কল্পনা করুন, প্রাচীন দক্ষিণ রাশিয়া। কৃষ্ণসাগরের উত্তরের ক্রিমিয়া। ক্রিমিয়ার তুষারাচ্ছন্ন প্রান্তর। প্রান্তরের প্রান্তে পাইন বন। পাইনবনে নিঃসঙ্গ কিংবা দলবদ্ধ হরিণ। পুরুষ হরিণ। কেন যেন পুরুষ হরিণের প্রতি প্রাচীন শক জাতি গভীর শ্রদ্ধা পোষন করত; যা ওদের শিল্পকলায় প্রতিফলিত হতে দেখেছি। বিশেষ করে শকদের সমাধিসৌধের ভিতরে পুরুষ হরিণের প্রচুর সোনার মূর্তি পাওয়া গেছে।
শকরা মনে করত যে ঐ গতিশীল প্রাণিটি মৃতের আত্মার দ্রুতগামী বাহক।
গাঁজা এবং এটির সেবনের ইতিহাস নিয়ে যাদের ব্যাপক আগ্রহ আছে, তাদের প্রাচীন শক জাতির ইতিহাসটি জানা অতি জরুরি বলেই আমি মনে করি। কেননা, ইতিহাসের পৃষ্ঠা উলটিয়ে দেখলাম যে, শকরা বিপুল পরিমানে ওই উদ্ভিদজাত নেশা দ্রব্যটি সেবন করত এবং জিনিসটি তারাই মধ্য এশিয়া থেকে সংগ্রহ করে গ্রিসসহ প্রাচীন বিশ্বের সমঝদারদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল;
আসিরিয়রা ভালোবেসে গাঁজার নাম দিয়েছিল কুনুবু (মানে, যাহা ধোঁওয়া উৎপাদন করে) ...যার উৎকট গন্ধ থেকে শুদ্ধচারী মহান হিব্রু সাধকরাও রক্ষা পায়নি; উলটো উনারাও নাকি ধ্যানের অজুহাত দিয়ে নির্জনে ক্যানাবিস সেবন করতেন। গাঁজার ইংরেজি ক্যানাবিস শব্দটির উৎসও নাকি হিব্রু। আমি তো ক্যানাবিস শব্দটির মধ্যে প্রাচীন কেনান দেশ পাই। যাহোক। মানবসভ্যতার পরবর্তী প্রজন্মও এখনও পর্যন্ত স্বর্গীয় বস্তুটির (প্রাচীন বেদে গঞ্জিকাকে ‘ঈশ্বরের আহার্য’ বলা হয়েছে!) অমোঘ আকর্ষন কাটিয়ে উঠতে পারে নি। এসবই মানবসভ্যতায় শকদের মাহাত্ব্য। লেখাবাহুল্য, গাঁজা ছিল শক-সংস্কৃতির অন্যতম উপাচার। একালে আমরা কেউ কেউ গাঁজাকে যতই দুষিত মনে করি না কেন- শকরা কিন্তু পবিত্র হত গাঁজার ধোঁওয়ায় । বিশেষ করে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গাঁজা বীজের নানাবিধ ব্যবহার ছিল বাধ্যতামূলক। যস্মিন দেশে যদাচার ...
