উপকথার অবিনাশী এক আগুনপাখির নাম ফিনিক্স । উপকথামতে ওই আগুনরঙা ফিনিক্স পাখিটি নাকি ৫০০ বছর বেঁচে থাকত । তারপর? তারপর জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পাখিটি দারুচিনি, গন্ধরস প্রভৃতি সুগন্ধী উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি করত একটি নীড়, তারপর সে নীড়ে ধরিয়ে দিত আগুন... নীড়সহ ফিনিক্স পাখিটি পুড়ে ছাই হয়ে যায় ...না, এখানেই সব শেষ নয়, কারণ ভস্মিভূত ছাই থেকে আবার জেগে ওঠে আরেকটি অগ্নিবর্ণ ফিনিক্স পাখি। নতুন পাখিটি তারপর সে ছাই জড়ো করে হেলিওপোলিস নামে প্রাচীন মিশরের একটি নগরে যেত সেখানকার সূর্য দেবতাকে শ্রদ্ধা জানাতে;- এমনই বিচিত্র স্বভাব আগুনপাখি ফিনিক্স-এর ...এই কারণে মনে প্রশ্ন জাগে - আমাদের পূর্বপুরুষরা এমন এক বিচিত্র পাখির কল্পনা কেন করেছিল ... যে আশ্চর্য আগুনপাখিটির উল্লেখ রয়েছে প্রাচীন মিশর থেকে শুরু করে প্রাচীন চিনের উপকথায় ... এবং আধুনিক ইউরোপ- আমেরিকার তরুণ-তরুণীরা শরীরে যে পাখিটির উল্কি আঁকে আজও...
আগুনপাখি ফিনিক্স এর ইমেজ অত্যন্ত সদর্থক ও মঙ্গলময়। এই পাখির অনুষঙ্গে কোনও নঞার্থক ভাব নেই
মানবসভ্যতায় ঠিক কখন ফিনিক্স পাখির কল্পনা করা হল? তা কি দিনক্ষণ গুণে বলা যায়? তবে ফিনিশিয় সভ্যতাই নাকি প্রথম ফিনিক্স পাখির কল্পনা করেছিল। গ্রিক ভাষায় phoenix মানে ‘দি ব্রিলিয়ান্ট ওয়ান’ কিংবা পার্পল বা লাল এবং নীলের মিশ্রণে সৃষ্ট রং। এভাবে ফিনিশিয় (Phoenicia) সভ্যতা আর ফিনিক্স পাখির গ্রিক নামের মধ্যে একটি যোগসূত্র পাওয়া গেল। মজার কথা হল, গ্রিকরা ও রোমানরা ফিনিক্স পাখিকে ভেবেছিল ময়ূর বা ঈগলের মতো । তারা বাস্তববাদী বলে কাল্পনিক কিছু ভাবতে পারছিল না? ফিনিশিয় সভ্যতা প্রথম ফিনিক্স পাখির কল্পনা করলেও অন্যান্য সভ্যতার ধর্মীয় পুরাণে বৃহৎ পাখির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় । যেমন, ভারতে দেবতা বিষ্ণুর বাহন গরুড়। একটি কিংবদন্তী মতে, ফিনিক্স পাখি ৫০০ বছর ভারতে থাকত তারপর আবার মধ্যপ্রাচ্যে চলে যেত।
পার্পল রঙের হিরণ
প্রাচীন মিশরে ফিনিক্স পাখিকে বলা হত বেনু বা বেন্নু।মিশরীয় ধর্মে এই বেনু পাখি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আসলে বেনু হল এক ধরণের পার্পল হিরণ। নীল নদের প্লাবনের সময় নীল রঙের সুন্দর এই পাখিটি আশ্রয় নেয় উঁচু জায়গায় । তখন মনে হয় পানিতে সূর্য ভাসছে। (কী অদ্ভূত সুন্দর কাব্যিক ভাবনা মানুষের!) এই কারণে এ পাখির নাম হয়েছে ‘উদিত জন’ বা ‘দি অ্যাসেন্ডিং ওয়ান’ মানে, যা উঠছে, যা মনে করিয়ে দেয় সূর্য দেবতা ‘রা ’ কে। প্রাচীন মিশরে আত্মাকে বলা হত, ‘বা’। বেনু পাখিকে সূর্য দেবতা ‘রা ’ এর আত্মা মনে করা হত। এভাবেই পার্পল হিরণ পাখিটির নাম হয়, বেনু বা বেন্নু। হেলিওপোলিস মানে সূর্যের নগরী। এটি প্রাচীন মিশরে অবস্থিত ছিল। প্রাচীন হেলিওপোলিস নগরে অধিবাসীরা বেনু পাখি কে ভীষণ শ্রদ্ধা করত।
মানচিত্রে হেলিওপোলিস।
