ক'দিন আগে কানাডার ডেইলি পত্রিকার একটা নিউজ দেখে কতক্ষন হাসলাম, ঘটনা এমন, ট্রেনে এক ভদ্রলোক পাশের সিটে পা তুলে বসেছিলেন। তো আরেক ভদ্রমহিলা তাকে পা নামিয়ে বসতে বললেন কিন্তু ভদ্রলোক শুনলেন না। অতপর: মহিলা প্রথমে তার পায়ের উপর বসে পড়লেন তারপর যথারীতি ঝগড়া করলেন ও শেষে সাবওয়ের পুলিশ কল দিলেন। ভদ্রমহিলাকে প্রশ্ন করা হলো কেন তিনি এমন কাজ করলেন? উনি উত্তর দিলেন এটা পাবলিক ন্যুইসেন্স যা তার ফ্যামিলি তাকে শিখাতে ব্যার্থ হয়েছে তাই আমি মনে করি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তাকে শেখানোর দায়িত্ব আমার। এখন কথা হলো যদি ফ্যামিলি কিছু শিখাতে ব্যার্থ হয় তাহলে এমনভাবে নাস্তানাবুদ হয়ে পাবলিকই আপনাকে শিখাবে ।
যা বলছিলাম... পাবলিক ম্যানার্স এন্ড এ্যাটিকেট। সোজা বাংলায় সামাজিক ভদ্রতা। আমরা ঘরে যেভাবে যেমনভাবেই থাকি কোন সমস্যা নেই.. বাবা-মা, ভাই-বোনদের সাথে যেভাবে কথা বলি, যেভাবে বাসায় ডাইনিং টেবিলে খেতে বসি, যেভাবে মোবাইল উইজ করি তবে তা পাবলিকলি করতে সামাজিক ভদ্রতা অবশ্যই বজায় রাখা উচিত। যখন বিদেশে থাকি বা দেশের প্রতিনিধি হয়ে দেশের বাইরে যাই তখন আমাদের এ ছোট ছোট পাবলিক ম্যানার্স এন্ড এ্যাটিকেট গুলো আর পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না সেটা পুরো দেশের সন্মানের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। কারন দেশের বাইরে আমরা শুধু নিজের পরিবারে নয় দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি । তাই এমন কোন আচরন করা উচিত না যা দেশের মান-সন্মান ধরে টান দেয় সেটি খাবার হোক, ড্রেস কোড হোক বা সাধারন বিহেব হোক।
যেমন খুব সাধারন একটা পাবলিক ম্যানার্স হলো মোবাইল ম্যানার্স। হাটে মাঠে ঘাটে বাসে অফিস আদালত যেখানেই আমরা মোবাইলে কথা বলি তখন উচ্চ মোবাইল রিং টোনের সাথে উচ্চ স্বরে এমনভাবে কথা বলি যেন আশে পাশের সবাইকে জানিয়ে দেই যে আমি খুবই গুড়ুত্বপূর্ণ একজন লোক। এমনকি ৩০ মিনিটের মিটিং বা সেমিনারে, অফিসিয়াল বা পারিবারিক অনুস্ঠানে আমাদের মোবাইল বেজে উঠে কম করে ১০ বার। প্লিজ, আপনি এমন কোন কেউকাটা বা ডন ইব্রাহীম না যে আপনার মোবাইল প্রতি মিনিটে একবার চিৎকার দিয়ে উঠবে। সেমিনার বা মিটিং এর কিছু গুড়ুত্বপূর্ন স্থানে যেখানে একান্ত নিরবতা দরকার সেখানে কিছুক্ষন মোবাইল বন্ধ রেখে বা ভাইব্রেটে রাখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না, পৃথিবীর চাকা যেটা আপনি ঘুরাচ্ছেন সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে না..