ধাবমান শক সৈন্য
তো কারা শক? শকরা ছিল মধ্য এশিয়ার অশ্বারোহী যাযাবর গোত্র; নিজেদের শকরা বলত Skudat। শকভাষায় এর মানে তীরন্দাজ। শকরা ছিল দক্ষ তীরন্দাজ । বিষমাখানো এবং কাঁটাযুক্ত তীরের প্রচলন নাকি তারাই করেছিল। যা হোক। কী কারণে পারসিকরা Skudat দের নাম দিয়েছিল শক। গ্রিকরা শকদের বলত Skythai আর চিনারা সাই। শকদের ইংরেজি Scythian (সিথিয়ান) ওই গ্রিক Skythai শব্দ থেকেই উদ্ভব।
প্রাচীন বিশ্ব
শকদের সভ্যতার সময়কাল ছিল ৮ম খ্রিস্টপূর্ব থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতকের আগে শকরা বাস করত মধ্য এশিয়ায় । তারপর তারা দক্ষিণ রাশিয়ায় মাইগ্রেট করে। এখন যেটা দক্ষিণ রাশিয়ায় ক্রিমিয়া (ইউক্রেনের দক্ষিণপুবে এবং কৃষ্ণসাগরের উত্তরে) সেখানে চলে আসে। শকদের মাইগ্রেশনের কারণ জানা যায়নি। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ? যাহোক। শকরা আদতে ছিল ইন্দো -ইরানি (এখন আর আর্য শব্দটি ব্যবহৃত হয় না) গোত্র। তবে প্রথম প্রথম তেমন সংগঠিত ছিল না। নিজেদের ভিতরে অর্ন্তদ্বন্দ ছিল। শখদের লিখিত ভাষা ছিল না। শকদের সম্বন্ধে জানার উৎস দুটো। (ক) গ্রিকদের লেখনি; (খ) সমাধি সৌধতে পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নদ্রব্য।
কৃষ্ণসাগরের উত্তরে ক্রিমিয়া
ক্রিমিয়া
কৃষ্ণসাগরের উত্তরে শকদের রাজ্য স্থাপন অবশ্য অত সহজে হয়নি। কেননা, দক্ষিণ রাশিয়ায় ছিল সিমেরিয় জাতির বাস । সিমেরিয়দের সঙ্গে শকদের ৩০ বছর যুদ্ধ হয়। শকরা অবশ্য সিমেরিয় দের পরাজিত করে। কারণ আছে। সিমেরিয় সৈন্যবাহিনীতে অশ্বারোহী সৈন্য ছিল না, তারা পায়ে হেঁটে যুদ্ধ করত।
শক রাজ্য
শকদের দ্বারা সিমেরিয় জাতির পরাজয়ের পর কৃষ্ণসাগরের উত্তরে খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে প্রথম শক রাষ্ট্রটির উদ্ভব ঘটে। শকদের রাজধানী ছিল বর্তমান ক্রিমিয়ার নিয়াপলিস। শকদের রাজ্যটি তারপর ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল কৃষ্ণসাগরের (প্রাচীন নাম পনটাস ইউক্সিনাস) উত্তর থেকে কাসপিয়ান সাগরের পূর্বপ্রান্ত এবং দক্ষিণের সিরিয়া অবধি।
শকদের সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শাব্দীর গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস। তিনি শকদের বলেছেন নিষ্ঠুর জাতি। কেন? কারণ শকরা শক্রর খুলিতে জল/মদ খেত। হিরোডোটাস-এর মন্তব্যে রাজনীতি আছে। হিরোডোটাস মনে করতেন, গ্রিকরা সভ্য, শকরা অ-সভ্য। নইলে শক্রর খুলিতে জল/মদ খায়। হিরোডোটাস এর আমলে গ্রিসে সমকামিতা ছিল প্রকাশ্য। এ বিষয়ে শকদের মন্তব্য কি ছিল কে জানে। অধিকন্তু, শকরা মূলত পারসিক (গ্রিকদের জাতশক্র) বলে মহাকবি হোমার শকদের ‘ঘোটকির দুধ দুইয়ে জাতি’ (মেয়ার মিলকারস) বলেছেন। যা হোক। শকদের গাঁজা সেবনের কথাও লিখেছেন হিরোডোটাস। শকরা শক্রর খুলিতে জল/মদ না খেলেও গাঁজা যে খেত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। একটি শক সমাধি সৌধর অভ্যন্তরে ব্রোঞ্জের কড়াইয়ে ভিতর পাওয়া গেছে গাঁজার বীজ। গাঁজা আর শকদের সম্পর্ক নিয়ে আগেই অল্পবিস্তর বলেছি।
