ওই লোকের জায়গায় আমি থাকলে হয়তো রংপুরের দুর্ঘটনা আজ ঘটতো না:
১) মিশরে যখন ছিলাম তখন প্রায়ই গভীর রাতে মাইক্রোবাসে চড়া হত। আর রাতের কায়রোর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য অধি কাংশ সময়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতাম। মিউজিকের তালে তালে ১৩০/১৪০ কিমি গতিতে যখন মাইক্রোবাস চলতো তখন মাঝেমাঝে গাড়ি দোলা দিতো। সেই দোলা খুব ভাল লাগতো। কিন্তু যেহেতু গভীর রাত সেহেতু ড্রাইভারের গতিবিধির উপর সব সময়েই নজর রাখতাম। যদি কখনো কোন ড্রাইভারকে ঘুম ঘুম চোখে দেখতাম তখন ড্রাইভারের সাথে সারাক্ষন কথা বলতাম। একের পর এক কথা উঠায়ে তাকে বিজি রাখতাম যাতে ঘুম চলে না আসে। কখনো যদি দেখতাম ড্রাইভার বেশি কথা বলতে চাচ্ছে না, তখন বিষয়টা আরো ভয়ঙ্কর মনে হতো। এর মানে ড্রাইভারের চোখে ঘুম/তন্দ্রার পরিমান বেশি কাজেই কথা বলার রুচি নাই, এবং এইটাই আমাদের যাত্রীদের জন্য বেশী ভয়ের কারণ। তখন আমি জোরে জোরে বলে উঠতাম এই তুমি ঘুমাইতাছ কেন? চোখে পানি দিয়ে আসো, চোখে পানি দিয়ে আসো। এইভাবে যতখন ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে চোখে মুখ ধুয়ে পরিস্কার করে না আসতো ততক্ষন আমি চেচামেচি করতাম এবং গাড়ীর অন্যান্য যাত্রীদের মনযোগ আকর্ষন করতাম। ড্রাইভার ঘার তেরা হলে তখন বাকি যাত্রীদের জানায় দিতাম আর বলে দিতাম ড্রাইভার ঘুমে ঘুমে গাড়ি চালাচ্ছে, আমি চোখ ধুইতে কি ধোয় না। তখন সবাই মিলা বললেই ড্রাইভার ঘুম না আসলেও বাধ্য় হয়ে চোখ মুখ ধুয়ে একটা সিগারেটে টান দিয়ে আবার ড্রাইভিং শুরু করতো। এমন পরিস্থিতি আমি অনেক সৃষ্টি করেছি। তাই আমি দেশে আসলেও কখনো রাতে গাড়িতে চড়তে হলে ড্রাইভারের পাশে বসার চেষ্টা করি। যাতে ড্রাইভারের দিকে নজর রাখা যায়।
২) আজ রংপুরে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী বলেছে তাদের গাড়ীর ড্রাইভার নাকি ঘুমাচ্ছিলো। নিউজটা পড়ে আমার মিশরের ওই দিন গুলির কথা মনে পরে গেল। ওই ড্রাইভারকে ঘুমাতে দেখা লোকটির জায়গায় আজ যদি আমি থাকতাম হয়তো দুর্ঘটনা হত না। কারন, আমি যদি একবার দেখতাম ড্রাইভারের চোখে ঘুম তাহলে আমি কখনই ড্রাইভারকে আর ঘুমাইতে দিতাম না, বা ঘুমন্ত অবস্থায় গাড়ি চালাতে দিতাম না। ড্রাইভারকে ঘুমাতে দেখা ওই লোকটি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না, তাই তিনি যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারেন নাই, বা নিতে চান নাই বা নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। হয়তো বা তিনি মনে মনে ড্রাইভারকে ঘৃনা করেছেন কিংবা কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু লজ্জায় বলতে পারেন নই। আর এই লজ্জার কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। আমাদের দেশের সচেতন কেবল আপুর উড়না (আপু আপনার উড়না হোন্ডা /রিক্সার চাক্কায় পেচাইলো) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। অর কথাও এই সচেতনতা দেখা যায় না। চোখের সামনে নেতারা এসে গরিব দোকানদারের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে যাচ্ছে, কেউ কিছু কয় না। রিক্সাওয়ালাকে বখাটেরা মারছে কেউ কিছু কয় না, একাকী মেয়েকে টিজ করছে কেউ কিছু কয় না, ব্যাংক লোট হয়ে যাচ্ছে কেউ কিছু কয় না, সর্বোপরী দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কেউ কথা কয় না।
এই কথা না কওয়া রোগ বা অসচেতনতা থেকে মুক্ত হতে হবে সবার, ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হবে ঘুমন্ত সকলকে। ড্রাইভারকে, শিক্ষককে, ধুপাকে কিংবা প্রয়োজনে সরকারকে। মানুষ যত বেশি সচেতন হবে তত বেশি দুর্ঘটনা থেকে মুক্তি পাবে। সেটা বাস প্লেন নৌকা হোক, কিংবা হোক কোন বিল্ডিং কিংবা রাষ্ট্র ধস। বলা হয়, নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে যখন বন্দী করে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন মাঠে ঘাটের লোকজন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, কেও কোন কথা কয় নাই। যদি তাদের একজন মানুষও আওয়াজ তুলতো, ধর ধর আমাদের নবাবরে বাঁচা, আমাদের নবাবরে বাঁচা তাহলে একজনের দেখাদেখি সবাই এগিয়ে আসতো, এবং নবাবকে সেখানেই মুক্ত করতে পারতো, এবং এটা করতে পারলেই ভারত বর্ষ ২০০ বছরের ইংরেজি গোলামী থেকে মুক্তি পেতো।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৩৫