হেলিওপোলিস নগরের উপকথা অনুযায়ী, বেনু পাখির জন্ম আগুন থেকে। কোন্ আগুন? হেলিওপোলিস নগরে দেবতা রা-এর উপাসনালয়ের প্রাঙ্গনে এক পবিত্র গাছ ছিল। সেই পবিত্র গাছের নাম ‘জসদ’। সেই গাছটিই পোড়ানো হলে বেনু পাখির জন্ম হয়। অন্য এক মিশরীয় বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, বেনু পাখি দেবতা ওসিরিস এর সঙ্গে সর্ম্পকিত, যিনি একদা পাখিটিকে পুনুরুজ্জীবিত করেছিলেন। বেনু নাকি ওসিরিস দেবতার পবিত্রতম হৃদয় থেকে উত্থিত হয়েছিল। এখানে আমরা এক উত্থানের ধারণা পাই, যে ধারণাটি ফিনিক্স পাখির একটি মূল বৈশিষ্ট্য।
ফিনিক্স রাইজিং । আধুনিক ইউরোপ- আমেরিকায় এই ধারনাটি বেশ জনপ্রিয়।
তা, ফিনিক্স দেখতে কেমন?
ফিনিক্স দেখতে অপূর্ব সুন্দর। এর পালক ও পুচ্ছ সোনালি ও টকটকে লাল রঙের। কেননা, লাল রং সূর্যর প্রতীক।
এ অলীক উত্থান যেন জীবনেরই জয়গান ...
ফিনিক্স পুর্নজন্ম ও নিরাময়ের প্রতীক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর নতুন জীবনের দিকনির্দেশনা। আগে একবার বলেছি, প্রথম ফিনিক্স পাখির কল্পনা করেছিল ফিনিশিয় সভ্যতা । বাইবেলকথিত নূহ নবীর আমলের প্লাবনের কথা ঐ অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে সুপরিচিত ছিল। ভয়াবহ প্লাবনের পরে ঐ অঞ্চলে জীবনের যে নবযাত্রা সূচিত হয়েছিল -তারই রূপক হয়ে ওঠেনি তো ফিনিক্স পাখি? বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই ভাবা যায়।
পশ্চিম গোলার্ধে ফিনিক্স পাখির প্রথম উল্লেখ করেন প্রাচীন গ্রিসের কবি হেসিওদ (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০) । হেসিওদ তাঁর কবিতায় ধাঁধার মত করে লিখেছেন-
A chattering crow lives out nine generations of aged men,
but a stag's life is four time a crow's,
and a raven's life makes three stags old,
while the phoenix outlives nine ravens,
but we, the rich-haired Nymphs
daughters of Zeus the aegis-holder,
outlive ten phoenixes.
পারস্যের ফিনিক্স। পারস্যের উপকথায় ডানাওয়ালা পাখিসদৃশ জীবের কল্পনা করা হয়েছে; এর নাম সিমুর্গ। সিমুর্গ অতি বৃহৎ ও প্রাচীন। ফরিদউদ্দীন আত্তারের ‘কনফারেন্স অভ বাডর্স’- এ পাখিদের নেতা হিসেবে আমরা সিমুর্গকে দেখতে পাই। মহাকবি ফেরদৌসীর ‘শাহনানামায়’ সিমুর্গ পাখির উল্লেখ রয়েছে।
চিনের ফিনিক্স ফেঙহুয়াঙ।
ফিনিক্স-এর মতোই চিনের উপকথার পাখির নাম ফেঙহুয়াঙ । চিনের সমাজে সবচে পপুলার হল ড্রাগন। ড্রাগনের পরই জনপ্রিয় ফেঙহুয়াঙ । ফেঙহুয়াঙ চিনের সাম্রাজ্ঞী ও নারীর প্রতীক এবং ড্রাগনের কাউন্টারপার্ট। ফেঙহুয়াঙ কে মনে করা হয়, পাখিদের নেতা। চিনের প্রখ্যাত লেখক লাম কাম চুয়েন ফেঙহুয়াঙ প্রসঙ্গে বলেন, "... A mythical bird that never dies, the phoenix flies far ahead to the front, always scanning the landscape and distant space. It represents our capacity for vision, for collecting sensory information about our environment and the events unfolding within it. The phoenix, with its great beauty, creates intense excitement and deathless inspiration."
