেদ্য অংশ-যে কারণে অমর ...
তা হলে বলা যায় যে সুফিবাদের উন্মেষ হয়েছিল স্টোয়িক দর্শনেই?
এবং যেনো এ কারণেই দর্শনের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন।
যেনো বলেছেন, মানুষের আত্মা স্বর্গীয় লোগোস এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই বিস্ফোরক ধারণাটিই সময়ের হাত ধরে বাংলায় বাউলদর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে পরিনত হয়েছে-মানবদেহে বিশ্বজগতের অধিশ্বর (অচিন পাখি বা মনের মানুষ) বাস করেন। লালন-এর একটি গানে আছে:
ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমনই ঘর
শূন্যের ওপর পোইচতা করে ...
মূলাধার কুঠুরি নয়টা
তার ওপরে সদরকোঠা,
তাহে এক পাগলাবেটা
বসে একা একেশ্বরে ।
লালন-এর এই পাগলাবেটাই যেনো-র লোগোস।
যেনোর একটি বাণী।তুলনীয় লালন এর একটি গান: সত্য বল/সুপথে চল/ ওরে আমার মন ...
হেলেনিস্টিক সভ্যতার কথা বলছিলাম। এই সময়ে ইহুদীরা গ্রিকদর্শনের সংস্পর্শে আসে। ওই সময়ে মিশরে আলেকজান্দ্রিয়ার মতো নগরগুলি গড়ে উঠছিল, আলেকজান্দ্রিয়ায় ইহুদি বসতি ছিল। ওই সময়ই গ্রিক ভাষায় হিব্রু বাইবেল অনূদিত হয়। ওই একই সময়ে স্টোয়িক দর্শন ইহুদি ঐতিহ্যের ওপর গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পরবর্তীকালে অনেক স্টোয়িক ধারণা খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মেও গৃহিত হয়েছে, গ্রিক শব্দগুলি বদলে গেছে কেবল।
লালন
আজ থেকে ২৩০০ বছর আগে বেঁচে থেকে মহামতি যেনো এক ভ্রাতৃত্ববোধের কথা বলেছিলেন-যা সত্যিই বিস্ময়কর। এ বিষয়ে জনৈক ঐতিহাসিক-এর উক্তি প্রনিধানযোগ্য: A distinctive feature of Stoicism is its cosmopolitanism. All people are manifestations of the one universal spirit and should, according to the Stoics, live in brotherly love and readily help one another. They held that external differences such as rank and wealth are of no importance in social relationships.
কেন এই বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ?
বিষন্ন সময়ে বেঁচে থেকে একটু উষ্ণতার জন্য মহাত্মা যেনোর আর্তি।
স্টোয়িক দর্শন এত বিষন্ন কেন?
এর দুটো কারণ চিহ্নিত করা যায়।
প্রথমত: হেলেনিস্টিক সভ্যতার পুরোটাই রাজ্য ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ছিল ভাঙনের কাল। তখন সবই ভাঙছিল-কি শত বছরের লালিত বিশ্বাস, কি সংবিধান। তদুপরি, চারপাশে ঝোড়ো বাতাসে এথেন্সকেন্দ্রিক গ্রিসের গৌরবের বাতিটি হয়েছিল নিভু নিভু । মৃত সম্রাট আলেকজান্দার-এর সাম্রাজ্যটি ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গিয়েছে। এই তিন অংশের অধিশ্বরের মধ্যে চলছিল আরও ক্ষমতার লোভে রক্ষক্ষয়ী লড়াই। নিদারুন এক নৈরাজ্য গ্রাস করেছিল গ্রিকবিশ্বকে। যেনো সেই বিষাদিত যুগে-সঙ্গত কারণেই সংবেদনশীল মানুষ বলেই শ্বাসকষ্ট অনুভব করেছিলেন ... অনিবার্যভাবেই হয়ে পড়েছিলেন নিয়তিবাদী । এথেন্সের স্টোয়া পয়েকিলে বসে বলেছিলেন: প্রাকৃতিক জগতের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রন নেই।
দ্বিতীয় কারণ:
হেলেনিস্টিক সভ্যতায় পূর্বপশ্চিমের চিন্তাধারার মিলন ঘটেছিল। আমরা জানি, প্রাচ্য দর্শন গভীর অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন হলেও দর্শনটি জীবনবিমূখ ও বিষাদক্লিষ্ট ... কেবলমাত্র প্রাচীন ভারতের চার্বাকরাই ছিলেন জীবনবাদী; তারা নাকি বলতেন: ‘ঋণ করে হলেও ঘি খাও’। তো সেই আশাপ্রদ বাণী প্রত্যাখান করেছিলেন যেনো । তবে চার্বাক দর্শনের প্রভাব পড়েছিল গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরিয়াস এর দর্শনের ওপর। আশ্চর্য এই- ইনি ছিলেন যেনোরই সমসাময়িক এবং বাস করতেন এথেন্স নগরে। (এথেন্সের নগরের মানচিত্র পাঠ করে বুঝেছি: দার্শনিক এপিকিউরিয়াসের বাড়ি থেকে স্টোয়া পয়েকিল বেশি দূরে ছিল না। ) এপিকিউরিয়াস-এর এথেন্সের বাগানবাড়িতে বিকেলে লোকজন আসত। তিনি বাগানে বসে ‘সুখবাদ’ প্রচার করতেন। তবে যেনোর দর্শনের মূল ধরণটি বিষাদিত রয়ে গেছিল। যে কারণে যেনো বলতেন: জ্ঞানী মানুষ চারপাশের ঘটনার প্রতি উদাসীন থাকবেন।
প্রাচীন এথেন্স-এর আগোরার স্টোয়া পয়েকিল বসে এসব নিরানন্দ কথাই প্রচার করেছিলেন স্টোয়িক দার্শনিক যেনো ।
যেনো একশ বছর বেঁচেছিলেন।
আত্মহত্যা করেছিলেন।
লালন বেঁচেছিলেন আনুমানিক ১১৬ বছর।
মৃত্যুর আগে শিষ্যগনকে বলেছিলেন, আমি চলে যাচ্ছি!
স্টোয়িক দর্শন সম্বন্ধে তথ্যসূত্র
http://www.wordiq.com/definition/Stoicism
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১১ সকাল ৮:৩৯