বাজি ধরেন!!! আমি দেশের বাইরের অফিস, সেমিনার, মিটিং, ট্রেন-বাস, মার্কেট, রাস্তা কোথাও উচ্চস্বরে মোবাইল বাজতে বা কথা বলতে শুনিনি। তো তাই বলে কি ওরা সব বোবা কালা !!!!!!! কোন কথা বলে না ?? না ওরা বোবা না, ওরা অনেক কথা বলে তবে আপনাকে ডিস্টার্ব করে নয়, খুবই আস্তে বলে যাতে যাকে বলছে সে ছাড়া অন্য কেউ না শুনতে পায়... অন্য কেউ যেন ডিস্টার্ব ফিল না করে। আর রিং টোন.... অবশ্যই আছে তবে তা আস্তে অথবা সাইলেন্ট মুডে।
এবার আসি পাবলিকলি খাওয়ার এ্যাটিকেট। আগেরদিনে বাংলা সিনেমায় দেখতাম কম করে একটা খাওয়া-দাওয়ার সিন থাকতো (এখনকার ছবি দেখিনি তাই বলতে পারছি না)। সেখানে নায়ক বা তার বন্ধুরা হাফুস হুফুস করে গোগ্রাসে খেতো। এখন যদি এমন দৃশ্য আপনি বাস্তবে দেখেন তখন কি একটু এমব্রেস ফিল করবেন না? একটা ব্যাক্তিগত ঘটনা শেয়ার করি... একটা ইর্ন্টান্যাশানাল কনফারেন্সে বাঘা বাঘা লোকদের সাথে দূর্ভাগ্যক্রমে আমি ও ইনভাইটেশান পেয়েছিলাম সুইজারল্যান্ড সফরের। বাংলাদেশ থেকে সরকারীভাবে ও বেসরকারীভাবে আমরা কয়েকজন ছিলাম। যেহেতু এটি ইর্ন্টান্যাশানাল কনফারেন্সে আর ৫ ইয়ার্স হেলথ্ প্লান তাই পৃথিবীর সেরা মাথাগুলাই এসেছিল। তাই আয়োজক সুইস সরকার সর্ব্বোচ্চ আয়োজনের চেস্টা করেছিল খাবার থেকে শুরু করে সবকিছু সুন্দরভাবে করার। লান্চ, দু'বেলা স্ন্যাক্স ছাড়াও আয়োজক কমিটি প্রতিটি কর্নারে চকলেট, চিপস্, ড্রিংস, চা, কফি, জুস রেখেছিল। যে যার মতো খাবারের সুযোগ থাকলেও অন্য কোন দেশের লোকজন চা-কফি ছাড়া কিছুই ধরছিল না পুরোটা সময়.... সম্পূর্ন মনোযোগ ছিল লেকচারের উপর। কিন্তু আমাদের টিমের কয়েকজন ভাই-আপুর আচরন দেখে মনে হলো এমন খাবার জীবনে ও চোখে দেখেনি....!!! হামলে পড়া বলতে যা বোঝায় তা প্রাকটিকেল দেখাচ্ছিল। সারা সময়টাতে ৫ মিনিট পর পর উঠে আর প্লেট ভর্তি, গ্লাস ভর্তি করে আনছিল... শেষ করে আবার যায়। তারপর ও শেষ নেই, লাঞ্চের সময়ে প্লেটে যতটুকু খাবার ধরে তার ৫ গুন খাবার নিল এবং এসব আধা কাচাঁ খাবার একটু আকটু মুখে দিয়ে ফেলে দিল। অথচ তাদের ছাড়া অন্য কারো প্লেটেই অবশিষ্ট কিছু দেখলাম না। শুধু যে বিদেশে তা নয় দেশে ও যখন বিভিন্ন লান্চ সমৃদ্ধ সেমিনারে যাই সেখানেও দেখেছি কিছু মানুষ যেভাবে প্লেটে খাবার নেয় বিশেষ করে বুফে সিস্টেমে দেখে মনে হয় সাত দিনের উপোস। তাই যা পারি তা নিয়ে নেয় একসাথে নতুবা যেন ভাগ পাবো না এবং শেষে দেখি যথারীতি চার ভাগের তিনভাগ উচ্ছিস্ট করে। ঘরে বা পারিবারিক অনুস্ঠানে আমরা কম বেশি খাই, দরকার হলে একটু পকেটের পয়সা খরচ করে আরো কিছু খাবো কিন্তু যেখানে দেশের দশের সন্মান জড়িত সেখানে কি একটু এ ম্যানার্সগুলো ভাবা উচিত নয় কি !
