নারী ক্ষমতায়নের কথা উঠলে সাধারণত আমরা পশ্চিমা সভ্যতার কথা ভাবি। ঔপনেবেশিক সংস্কৃতি আর বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব প্রাচ্যের নিজস্ব ইতিহাসের অনেক কিছুই বিস্মৃত করেছে- তা ঘটেছে নারীর বেলাতেও। অথচ খুব বেশি আগের কথাও নয়, যখন প্রাচ্যে নারী রোল মডেলের অভাব ছিল না। রূপ, লাবণ্যের চেয়েও যাদের ব্যক্তিত্ব, তেজ এমনকী রণনৈপুণ্যের খ্যাতি ছিল দিকে দিকে।
ঔপনেবেশিক ঘরানার ইতিহাস দেখায়- ইসলামে নারীর ভূমিকা কেবল ঘরেই সীমাবদ্ধ। তবে এই বর্ণনা অর্ধসত্য। বাস্তবে পরিবার, সমাজ ও দেশ রক্ষায় পুরুষকে ইসলামে অগ্রণী ভূমিকা দেওয়া হলেও, নারীদের এমন দায়িত্ব থেকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ; নারী সাহাবী নুসাইবাহ বিনতে কাবের (রাঃ) কথা বলা যায়- যিনি একাধারে ইসলামের প্রথম নারী যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত এবং বীরত্বের জন্য সুপরিচিত।
ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যেও উদয় ঘটে বিশেষ এক শ্রেণির নারী যোদ্ধার। উর্দুবেগী নামে পরিচিত এই নারী সেনানিদের দায়িত্ব ছিল মোগল সম্রাট ও তার হেরেমের সুরক্ষা। অন্তত প্রথমদিকে কেবল একারণেই বাহিনীটি তৈরি করা হয়।
১৫২৬ সালে পশতু রাজবংশের সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাস্ত করেন বাবুর। আর তাতে ভারতবর্ষে মোগল শাসনের সূত্রপাত হয়। বাবুরের সাথে তার হেরেম বা পরিবারের নারী সদস্য, শিশু আর নাবালকরাও এসেছিলেন। তাদের নিরাপত্তা বিধানে বাবুর কাশ্মীরি, তুর্ক, হাবশী ও তাতার গোত্রগুলির মতো যোদ্ধা জাতির নারীদের নিয়ে একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করেন। আর এরাই হলেন- উর্দুবেগী।
উর্দুবেগীদের ছিল এমন বিক্রম- যে তাদের নাম শুনেই আতঁকে উঠতো মোগল বাদশাহর শত্রুরা। হেরেমের কোনো ক্ষতি করার আগে তাদের এই তেজস্বী নারীদের মোকাবিলা করার কথা ভাবতে হতো। খোদ মোগল সম্রাজ্ঞী, রাজকন্যা বা বাদশাহের উপপত্নীরাও তাদের সমীহ করতেন, কেউবা পেতেন ভয়। একমাত্র বাদশাহের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যের জন্য ইতিহাসে স্মরণীয় উর্দুবেগীরা। তবে কালের প্রবাহে তাদের সোনালী ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে। বর্তমান সভ্যতার স্মৃতি থেকে মুছেই গেছে মোগল সালতানাতে অসীম ক্ষমতাধর এই নারীদের কথা।
সে ভুলের সংশোধন করতেই আজ তাদের কথা শোনা যাক। জানা যাক বিখ্যাত উর্দুবেগীদের ইতিহাস-
মোগল হারেমে নারীর বহুবিধ ভূমিকা
উর্দুবেগীদের কথা উঠলেই হারেম প্রসঙ্গ চলে আসে স্বাভাবিকভাবে। এজন্য আগে হারেম সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণার অবসান দরকার। যেমন হারেমকে শুধুই যৌন অভিসার বা প্রমোদ কেন্দ্র মনে করেন অনেকে। কিন্তু, সত্যের সাথে এ ধারণার যোগ কম। আসলে হারেমে থাকতেন বাদশাদের নারী আত্মীয় থেকে শুরু করে তার নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরমধ্যে পাঁচ শতাংশ বা তারও কম বাদশাহের শয্যাসঙ্গী, স্ত্রী বা উপপত্নী ছিলেন।
