আজ জেএসসি-জিডিসির রেজাল্ট দিয়েছে । সারাদেশ থেকে উনিশলাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে । এ+ পেয়েছে ৪৭ হাজারের মত । উনিশলাখ শিক্ষার্থীর মোটামুটি ৩৮ লাখ বাবা-মার একজন আমার কলেজে শিক্ষক আন্টিও গত কয়েকদিন রেজাল্ট নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠিত ছিলেন । প্রতিদিনই ফোন দিতেন, রেজাল্ট কোনভাবে জানা যায় কিনা । আজ রেজাল্ট পাওয়ার পাওয়ার পর জানলাম এ+ পাওয়া ৪৭ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে আন্টির ছেলে নেই । জানাতেই আন্টি বাচ্চা মেয়ের মত ডুকরে কেঁদে উঠলেন । অনেকক্ষণ বোঝালাম - সান্তনা দিলাম । তারপরও সারাদিন বেশকয়েকবার ফোন দেন আন্টি । কোন সাবজেক্টে কি পেয়েছে? তার ছেলে নাইনে সায়েন্স পড়তে পারবে কিনা? তার ছেলের আশেপাশের সবাই এ+ পেয়েছে - তার ছেলের কি হবে?
কিছুক্ষন আগে কোমলমতি দুই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর শুনলাম । এ+ না পাওয়ায় জোবায়ের হোসেন জাহিদ (১৩) এবং অকৃতকার্য হওয়ায় হিয়াতুন্নেছা (১৪) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে ।
ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ছে । ১৯৯৯ সাল । নান্নু ভাই । আমাদের পাড়ার মারকুটে ব্যাটসম্যান - বলার । ফুটবলার । আঁকিয়ে । টেকনিশিয়ান । আরও কত কি! আমার ছেলেবেলার নায়কদের একজন । আজও ভাবি সেই সময়ের কথা । একজন এস.এস.সি পরীক্ষা দেওয়া ছেলের এত গুণ কিভাবে পেল । সেবার এস.এস.সি এর রেজাল্ট বের হল । পাড়ার সকল বাড়ী থেকে আমাদের মিষ্টি এল সন্ধ্যার মধ্যেই । সম্ভবত তার পরের দিন রাতে খবর আসল নান্নু ভাই ফাঁসী নিয়েছে । আমি দেখতে গিয়েছিলাম । আজও নান্নুভাইয়ের ফ্যাঁকাসে মৃতমুখ আমার চোখে ভাসে ।
গত কয়েকবছরে দেশের শিক্ষাপদ্ধতির বিশাল একটা পরিবর্তন এসেছে । সৃজনশীল । পদ্ধতিটিকে আমার খারাপ মনে হয়নি । একটা আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম । সবাই মুখস্থ ভুলে গিয়ে রাতারাতি বুঝে কিছু লিখতে শিখবে। সারারাত জেগে আর গফুরের চরিত্র মুখস্থ করতে হবে না । ঢালাওভাবে ক্লাসের সবার জীবনের লক্ষ্য যে ডাক্তার হওয়া সেটাও পরিবর্তন হয়ে যাবে। হয়তো পরিবর্তন হয়েছে কিছু । কিন্তু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ছেলেমেয়ে-অভিভাবক - শিক্ষক সকলের মানসিক উন্নয়ন, সে অবস্থার কোন উন্নতি হয়েছে? বরং পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে সবাইকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়েছে । যে বাবা-মার ছেলেকে সুকুমার রায়ের ছড়ার বই কিনে দেওয়ার কথা- সেই বাবা-মা পিএসসি এর মোটা গাইড বাচ্চার ব্যাগে ভরে দিচ্ছেন । যে ছেলের বিশাল প্রান্তর দৌড়িয়ে গোল্লাছুট খেলার কথা, সে জেএসসি -এর ভারী বইয়ের বস্তা কাঁধে নিয়ে মোবাইলে গান শুনতে শুনতে কোচিংএ যাচ্ছে ।
এতকিছুর পরও আমি আশাবাদী । ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত এই রেজাল্ট-মুখস্থভিত্তিক পড়াশোনা একদিন বন্ধ হবেই । একদিন আমার নিজের সন্তানটিকে দেখেও আমার গর্ব হবে ........বিষয়ভিত্তিক দুর্বলতা থাকতেই পারে, কিন্তু মানবিক গুণাবলীতে ওর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কে আছে !