আমাদের নাফিজ বন্ধু সমাজে ভাইরাস নামে পরিচিত। জগতের সব শয়তানি তার জানা। এলাকার পিচ্চি পোলাপান দের প্রিয় চেহারা। আর সবচেয়ে ভালো যা পারে তা হচ্ছে ছবি আঁকতে পারে। বিশেষ করে পারে কার্টুন আঁকতে। কোনো কিছু দেখে কলমের আঁচড়ে তার ছবি এঁকে ফেলতে পারে। শালার আঁকা ছবির দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। আর কার্টুন গুলো দেখে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়।
নিশান হালায় আগে একটু বদ মেজাজি ছিল। প্রেম ট্রেম করে শালার মধ্যে এক ধরনের কোমলতা এসেছে। ক্লাসের ফাঁকে মাঝে মাঝেই গলা ছেড়ে ইংলিশ গান গায়। এই গান সে কারো কাছ থেকে শিখেনি, সব টাই নিজের চেষ্টায়। শুধু খালি কন্ঠে না গিটার বা ইনস্ট্রুমেন্টালে খুব ভালো গায়। শালার রেকর্ড করা গান শুনে মাঝে মাঝে ধরতে পারি না যে এটা আসল নাকি নকল!
আমাদের নাঈম খুব লিক লিকে। ফুটবল পায়ে বাতাসের বেগে ছুটে যায়। কখন আপনার পায়ের ফাঁক গলে বল নিয়ে চলে যাবে আপনি বুঝতেই পারবেন না! মাঠের এক কোন থেকে চোখের পলকে ছয় সাত জন কে কাটিয়ে বল নিয়ে মাঠের আরেক কোনের গোল পোস্টে বল ঢুকানো শালার কাছে হাগা মুতার মতো সহজ।
আমার বন্ধু তাহিদুল ফিজিক্স পাগলা। আঁতেল সম্প্রদায় ভুক্ত। ফিজিক্সের যেকোনো সমস্যা কিছুক্ষন চিন্তা ভাবনা করে তার সমাধান বের করতে পারে। ব্যাটার চিন্তা ভাবনা অন্য লেভেলের। শুধু ফিজিক্স না, যেকোনো বিষয় যুক্তি দিয়ে বিচার করে সঠিক সমাধান দিতে পারে। এই বয়সেই এতো উন্নত চিন্তা ভাবনা যে কেউ করতে পারে তা এই হালারে না দেখলে বিশ্বাস হবে না।
আমাদের মাকসুদ জুনিয়র ম্যাথ অলিম্পিয়াডে ন্যাশনাল লেভেলের চ্যাম্পিয়ন। গনিতের কোনো সমস্যাই তার কাছে সমস্যা না। অংক করে ক্যালকুলেটর ছাড়া। অরিয়েলও পাগলা ম্যাথমেটিশিয়ান। খুব সহজেই কঠিন সব অংক সলভ করে ময়লা দাঁত বের করে হাসে। আর বিজয় তো গনিত কে নিজের সেকেন্ড GF ভাবে!