হারেমের সকল বাসিন্দা পরপুরুষের (নিকটাত্মীয় নয় যারা) সামনে পর্দা করতেন। পর্দা আসলে ঝালড় বা ঘোমটার আড়াল রেখে পালন করা হতো। পর্দার প্রচলন কম ছিল খোদ বাদশাহ্, সন্তান বা ভাইয়ের মতো ঘনিষ্ঠদের সামনে। তবে পর্দা করার অর্থ নারীকে বিচ্ছিন্নতায় ঠেলে দেওয়া নয়। বরং মধ্যযুগের এ প্রথা প্রাচ্যের সম্ভ্রান্ত বংশীয় নারীদের ক্ষেত্রে ছিল সাধারণ চর্চা। এই আড়াল থেকেই রাজকার্য থেকে শুরু করে দরবারের গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখতেন তাদের অনেকে।
সাউথ এশিয়ান স্টাডিজে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এর লেখক গুল-ই-হিনা মোগল নারীরা কীভাবে পর্দা পালন করতেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। "উচ্চ বংশীয় নারীর জীবনযাপন ছিল আলাদা থাকার প্রথায় ঘেরা, যা মর্যাদাকর মনে করা হতো। একারণেই ঘোমটা বা ঝালড়ের মতো পর্দাকে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতে গ্রহণ করা হয়। মোগল যুগে এটি হয়ে ওঠে অভিজাতদের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের অংশ।"
হারেমে অনেক অনেক নারীই থাকতেন- তাদের জানানা বা জেনানা বলা হতো। প্রত্যেকের ছিল নির্দিষ্ট দায়িত্ব। যেমন উর্দুবেগীরা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন।
এলিসন ব্যাংকস তার বই 'নূর জাহান: ইমপ্রেস অভ মুঘল ইন্ডিয়া'য় হারেম সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, "যেসব প্রাসাদে জেনানারা বসবাস করতেন, সেগুলিকে একেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর বলা চলে। নানান ধর্ম, বর্ণ, প্রথা ও পেশার নারী তো ছিলেনই, ছিল তাদের নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা। তাদের অনেকের শৈল্পিক দক্ষতা ছিল সে যুগের অনেক বিখ্যাত শিল্পীদের সমতূল্য। যেকোনো মহানগরের মতোই হারেম ছিল নানান শ্রেণির নারীদের এক আবাসস্থল।"
এত বেশি বাসিন্দা থাকায়, হারেমকে যথাযথভাবে পরিচালনা করতে নারী কর্মচারীদের বিশেষ বিশেষ পদ ছিল। খোঁজা পুরুষ দাস বা প্রহরী যেমন ছিল- তেমনি ছিল অঙ্গ (পালক মাতা), দারোগা (নারী সর্দার বা কর্ত্রী), মাহালাদার (তত্বাবধায়ক) এবং উর্দুবেগীরা (সশস্ত্র নারী প্রহরী)।
বিভিন্ন পেশার এই নারীরা ছিলেন বিবাহিত এবং তাদের কাজের সময় ছিল নির্দিষ্ট । বাকি সময়টা তারা বাড়িতে ফিরে পরিবারের সাথে কাটাতেন।
মোগল সম্রাটের ক্ষমতা ধরে রাখার পেছনে মূল শক্তি ছিল তিনটি: তার সেনাবাহিনী, রাজকোষ এবং অধীনস্ত নারীরা। অথচ প্রথম দুটির সাথে সম্রাটের চেয়ে সরাসরি সংযোগ বেশি ছিল- হারেমের। আবার তৃতীয় এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যরাই ছিলেন সম্রাটের সবচেয়ে কাছের মানুষ। হারেমে সম্রাটরা সবচেয়ে বেশি সময় থাকতেন। আর তাই সেখানে অতি-বিশ্বস্ত ও যোগ্য প্রহরীর দরকার ছিল।
তবে হারেমে শুধু খোজা ও নারীদের প্রবেশের অনুমতি থাকায়, তাদের মধ্য থেকেই যোগ্যদের নির্বাচন করে দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে গড়ে উঠতে দরকারি সব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এতে অন্য পুরুষের প্রয়োজনীয়তা দূর হয় এবং হারেমের নারীদের সম্ভ্রান্ত পর্দাপ্রথা অক্ষুণ্ণ থাকে।
