পুলিশী হেফাজতে মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানে চলছে হিজাব প্রটেস্ট, রাস্তায় নেমেছে হাজার হাজার নারী পুরুষ। জোর পূর্বক চাপিয়ে দেয়া হিজাব রাস্তায় রাস্তায় পুড়ছে নারীরা। ক'দিনের হিসাবে মারা গেছে কমপক্ষে ৩১ সাধারন জনগন। গত সাপ্তাহে হিজাব বা রাস্ট্রের নির্ধারিত পোষাক না পড়ার কারনে গ্রেফতার হোন ২২ বছরের আমিনি। তার কয়েক ঘন্টা পর পুলিশী হেফাজত থেকে হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে এবং তিনদিন কমায় থাকার পর মৃত্যু্বরণ করেন মাহসা আমিনি। ধারনা করা হচ্ছে পুলিশ তাঁর মাথায় আঘাত করেছে যার কারনেই তার মৃত্যু হয়েছে। যদিও আর সব স্বৈরাচারী শাসকের মতো নিজেদের গা বাঁচাতে একটা এডিটেড ভিডিও মার্কেটে ছাড়া হয়েছে যা আরো অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং বন্ধ করে দিয়েছে সকল সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টগ্রাম...।
১৯৭৯ থেকে ইসলামী শাসনের পর থেকেই ইরানে রাস্ট্রীয়ভাবে নারীর পোষাক নির্ধারন করা হয়, হিজাব পড়া যাতে চুল দেখা না যায়, ঢিলাঢালা পোষাক পড়া যাতে শরীরের কোন ভাজ দেখা না যায়, লম্বা পাজামা পড়া যাতে পা দেখা না যায়। এবং শুধুমাত্র মেয়েরা পোষাক ঠিকভাবে পড়েছে কিনা তার জন্য একদল পুলিশবাহিনী রাখা হয়েছে যাদেরকে মরালিটি পুলিশ বা "Gasht-e Ershad" (Guidance Patrols) বলে। এসব পুলিশ প্রপার ক্লোথিং এর নামে বা তাদের পছন্দ না হলে যখন তখন যেকোন মেয়েকে জেল, জরিমানা বা মারধর করার ক্ষমতা রাখে। এরকম রাস্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনেকবারেই ফুঁসে উঠেছিল সাধারন নারীরা কিন্তু এবারের আন্দোলনে জ্বলছে পুরো ইরান। নারীর সাথে রাজপথে নেমে এসেছে সাধারন মানুষও।
একটি রাস্ট্র বা একটি সমাজ যখন নারী শরীরে নির্ধারিত পোষাক জোর করে করে চাপিয়ে দেয় তখন বুঝতে হবে আসলে তারা নারীদের ভয় পাচ্ছে। কোনভাবেই তাদেরকে সামনে আসতে দিতে চায় না, যেভাবেই হোক তাদেরকে টেনে ধরতে চায়। যার কারনে পর্দার আড়ালে, পোষাকের নামে, ধর্মীয় শিক্ষার নামে তারা নারীদের দমিয়ে রাখতে চাচ্ছে যাতে মেয়েরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, তাদের কাজের প্রতিবাদ করতে না পারে। মেয়েদেরকে দমনের এটা একটা কৈাশল মাত্র যা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
একটি মেয়ে যদি তাদের পছন্দের পোষাক পরে তাহলে রাস্ট্র, সমাজ বা পুরুষশ্রেনীর কেন সমস্যা হয় যুগ যুগ ধরে। মেয়েদের পাপের বোঝা তো পুরুষদের বহন করতে হবে না। মেয়েরা পোষাক পড়লো নাকি পোষাক খুলে হাটলো সেটা একান্ত তাদের ব্যাপার। তোমার দেখতে ভালো লাগলে সে দিকে তাকাবে না। তোমার নোংরা মন সেদিকে ছুটলে সেটা কন্ট্রোল করার দায়িত্ব তোমার। তোমার নোংরা মানসিকতাকে, তোমার দূর্বলতাকে ঢাকতে মেয়েরা কেন তোমার পছন্দমত পোষাক পড়বে???