উপরে যাদের কথা বললাম তারা সবাই আমার আশেপাশের 'হিডেন ট্যালেন্ট।' হিডেন ট্যালেন্ট শব্দটা কে বিশেষ করে মার্ক করছি কারন এদের ট্যালেন্ট বেশির ভাগ সময়ই হিডেন থেকে যায়।
আমাদের দেশে মোটা দাগে দুই ধরনের স্টুডেন্ট দেখা যায়। এক ভাগ হচ্ছে ডাক্তার স্টুডেন্ট আরেক ভাগ হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার। এই প্রথাগত বিভাজন উপেক্ষা করে নাফিজ যদি তার মা কে বলে যে সে কার্টুনিস্ট হতে চায় তাহলে তার মা কিছুক্ষন অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলবে "ফাইজলামি বাদ দিয়ে কেমিস্ট্রি বইটা নিয়ে বস। জারন-বিজারন টা পড়।"
নিশান যদি ওর বাবা কে বলে "আব্বু, আমি একটা ব্যান্ড খুলব। আমি হব ভোকালিস্ট।" তাহলে তার বাবা বলবে "অ্যাপোলোনিয়াসের উপপাদ্য টা পারো? যাও লিখে নিয়ে আস।"
নাঈম যদি তার মা কে বলে "আম্মা, একটা ক্লাব থেকে ডাক পাইসি।" তাহলে তার মা বলবে "ফুটবল খেলে কি হবে? পা ভাংলেইতো শেষ।"
তাহিদুলের ফিজিক্স নিয়ে পাগলামি আর বিজয়-মাকসুদ দের গনিত নিয়ে মাতামাতি খুব জীবন ঘনিষ্ঠ। কিন্তু যদি পচা শামুকে পা কেটে যায় তাহলে! সেই কাটা পা নিয়ে আজীবন খোঁড়াতে হবে। হয়তো ফিজিক্সে না পড়ে ঢাকা ভার্সিটিতে তাহিদুল অন্য কোনো সাবজেক্ট পেলো। তখন কি হবে? তার এই ট্যালেন্ট কি হারিয়ে যাবে না?
আসলে আমাদের উপর সব কিছু কেন যেন চাপিয়ে দেয়া হয়। JSC তে ভালো পয়েন্ট পেলেই দেয়া হবে সাইনস। কিন্তু যে ছেলেটা গনিতে খুব ভালো কিন্তু অন্য বিষয়ে খারাপ করার কারনে পয়েন্ট কমে গেছে সে পেয়ে গেলো কমার্স!
আমার আশেপাশের টিলেন্টেডরা আশা করি জীবনের সিড়ি বেয়ে একদিন অনেক উঁচুতে উঠবে। কিন্তু নিজের ট্যালেন্ট কাজে না লাগিয়ে জোর করে চাপিয়ে দেয়া বিষয়ে ভালো কিছু করলেও সেই ভালোর মধ্যে একটা জিনিসের ঘাটতি থেকে যাবে।
কোনো জিনিস অরুচি করে জোর করে খেলে বদ হজমের ভয় থেকে যায়। তেমনি জোর করে চাপিয়ে দেয়া বিষয়ে হয়ত অনেক সফলতা আসতে পারে কিন্তু তাতে আত্মতুষ্টি থাকে না। উহু .... থাকতে পারে না।
আমাদের ট্যালেন্টের কিন্তু অভাব নাই। অভাব হচ্ছে স্কোপ বা সুযোগের। এই সুযোগের অভাবেই চাপিয়ে দেয়া বিষয়ের চাপায় ট্যালেন্ট গুলো চাপা পড়ে যায়।
হয়ত নাফিজ একদিন তার অফিসের ফাইলের মধ্যে একটা কার্টুন এঁকে নিজের মনেই হাসবে। আমাদের নিশান হয়ত অফিসের কাজের ফাঁকে মনের অজান্তেই গান ধরবে। এই গান শুনে তার কোনো কলিগ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবে। নাঈম হয়ত গাড়ি ড্রাইভ করে যাওয়ার সময় খেলার মাঠে এক দূরন্ত বালকের বল নিয়ে ছোটাছুটি দেখে বহু বছর আগের কোনো ম্যাচে ফিরে যাবে। ক্যালটেক ভার্সিটির ফিজিক্সের লেকচারার হওয়ার স্বপ্ন দেখা তাহিদুল হয়ত এদেশের কোনো ভার্সিটির লেকচারার হবে। তার কোনো ছাত্রের মধ্যে ফিজিক্স নিয়ে মাতামাতি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। এই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই চাপা পড়ে থাকবে নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে বড় কিছু করতে না পারার হতাশা।
কোনো দিন এসব হিডেন ট্যালেন্ট কেউ খুঁজে বের করে কাজে লাগাতে পারলেতো ভালোই আর না পারলে চাপিয়ে দেয়া বিষয়ের চাপায় এসব ট্যালেন্ট হিডেন ট্রেজারের মতোই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই হিডেন থেকে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৪০