উর্দুবেগী- মোগল হারেমের যোদ্ধা ও অতন্দ্র প্রহরী
হারেমের ভেতরে ও বাইরে কড়া প্রহরায় থাকতেন উর্দুবেগীরা। তবে প্রহরী হওয়ার জন্য তাদের এমন গোত্র বা গোষ্ঠীর সদস্য হতে হতো যেখানে পর্দার প্রচলন নেই। কারণ একজন প্রহরীকে দায়িত্ব পালনের সময় অন্য পুরুষের সাথে সাক্ষাৎ করতে হতো। তাদের জেরা করে আগমনের উদ্দেশ্য জেনে নিতে হতো। তাদের আনা বার্তা বা উপহার অন্দরমহলে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও ছিল উর্দুবেগীদের ওপর। আর প্রয়োজন পড়লে অনুপ্রবেশকারী বা সন্দেহভাজনকে শাস্তিও দিত। তাছাড়া, হারমের কোনো সদস্য ভ্রমণ করলে উর্দুবেগীরা তার সফরসঙ্গী হত। এসময় তাদের রক্ষী হিসেবে প্রকাশ্যেই থাকতে হতো।
আসলে উর্দুবেগীরা নিজেরা পর্দা না করে মোগল রাজকন্যা বা রানিরা যেন পর্দার অন্তরালে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতো। তাই পর্দা প্রথার কড়াকরি নেই এমন হাবশী, তাতার, তুর্কি ও কাশ্মীরি গোত্রের নারীদের মধ্যে থেকে উর্দুবেগীদের বেছে নেওয়ার চল ছিল।
সম্রাট বাবর ও হুমায়ূনের আমলে উর্দুবেগী পদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। ফলে তাদের আমলেই এই বাহিনী গঠন করা হয় এবং তার আগে মোগলদের মধ্যে এমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না বলেই মনে করেন ঐতিহাসিকরা। তার আগে ভিন্ন ভিন্ন নামে নারী প্রহরীর পদ ছিল, কিন্তু সে সময়ে উর্দুবেগী নামটির কোনো উল্লেখ মেলেনি।
নারী প্রহরীরা তীর-ধনুক চালনার প্রশিক্ষণ নিত। শিখতো বর্শার নানান ব্যবহার। আগ্নেয়াস্ত্রসহ ছুরি আর তলোয়ার চালনায় দক্ষ ছিল তারা। যুদ্ধ প্রশিক্ষণের সাথে সাথে বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় উৎরাতে হতে হতো উর্দুবেগীদের। কারণ পুরো সম্রাট ও তার বেগমসহ পুরো সালতানাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের রক্ষার ভার ছিল তাদের কাঁধে।
কিশোরী সারান লাল তার বই 'দ্য মুঘল হারেম'- এ উর্দুবেগীদের শক্তি আর ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে লিখেছেন, "উর্দুবেগীরা এত দুধর্ষ যোদ্ধা ছিল যে উত্তরাধিকার নিয়ে যুদ্ধের সময় পিতা শাহজাহানের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সাহস করেননি রণাঙ্গনের বীরযোদ্ধা আরঙ্গজেব। তার ভয় ছিল, প্রাসাদে গেলে উর্দুবেগীরা তাকে সহজেই হত্যা করবে।"
উর্দুবেগীদের ভূমিকায় বিবর্তন:
সম্রাট যেখানেই যান না কেন তার সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন এই যোদ্ধা নারীরা। বাবুর প্রথম মোগল শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও- তখনও দুর্বল মসনদের ভিত্তি। হুমায়ূনের আমলে যার ব্যতিক্রম হয়নি। ফলে অধিকাংশ সময় সেনা ছাউনিতেই অবস্থান করতেন বাবুর ও হুমায়ূন। সেখান থেকেই শাসন পরিচালনা করতেন। এর অর্থ প্রথম দুই সম্রাটকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরতে হয়েছে বেশি। তাদের সাথেই থাকতেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। রাজপরিবারের সকলকে এই যাযাবর জীবনে রক্ষার প্রয়োজনীয়তা থেকেই নারী দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করা হয়।