শকিয় মিথানুযায়ী শকেদের উদ্ভব হয়েছিল তিন ভাই থেকে। এদের নাম যথাক্রমে লিপোক্সাইস, আরপোক্সাইস এবং কোলাক্সাইস। তাদের সময়ে আকাশ থেকে নাকি লাঙল ষাঁড় ও কুঠার পড়েছিল। ওসব ছিল সোনার তৈরি। বড় ভাই সেসব একাই নিতে গেলে ওগুলো গনগনে আগুনের মতো হয়ে উঠল। মেজ ভাইও ওসব একাই নিতে গেলে ওগুলো গনগনে আগুনের মতো হয়ে উঠল। এরপর ছোট ভাই নিতে গেলে আগুন গেল নিভে; কাজেই সে স্বর্গীয় সোনার উপহারগুলি নিতে পারল । বড় ভাই আর মেজ ভাই ছোট ভাইকে রাজা করল। রাজা স্বর্গীয় লাঙল ষাঁড় ও কুঠার দেখেশুনে রাখল। বার্ষিক বলিদানের আয়োজন করল। যা হোক। এটা শকিয় মিথ। বাস্তব গবেষনায় জানা গেছে শক-সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার নাম সম্রাট কোলোসাকাই। শখদের সম্রাটের পদবি ‘শখ প্রধান’ ( দি রয়েল সিদস); তিনি ছিলেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। দি রয়েল সিদস-এর মৃত্যুর পর ছেলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হত। স্থানীয় গোত্রপতিকে ঘিরে ছিল অভিজাত শ্রেণি। যাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বিশাল সাম্রাজ্যে নির্মিত হয়েছিল বানিজ্যপথ।
প্রাচীন শক দেওয়ালচিত্র; যাতে পড়েছে শকজীবনের প্রতিফলন
তবে মানুষের অতীত খুব একটা পরিচ্ছন্ন নয়। শকরা রাষ্ট্রীয়ভাবে দাস ব্যবসা করত। গ্রিক নগররাষ্ট্রে দাস সরবরাহ করত। আশেপাশের রাজ্য থেকে মানুষজন অপহরণ করে গ্রিক নগররাষ্টে যোগান দিত এবং বিনিময়ে চাহিদা মোতাবেক জিনিসপত্র নিত। শকরাষ্ট্রটি গোত্রতান্ত্রিক হওয়ায় দাসশ্রমের তেমন প্রয়োজন ছিল না। শকরা দাসব্যবসার পাশাপাশি গাঁজার ব্যবসাও করত সম্ভবত । শুরুতে আমি বলেছি যে গাঁজা জিনিসটি শকেরাই মধ্য এশিয়া থেকে সংগ্রহ করে গ্রিসসহ প্রাচীন বিশ্বের সমঝদারদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। তবে লাভ কেমন হত কে জানে!
শক ধনুক
শক সৈন্যের ভঙ্গিমা
শকরা ছিল অত্যন্ত যুদ্ধপ্রিয় জাতি। বারবার এরা রোমান সাম্রাজ্য তছনছ করেছে। অধিকৃত অঞ্চলে করারোপ করত তারা। শক সৈন্যরা ছিল ফ্রিম্যান অর্থাৎ মুক্ত পুরুষ, মানে, দাশ নয়। তবে শক সৈন্যরা মজুরি পেত না, পেত শুধু খাবার ও পোষাক; লুটের মালের ভাগও পেত অবশ্য।
সৈন্যরা ব্রোঞ্জের হেলমেট পরত। শকদের প্রধান অস্ত্র ছিল তীরধনুক। শকদের তলোয়ার দেখতে ছিল অনেকটা পারস্যের তলোয়ার এর মতোই। চাঁদের আকারের কাস্তের ইংরেজি শব্দ ওই শক শব্দ থেকেই এসেছে। কাস্তে নারীরা যুদ্ধে ও কৃষিতে ব্যবহার করত। পুরুষের পাশাপাশি নারীরা যুদ্ধ করত।