ঠিক একইভাবে আমাদের দেশেও চলছে একই অরাজকতা। আমাদের রাস্ট্র নয়, আমাদের সমাজ নির্ধারন করে দিচ্ছে মেয়েদের পোষাক। আমি আমার নানীকে দাদীকে বা মা'কে ও বোরকা পড়তে দেখিনি। আমি যখন ঢাকা উইনিভার্সিটিতে পড়তাম তখন মাত্র একজন বোরকা পড়তো। আর এখন চারপাশে অসংখ্য হিজাবধারী। আমি জানতে চেয়েছিলাম হঠাৎ দেশে কেন এরকম পরিবর্তন? মেয়েরা কি কারনে হঠাৎ ধার্মিক হয়ে গেছে?
উত্তরটা আমি নিজেই দেয়ার চেস্টা করেছি। কেউ হয়তো এক মত হবেন, কেউ নয়। যেমন;
- আফসানা কলেজে পড়ে। বাসা থেকে কলেজে যেতে আসতে বাস রিক্সা হাটা সবই করতে হয়। এরই মাঝে বেশ ক'বার বখাটের হাতে নাজেহাল হতে হয়েছে। তাই হিজাব পড়া শুরু করেছে এসব বখাটেদের হাত থেকে বাঁচতে।
- রুবিনা চাকরী করে। আশেপাশের কিছু সহকর্মী বা পরিচিতদের অশ্লিল কথাবার্তার আভাস পেয়ে ভয়ে হিজাব পরা শুরু করেছে।
- মায়ার সব বান্ধবী হিজাব পরে, তাই সেও হিজাব শুরু করেছে।
- জারিন কলেজে উঠেই হিজাব ধরেছে কারন হিজাব ছাড়া বিয়ের বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায় না।
- খালেদা হিজাব পড়া শুরু করেছে বিয়ের পর কারন তার তার স্বামী তাকে বাধ্য করেছে। স্বামীর কথা, বিয়ের আগে যথেস্ট রঙঢঙ করেছো এবার হিজাব ধরে আল্লা আল্লা করো, পর পুরুষকে শরীর দেখানোর দরকার নাই।
- মা-বাবার জোড়াজুড়িতে মায়া হিজাব পড়া শুরু করেছে কারন পাড়া প্রতিবেশী আন্টিরা সকাল বিকাল তার মায়ের কানে উল্টাপাল্টা বলেই যাচ্ছে।
- তিথি নিজ থেকেই হিজাব পড়া শুরু করেছে কারন শরীর ঢেকে রাখতে তার ভালো লাগে।
এভাবেই আমাদের সমাজ আস্তে আস্তে মেয়েদের উপর চেপে বসছে এ সমাজ বা তথাকথিত পুরুষেরা। ধর্ষণের কারন হিসেবে প্রথমেই দায়ী করে ধর্ষিতার পোষাককে, সাফ ফুটবলে মেয়েদের সাফল্যের খবরের উল্লাসিত জনগনের পাশাপাশি কিছু মানুষের চোখ চলে যায় তাদের হাফপ্যান্ট পড়া পায়ের দিকে। ভালো মেয়ে খারাপ মেয়ের পার্থক্য তৈরী হয় হিজাবের ভিত্তিতে, হিজাব পড়লে ভালো মেয়ে আর না পড়লে খারাপ মেয়ে!
কারন, ওই যে আগেই বল্লাম, প্রচন্ড ভয় পায় মেয়েদেরকে, মেয়েদের ক্ষমতাকে, তাদের অধীনস্ততাকে, তাদের বুদ্ধিদৃপ্ত পদক্ষেপকে। আর তাইতো ওয়াজ মাহফিল থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়াকে সবখানেই মেয়েদের দমনের চেস্টা করে যায় এরা। যত দমন করতে পারবে ততই দাস বানাতে পারবে, ততই তাদের শোষন করতে পারবে।
কখনই বলিনা হিজাব খারাপ বা ইসলামী পোষাক পড়ো না। শুধু বলা, পোষাক একান্তই যার যার নিজস্ব বিষয়। কে কিভাবে পোষাক পড়বে সেটা তার ব্যাক্তিগত পছন্দ। এখানে রাস্ট্র সমাজ নামধারী দ্বিতীয় তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ মোটেও কাম্য নয়।
সবাই ভালো থাকুন আর ভালো থাকুক ওপারে মাহসা আমিনি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ ভোর ৬:৫৩