ইদানিং আমি কোন দাওয়াতে সবার শেষে হাজিরা দেই... আগে উপস্থিত কাউকে ফোন করে জেনে নেই অনুস্ঠানের সবচেয়ে গুড়ুত্বপূর্ন অংশটি শেষ হয়েছে কিনা মানে ছবি তোলা।. কারন এখন সব অনুস্ঠানেই হোস্ট এবং গেস্ট রান্না-বান্না করার পর খাবার সাজিয়ে-গুজিয়ে কয়েক ঘন্টা ধরে সে খাবারের বিভিন্ন এঙ্গেলের ছবি তুলবে, সব গেস্টকে সামনে দাড়ঁ করিয়ে আরেকদফা ছবি... তারপর সেটা ফেসবুকে পোস্ট দিবে ও বাকিটা সময় ছবিতে মন্তব্য করে সময় কাটাবে। অবস্থা দেখে মনে হয় দাওয়াত এর মূল উদ্দেশ্যই ফেসবুকে পোস্ট দেয়া !! শুধু দাওয়াত না ফেসবুকে যেভাবে রেস্টুরেন্টে বসে খাবারের সাথে আমার হাবির সাথে কিংবা আমার সুইট হার্টের সাথে বিভিন ভঙ্গিমায় ছবি দেখি (অনেক নতুন ওয়ার্ড এখন ডিকশেনারীতে যোগ হয়েছে যেমন হাবি=হাজবেন্ড, সুইটি=ওয়াইফ, জিএফ=গার্লফ্রেন্ড, বিএফ=বয়ফ্রেন্ড) তাতে মনে হয় বে পৃথিবীর সব প্রেম মনে হয় ফেসবুকের ছবির মাঝে... মজার ব্যাপার হলো এদের অনেকেই সকাল বিকালচুলাচুলি করে, তাদের ঝগড়ার যন্ত্রনায় কাক পক্ষীও আশেপাশে আসতে পারে না... এবং তারপর সেজে গুজে ছবি পোস্ট দেয়......ক্যাপশান: চাঁন্দি রাতে ওর সাথে । ফেসবুক বা স্যোসাল মিডিয়াতে ছবি পোস্ট বা ফেসবুক খারাপ কখনই আমি তা বলি না কারন সোস্যাল এ মিডিয়ার কল্যাণেই দূরে থেকেও সবার মাঝে থাকা যায় .....কিন্তু ওই যে বাড়াবাড়ি যেটা আমরা করি সেটা যদি একটু দেখেশুনে করা যায় এই আর কি।
যাহোক ফেসবুকে ছবি পোস্ট দিতে সমস্যা নেই কিন্তু তাতে যখন খুব বিরক্তিকর মন্তব্য করা হয় বা অন্য কোন দেশের সেলিব্রিটির পেজে বাজে মন্তব্য করা হয় তখন কিন্তু সেটা দেশের সন্মান ও জড়িত হয়ে পরে। যেটা আমরা করি অনেকটা না বুঝেই কারন শেখার আগেই টেকনোলজি আমাদের গ্রাম পর্যায়ে পৈাছে গেছে। তাই বড় একটা অংশ জানেই না কিভাবে অন্যের সন্মান রেখে মন্তব্য করতে হয়। আর এখনতো গ্রামের মাঠ পর্যায়ের মুজুর, কাজের বুয়া, রিক্সাওয়ালা সবারই একটা করে ফেসবুক এ্যাকাউন্ট আছে... নেটওয়ার্ক নেটওয়ার্ক নেটওয়ার্ক..... আমরাইতো শিখিয়েছি তাদের তাই নয় কি। কিন্তু নেটওয়ার্ক কি, কেন দরকার নেটওয়ার্ক, কিভাবে কাজে লাগানো যাবে বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক? এসবের কোন খোঁজ নেই শুধু নেটওয়ার্ক শব্দটাই আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই ছুটছি আমরা এর পিছনে। নেটওয়ার্ক এর জন্য দরকার ফেইসবুক টুইটার ইন্সট্রাগ্রাম এ্যাকাউন্ট আর বিশ্বব্যাপী ফ্রেন্ড.... তাই ঢালাওভাবে পাঠাও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, এ্যাকেসেপ্ট