বিথীর বিরল রোগ, ওয়েরউল্ফ নাকি হার্সুটিজম
আমাদের সময়.কম : ২৬/০৪/২০১৬
বিরল রোগ ওয়েরউল্ফ সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছেন টাঙ্গাইল নাগরপুরের বিথী আক্তার। ১২ বছর বয়সী এই কিশোরী বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন।
সোমবার দুপুরে বিএসএমএমইউতে বিথীর সন্ধান মেলে। দেখা গেছে, তার মুুখম-ল, হাত ও পায়ে ঘন কালো বর্ণের অস্বাভাবিক বড় লোম। বুকে-পিঠেসহ দেহের অন্যত্রও একই অবস্থা বলে জানিয়েছেন তার বাবা আবদুর রাজ্জাক।
অন্যদিকে ১১ বছর বয়স থেকে বিথীর স্তনের আকৃতি অস্বাভাবিক আকারে বাড়তে থাকে বলে জানান বিথীর মা বিউটি আক্তার। তার সামনের উপরের দাঁতের রঙও বিবর্ণ। দেখতে মাংস পিন্ডের মতো।
হাসপাতালে ভর্তির ১০ দিনেও বিথীর চিকিৎসকরা তার রোগ নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয়ে হরমোন বিষয়ক কোর্সে অধ্যয়নরত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেন আমাদের সময় ডটকমকে বলেন, ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখেছি বিশ্বে এমন দুই-তিনটি ঘটনা পাওয়া গেছে। পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে তার সমস্যা সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য করা হবে বলে জানান বিথীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত এই চিকিৎসক।
তবে নাম না প্রকাশের শর্তে বিএসএমএমইউর একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ বিথীকে দেখে আমাদের সময় ডটকমকে বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে- এটা ওয়েরউল্ফ সিনড্রোম। এতে আক্রান্তকে হাইপারট্রাইকোসিস রোগী বলা হয়। আক্রান্তদের মুখম-ল ও দেহে অস্বাভাবিক লোম দেখা দেয়। মূলতঃ জিনের পরিবর্তন হওয়ার কারণে এমন ঘন লোম গজায়। এই রোগের এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা নেই। তবে বিথী প্রকৃতই ওয়েরউল্ফ সিনড্রোমে আক্রান্ত কি-না- শতভাগ নিশ্চিত নন তিনি।
আবার আরেকটি সূত্র থেকে তথ্য পেয়েই এই চিকিৎসক নতুন তথ্য জানান আমাদের সময় ডটকমকে। তিনি বলেন, চিকিৎসাশাস্ত্রে এ পরিস্থিতিকে হার্সুটিজম বলা হয়, এটাও হাইপারট্রাইকোসিসের রূপই। যার প্রভাবে মেয়েদের ঠোঁটের উপরি ভাগে, গালে, চিবুকে, বুকে, স্তনে, তলপেটে, নিতম্বে অথবা কুঁচকিতে শক্ত-কালো চুল গজায়। এ রোগে বাড়তি চুলের পাশাপাশি মাথায় টাক, পুরুষালি পেশি গঠন, গভীর কণ্ঠস্বর, ব্রণ, মাসিক বন্ধ, স্থূলতা, বন্ধ্যত্ব, ডায়াবেটিস ইত্যাদি থাকতে পারে।
তিনি ব্যাখ্যাও করেন ‘হার্সুটিজম’ সম্পর্কে, বলেন, সাধারণত মেয়েদের শরীরে ডিম্বাশয় বা এড্রোনাল গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত এন্ড্রোজেন হরমোন (যেসব হরমোন পুরুষালি বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী) নিঃসরণের কারণে হয়ে থাকে। ৭০-৮০ ভাগ ক্ষেত্রে হার্সুটিজম আক্রান্ত নারীদের রক্তে এন্ড্রোজেন হরমোন বেশি থাকে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়ই এ অতিরিক্ত এন্ড্রোজেনের উৎস। ডিম্বাশয়ের কিছু রোগ, যেমন- পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম, হাইপার ইন্সুলিনিজমিক হাইপার এন্ড্রোজেনিজম উইথ এন অভুলশন, ওভারি বা এড্রোনাল গ্রন্থির কিছু টিউমার বা ক্যান্সারের কারণেও এন্ড্রোজেন হরমোন নিঃসরণ বেড়ে হার্সুটিজম হয়। এড্রোনাল গ্রন্থির রোগের মধ্যে কঞ্জেনিটাল এড্রোনাল হাইপারপ্লাসিয়া, এড্রোনাল এডেনোমা, কার্সিনোমা ইত্যাদি। এছাড়া পিটিউইটরি গ্রন্থির রোগ যেমন- কুশিং ডিজিজ, এক্রোমেগালি ইত্যাদি। কিছু ওষুধ গ্রহণের ফলেও এমন সমস্যা হতে পারে, যেমন- মিনক্সিডিল, কর্টিকোস্টেরয়েড, ফিনাইটইন, ডায়াজক্সাইড ইত্যাদি।
তিনি বলেন, হাইপারট্রাইকোসিসও শরীরে অতিরিক্ত লোম গজানোর কারণ। এতে এন্ড্রোজেনের প্রভাববিহীন দাঁড়ি-গোঁফ ছাড়াও সব শরীরেই পাতলা চুল বা লোম গজায়। এটাও কিছু রোগের কারণে হয়। যেমন- জন্মগত কিছু রোগ, পরফাইরিয়া, হাইপোথাইরয়েডিজম, এপিডার্মোলাইসিস বুলোসা, ডার্মাটোমাইয়োসাইটিস, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি। যাদের হার্সুটিজমের সঙ্গে পুরুষালি লক্ষণ থাকে এবং তা দ্রুত বাড়তে থাকে। সেক্ষেত্রে হার্সুটিজমের কারণে টিউমার বা ক্যান্সার হওয়ার আশংকা বেশি। পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়া আসলে শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বীথি প্রকৃত পক্ষে কী সমস্যায় আক্রান্ত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ আমাদের সময় ডটকমকে বলেন, হরমোনের সমস্যা থেকে এমন হয়। এটা একটি বিচ্যুতি।
বিথীর বাবা আবদুর রাজ্জাক জানান, জন্মের পর থেকেই বিথীর সারা দেহে ঘন লোম ছিল। ঘন লোম ও স্তনের আকার অস্বাভাবিক বড় হওয়া ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই, খাওয়া ঘুম সবই ঠিক আছে। তবে বিথী মাছ, মাংস, ডিম খেতেই নাকি সবচেয়ে পছন্দ করে। তার ছোট দুই ভাই রয়েছে। তাদের মধ্যেও এরকম কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা দেয়নি বলে জানান রাজ্জাক।
চিকিৎসকদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, তারা বলছে, ভাল হইব, কিন্তু অনেক টেকা লাগব। আমি ভাড়া করা মোটর সাইকেল দিয়া যাত্রী টানি। কই পাব এতো টাকা। আমার ব্যর্থতা একটাই, টাকা নাই। কাজ করলে টাকা পাই। তিনি আর্থিক সহযোগিতা প্রত্যাশি সরকারের কাছে। রাজ্জাক বলেন, সরকার আমার দিকে না তাকাইলে মাইয়ার চিকিৎসা করাইতে পারুম না। বাপ হইয়া মাইয়ার এই অবস্থা দেইখা কষ্টই পাইতে হইব।
বিথীর বিরল রোগ, ওয়েরউল্ফ নাকি হার্সুটিজম