তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ঠোঁটের উপরে মোচের হালকা আবরণ পড়তে শুরু করেছে সবে। গায়ে ফুরফুরা ভাব। বিকেলে শার্টের কলার উঁচিয়ে হাতে চেইনওয়ালা ঘড়ি লাগিয়ে এলাকার মোড়ে হাওয়া খেতাম। সেই সময় 'পাওয়ার' হাসিল করার এক ধরনের ঝোঁক কাজ করত। এলাকার বড়ভাইদের সাথে দুই একবার হাই হ্যালো হওয়া মানেই বিরাট হ্যাডম হয়ে যাওয়া। বন্ধুদের সাথে ঝগড়া বাঁধলেই ঝেড়ে দিতাম, "ওই তুই কার পাওয়ারে চলস? আমি উমুক ভাইয়ের পাওয়ারে চলি। বুইঝা লাগতে আসিস।" সবই আলগাভাব। সস্তা হিরোইজম দেখানোটাই ছিল বড় ব্যাপার। সাথে ছিল প্রেম নিয়ে সব থার্ড ক্লাস চিন্তাভাবনা। ক্লাস সিক্সে থাকতেই অনেক বন্ধুকে দেখতাম মেয়েদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব যারপরনাই আমার মর্মে পীড়া দিত তখন। সেভেনে উঠেই অনেক মেয়ে বন্ধু জুটে গেল। দিনকাল ভালোই কাটতছিল।
ক্লাস সেভেন পার করে এইটে উঠলাম। পড়ার চাপ সামান্য বাড়ল সেবার। সেই বছরই জীবনের মোড় ঘুরল। নতুন ক্লাসে নতুন বন্ধু জুটে গেল। নেশায় আসক্ত এক বন্ধু। সামিউসের কথা বলছি। নেশাগ্রস্থ মানুষ চায় তার কাছের বন্ধুটাও যেন সেই নেশায় আসক্ত হয়। এর পিছনে শক্ত জুক্তিও আছে বটে। ক্রাইসিসের দিনে নেশা করতে সাহায্য পাওয়া যায়। সেই সাহায্য পাওয়ার উদ্দেশ্যেই হোক বা যে কারনেই হোক সামিউস আমার হাতে 'হিমু' নামক এক নেশার দ্রব্য তুলে দিল। যার উৎপাদক হুমায়ূন আহমেদ নামের এক কলম জাদুকর। আমিও অতিদ্রুত নেশায় পড়ে গেলাম। সে এক কঠিন নেশা। এক সময় আবিষ্কার করলাম এক হিমুতে কাজ হচ্ছে না। আমার আরো চাই। নেশা মিটানোর জিনিসের অভাব হয়নি কখনো। হিমু শেষ হয়েছে তো মিসির আলী আছে। মিসির আলী ফুরালেই বা কি! শুভ্র আর রূপা তৈরি। তাতেও নেশা না কাটলে হুমায়ূন আহমেদ নামের ড্রাগ প্রোডিউসারের আরো বিভিন্ন প্রোডাক্ট তো ছিলই। অভাবে পড়িনি কখনো। নেশা করেছি ইচ্ছা মতো। দিন রাত নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থেকেছি। এভাবেই সময় কেটেছে।
আমার দুর্ভাগ্য আমি এডিক্টেড হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই স্যার দরজার ওপাশে চলে গেছেন। তবুও নেশায় কিন্তু ভাটা পড়েনি। এক সময় নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। একদম অন্য এক জগতে নিজেকে খুঁজে পেলাম। এক নতুন মানুষ যেন আমার আগের 'আমি' কে বদলে দিয়ে নতুন করে আমার মধ্যে বাস করতে শুরু করল। এই নতুন 'আমি' আর আগের 'আমি'র মধ্যে বিস্তর ফারাক। সে আগের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে গায়ে হাওয়া লাগায় না, বরং ছাদে বসে দক্ষিণা হাওয়ার সূর্য ডুবতে দেখে। এই নতুন 'আমি' আর আগের মতো সস্তা পাওয়ারের সন্ধান করে না। নীল জোছনার দিকে অবাক চোখে চেয়ে থেকে খুঁজে বেঁচে থাকার স্পৃহা। বদলে যাওয়া 'আমি' তখন আর মেয়েদের সাথে ঘুরে বেড়িয়ে শো অফ করাকে বিরাট ক্রেডিট মনে করা ভুলে বৃষ্টিতে ভিজে সেই বৃষ্টির ফোঁটা কে নিজের প্রেমিকা জ্ঞান করতে শিখে গেছে। হিন্দি গানের সুর না আওড়ে সেই নতুন 'আমি'র গলায় রবীন্দ্রসংগীত বাজতে লাগল।
আগের মতো চলতে থাকলে নির্ঘাত আমি বখে যেতাম। স্যারের বইয়ের নেশা করার পর সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া এক মানুষ হয়ে গেলাম আমি। আগের চাইতে মার্জিত। আগের চাইতে শান্ত। মারদাঙ্গা ভাব কেটে গিয়েছিল। নিজের একটা শক্ত ইথিকস গড়ে উঠল। ধ্যানধারণা পালটে গেল। এই সবই হয়েছে এক হুমায়ূন আহমেদের জন্য। অনেকেই তাকে বাজারী লেখক বলে। বলে তার লেখায় সাহিত্য গুন নাই। অথচ এই একজন হুমায়ূন স্যারই এক বিশাল পাঠক শ্রেণী তৈরি করে গেছেন। এই ক্ষ্যাপাটে জাদুকরের কলমের জাদু তে কতো হতাশ যুবক জীবনের নতুন স্বাদ খুঁজে পেয়েছে তার হিসাব কে রেখেছে! কয়জন পেরেছেন এমন করতে? বাংলাদেশের কোন লেখকের লেখা পড়ে এক যুবক পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নির্বিকারভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছে? "ঈদে কিছু দরকার নাই। সেই টাকায় হুমায়ূন আহমেদের বই কিনে দাও।" এই কথাটা লেখার আবেদন কতোটা গভীর হলে একজন মধ্যবিত্তের ছেলে বলতে পারে যার মার্কেট করার সুযোগ বছরে ওই একবারই আসে? কোন লেখক পেরেছে প্রেমিকের হাতে প্রেমিকার জন্য লাল গোলাপের বদলে এক গুচ্ছ বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল তুলে দিতে? কোন লেখক শিখিয়েছে কীভাবে প্রকৃতির প্রতিটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৌন্দর্য কে উপভোগ করতে হয়? কোন লেখক পেরেছে এই নয়নকে এক নতুন জীবন দান করতে?
যারা বলে স্যারের লেখা বাজারী তাদের আমার কাছে নিয়ে আসুন। সচোক্ষে দেখুক আমাকে। আমি স্যারের লেখায় নবজীবন প্রাপ্ত একজন।
দরজার ওপাশে ভালো থাকবেন স্যার
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে...
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:২১