শুধু চিন কেন ইউরোপেও ফিনিক্স পাখি জনপ্রিয়। ৭০০ খ্রিস্টপূর্বে প্রাচীন গ্রিসের কবি হেসিওদ যার সূচনা করেছিলেন। এমন কী আধুনিক ইউরোপেও ফিনিক্স পাখি খুবই জনপ্রিয় একটি থিম। ইউরোপের গল্প কথায়, কবিতায় ফিনিক্স পাখির ছড়াছড়ি। হ্যারি পটারের স্রষ্টা জনপ্রিয় লেখিকা জে .কে. রাওলিঙ তাঁর বইয়ে ফিনিক্স পাখির এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। রাওলিঙ এর মতে, ফিনিক্স কেবল ৫০০ বছর পর ফিরেই আসে না ... চোখের জলে অন্যের জীবনও বাঁচায়!
জয়তু রাওলিঙ!
তখন একবার বলেছি, আগুনপাখি ফিনিক্স এর ইমেজ অত্যন্ত সদর্থক ও মঙ্গলময়। এই পাখির অনুষঙ্গে কোনও নঞার্থক ভাব নেই!
নিচের দুটি উল্কিতে আধুনিক ইউরোপে ফিনিক্স পাখির জনপ্রিয়তা প্রতিফলিত হয়েছে।
যুগ যুগ ধরে মানবীয় শিল্পে ফিনিক্স পাখির ছাপ পড়েছে
এমন কী উত্তরাধুনিক বিমূর্ত শিল্পেও
এ আলোচনার প্রারম্ভে আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম ... আমাদের পূর্বপুরুষরা এমন এক বিচিত্র পাখির কল্পনা কেন করেছিল ... যে আশ্চর্য আগুনপাখিটির উল্লেখ রয়েছে প্রাচীন মিশর থেকে শুরু করে প্রাচীন চিনের উপকথায়...উত্তরটি খুঁজতে হবে ফিনিক্স পাখির প্রতীক। ফিনিক্স পাখি কিসের প্রতীক? পাখিটি পুর্নজন্ম, নিরাময়, ধ্বংসের পরও বেঁচে থাকার আকাঙ্খা এবং অমরত্ম তথা দীর্ঘ জীবনের প্রতীক। উপরোন্ত, ফিনিক্স পাখি শীতল কুয়ার ধারে বাস করত, সকালে আসত কুয়ার কাছে, গোছল করত, গাইত গান । এত সুন্দর পাখি আর এত সুন্দর তার কন্ঠস্বর যে সূর্যও নাকি সে গান শোনার জন্য থেমে যেত। পাখিটি কখনও আহত হলে নিজেই সারিয়ে তুলতে পারে। সূর্যর অস্ত যাওয়া ও উদয় হওয়া মানবজীবনের জীবন-মৃত্যুর রূপকও বটে। তবে জীবনদাতা সূর্য ও ফিনিক্স পাখি উভয়ই শান্তির প্রতীক। ভোর মানেই শান্তি। কোনও কোনও বলা হয়েছে ফিনিক্স বাস করত শিশির বিন্দুর ওপর (কী সুন্দর কল্পনা!) এবং কারও ক্ষতি করত না। বরং এর নিরাময় শক্তি ও অশেষ শক্তি দুর্ভোগের অবসান ঘটাত। আসলে মানুষ সারা জীবনই অমৃতসুধা খুঁজেছে। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে মিশরে ফিনিক্সপাখিটি সূর্য দেবতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সূর্যই পৃথিবীতে সম্ভব করেছে জীবন, যে জীবণ কল্যাণকর। যে কারণে, ফিনিক্স পাখি সূর্যের প্রতীক হওয়ায়, আগেও একবার বলেছি, ফিনিক্স পাখির ভাবমূর্তিতে অমঙ্গলের চিহ্ন বিন্দুমাত্র নেই। প্রাচীন মিশরে ফিনিক্স হল সূর্যর প্রতীক। আমরা জানি পৃথিবীর আয়ূ সূর্যের অবস্থানে জন্যই সম্ভবপর হয়েছে। কোনওদিন সূর্য ধ্বংস হলে পৃথিবীও ধ্বংস হবে। প্রাচীন মিশরের মানুষ এই তথ্যটি জানত? তারা চায়নি সূর্য ধ্বংস হোক। আমার মনে হয়, ফিনিক্স পাখির রুপায়নের মধ্য দিয়েই মানুষের এই ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটেছে।
তথ্যসূত্র: ফিনিক্স পাখি সম্বন্ধে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের প্রাপ্ত তথ্যাদি।