করো, বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক গড়ো আর যাচ্ছে তাই মন্তব্য করো। আর এর জন্য কোন শিক্ষার দরকার নেই ফেইসবুক চালাতে পারলেই হলো, খেলাধুলার দরকার নেই সেলফি তুলে পোস্ট করলেই হলো, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেটা বোঝার দরকার নেই মন্তব্য করতে পারলেই হলো আর তার জন্য দরকার হাই স্পিড মোবাইল ইন্টারনেট ও বেরিয়ার ফ্রি নেটওয়ার্ক। এবার টাকা ঢালো কিনো মোবাইল নেট কিন্তু এ টাকা কোথা থেকে আসছে, কিভাবে টাকা জোগাড় হবে সেটা কোন মূখ্য বিষয়ই নয়... চুরি করে, ছিনতাই করে, স্মাগলিং করে, ঘুষ খাও। টাকা চাই শুধুই টাকা আর টাকা....। ফোর জি টেন জি নেট থাকাটাই মূল বিষয়, ফেইসবুক টুইটার ইন্সট্রাগ্রাম এ্যাকাউন্ট থাকাটাই বড় কথা আর উল্টাপাল্টা মন্তব্য করাটাই সবচেয়ে স্মার্টনেস। এরপর সমানতালে ছবি তোল, পোস্ট করো, মন্তব্য করো... পুরো জীবনটাতো এ ফেসবুক টুইটার এর মধ্যেই এখন আটকে আছে। হাঁ... এটা হবে না কেন আমরা কিছু কর্পোরেট বেনিয়ারইতো সেটা চেয়েছি ... তাদের হাতের পুতুল সবাই। যখন চাইবে, যেভাবে নাচাবে, সেভাবেই নাচবো ...তাই নাচছি আমরা.... নাচছে পুরো দেশ..... ।
বি:দ্র: লিখাটা এ্যালাইমনাই এর ম্যাগজিনে আগে দিয়েছিলাম, এখন ঘষেমেঝে সামুতে দিলাম।
এবার উৎসর্গের পালা : কিভাবে যে বেলায় বেলায় এতােবেলা হয়েগেল সামুতে বুঝতেই পারিনি। মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ করে সামুতে ঢুকি না তারপরও সব রাগ ভুলে আবার ফিরে আসি কারন এমন কিছু অসাধারন লেখক আছেন যাদের লিখা না পড়লে ভালোলাগে না... তারা আসলেই ইউনিক। তেমনি ক'জন......................... জ্ঞানী ব্লগারবৃন্দ... আহমেদ জী এস, ডঃ এম এ আলী, মাঈনউদ্দিন মইনুল, আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম, গিয়াস উদ্দিন লিটন, জাফরুল মবীন ( উনি ও নিখোঁজ এখন), মোস্তফা কামাল পলাশ, মানবী সহ অনেকে, অসাধারন ভ্রমণ ব্লগার জুন, বোকা মানুষ বলতে চায়, সাদা মনের মানুষ সহ অনেকে, কাব্যিক ব্লগার সেলিম আনোয়ার, সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, বিদ্রোহী ভৃগু, ও ছন্দের যাদুকর প্রামাণিক, কি করে আজ ভেবে না পাই, সায়মা... এছাড়া ও আছেন গল্প সাহিত্যিক ব্লগার হাসান মাহবুব, অপু তানভির ....... সবার নাম উল্লেখ করতে হলে সারাদিন পার হবে...... আশা করবো তারা সবসময়ই সাথে থাকবেন ব্লগের সুখে ও দুখে........... সবসময়।
ভালো থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২১ ভোর ৬:৩৩