শক নারীযোদ্ধা।
মঙ্গোলিয় পনি। শকরাই মানবসভ্যতার প্রথম অশ্বারোহী, যাদের গতিময়তা অন্যদের বিস্মিত করত। শকদের ঘোড়াগুলি ছিল মঙ্গোলিয় পনি।ঘোড়াকে কেন্দ্র করে আবতির্ত হত শক-জীবন। মনে থাকার কথা হোমার শকদের অবজ্ঞাভরে বলেছেন ঘোটকির দুধ দুইয়ে; অর্থাৎ মাদী ঘোড়া দুধ দোহন করে! তবে ঘোড়ার জিন ছিল না।
কুরগান
প্রাচীন মিশরের মতোই শকরা সমাধি সৌধ নিয়ে আচ্ছন্ন ছিল। শকদের সমাধি সৌধকে বলা হত কুরগান। কুরগান আসলে সমাধিস্তুপ । মাটি থেকে ২০ মিটার অবধি উঁচু হত। সমাধি সৌধের ভিতরে স্বর্ণের অলংকৃত জিনিসপত্র দক্ষিণ রাশিয়ায় ও ক্রিমিয় সীমান্তে পাওয়া গেছে। গ্রিকদের সংস্পর্শে এসে শকরা সোনার কাজ শিখেছিল। সোনা পেত অভিনব উপায়ে। নদীতে ঘোড়ার চামড়ার তৈরি জাল ফেলে রাখত। নদীতে ভেসে আসা সোনা পরে চামড়া পুড়িয়ে সোনা পেত।
শক টাট্টু
শখ রাজাদের সমাধিতে ঘোড়াবলি দিত। কখনও কখনও নাকি মানুষও। শখ রাজাদের সমাধিসৌধ খুঁড়ে প্রচুর ঘোড়ার কঙ্কাল পাওয়া গেছে। ঘোড়াকে কেন্দ্র করে আবতির্ত হত শক-জীবন। কাজেই শকরা কেন ঘোড়াই বলি দিত তা আমার বোধগম্য হল না। প্রিয় বলে? যা হোক। রাজা মারা গেলে মৃতদেহ নিয়ে শোকার্ত প্রজারা চল্লিশ দিন রাজ্যে ঘুরত। তারপর রাজাদের সমাধিতে ঘোড়াবলি দিত। গাঁজার বীজ পোড়াত। আগেই একবার আমি বলেছি যে ... বিশেষ করে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গাঁজার বীজের ব্যবহার ছিল বাধ্যতামূলক। এবং রাজার স্ত্রীরা, দাসদাসী এবং রাজার পেয়ালাবাহকরা রাজার সঙ্গে পরলোকে যেতে বাধ্য থাকত। অর্থাৎ তাদের কুরগানে জ্যান্ত সমাধিস্থ করা হত। বড় জানতে ইচ্ছে করে আমার- খুনি রোমহর্ষক পরকালযাত্রার চিন্তার উৎস কি! প্রাচীন চিনে দেখেছি এরুপ কুপ্রথা, মিশরে তো ছিলই -নির্বোধ শকেরাও ...
সোনার শকশৈলী
শখদের মহাদেবীর নাম ছিল তাবিটি হেসটিয়া। তিনি ছিলেন আগুনের ও পশুর দেবী। মহাদেবীর এক হাতে জীবন বৃক্ষ- ছালার ওপর আঁকা এমন একটি চিত্র সমাধিসৌধের ভিতরে পাওয়া গিয়েছে। মহাদেবীই শকদের একমাত্র দেবী; যিনি ছিলেন গ্রিকদেবী আর্তেমিস এর সমতূল্য। শকদের ধর্মটি ছিল প্রাচীন পারস্যের জরথুশত্র-পূর্ব ধর্মীয় বিশ্বাস অনুরুপ এবং জরথুশত্রর ধর্মের সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল না।
শক শিল্পীদের আঁকা ধর্মীয় চিত্র
শকদের সাম্রাজ্যটি প্রায় হাজার বছর অক্ষুন্ন ছিল। মনে থাকার কথা: শকদের সভ্যতার সময়কাল ছিল ৮ম খ্রিস্টপূর্ব থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী। ২০০ খ্রিস্টাব্দে সারমাটিয়ানরা শখদের পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।
এককালে শকজাতির উত্থান এখানেই হয়েছিল
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:১৪