অনেক সময় বাদশাহর সাথে যুদ্ধাভিযানেও যেত পরিবারের নারীরা। সাথে থাকতো উর্দুবেগীরা। তাঁবুর বাইরে এই রক্ষীদের উপস্থিতি- সম্ভ্রান্ত মোগল নারীদের মর্যাদা নিশ্চিত করতো। এই অতন্দ্র প্রহরীরা ছিল হারেমের আইনরক্ষক। তবে রক্ষীরা যেন কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না হয়- সেজন্য প্রতি ২৪ ঘন্টা পর পর তাদের জায়গায় নতুন প্রহরী আসত।
১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সিংহাসনে আসীন হন বাদশাহ্ আকবর। ৪৯ বছরের শাসনকালে তিনি ভারতে মোগল শাসনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেন। এসময় প্রতিষ্ঠিত হয় চোখ ধাঁধানো সব প্রাসাদ, সৌধ আর উদ্যান। সম্রাটের বাসস্থানের ধারেকাছেই নির্মিত হতো হারেম। তবে সম্রাটের পুরুষ দেহরক্ষীদের সেখানে প্রবেশের অনুমতি ছিল না।
উর্দুবেগীদের দায়িত্ব এ সময় আরও গুরুত্ব লাভ করে। তবে এদের সবাই যোদ্ধা ছিলেন না। সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যেও পদমর্যাদার অদল-বদল ঘটতো। জ্যেষ্ঠ ও দক্ষদের পদোন্নতি ঘটতো। উর্দুবেগীদের মধ্যে একজন অসুস্থ হুমায়ূনের পরিচর্যাকারী ছিলেন বলেও জানা যায়। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর ওই পরিচর্যাকারীকে এক সময় উর্দুবেগী বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন আকবর।
বিবি ফাতিমা- ইতিহাসখ্যাত এক উর্দুবেগী
কয়েক'শ বছরের মোগল শাসনকালে অনেক উর্দুবেগী থাকলেও, ইতিহাসে তাদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য খুবই কম। লিখিত রেকর্ডে একমাত্র যার নামপরিচয়ের কিছুটা উল্লেখ রয়েছে, তিনি হলেন বিবি ফাতিমা। ছিলেন হুমায়ূনের দেহরক্ষী ছিলেন।
সম্রাটের সৎবোন গুলবদন বেগমের লেখা 'হুমায়ূন নামা'য় তার নামের উল্লেখ রয়েছে। হয়তো গুলবদন নারী হওয়ার কারণেই আরেক নারীর অর্জনকে তুলে ধরতে কার্পন্য করেননি, যেমনটা করেছেন পুরুষ ইতিহাসবিদেরা। গুলবদনের ভাষ্য অনুযায়ী, বিবি ফাতিমা ছিলেন অত্যন্ত সুযোগ্য এবং মোগলদের রক্ষায় তার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।
বিবি ফাতিমা শিশুকালে হুমায়ূনের দুগ্ধমাতা (আঙ্কা) ছিলেন। অসুস্থতার কালে সম্রাটের পরিচর্যা করেন। ১৫৫৬ সালে হুমায়ূনের মৃত্যুর পর আকবর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। আকবরের ভালোমন্দ দেখাশোনার ভারও ছিল বিবি ফাতিমার কাঁধে। এই ত্যাগ বিশ্বস্ততার পুরস্কারস্বরূপ আকবরই তাকে উর্দুবেগী বাহিনীর প্রধান করেন। যোদ্ধা না হলেও বিবি ফাতিমা ছিলেন তেজস্বিনী ও বিচক্ষণ। এজন্য তাকে নারী দেহরক্ষীদের প্রধান করতে দ্বিধা করেননি আকবর।
হুমায়ূন-নামায় বলা হয়েছে, জোহরা নামে ফাতিমার এক কন্যাও ছিল। ফাতিমাকে আরও মর্যাদা দিতে জোহরাকে নিজ স্ত্রী হামিদার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেন হুমায়ূন। তবে স্বামীর হাতেই পরবর্তীকালে নিহত হন জোহরা।
এই মর্মান্তিক পরিণতির কথা হুমায়ূন-নামায় এভাবে উল্লেখ করা হয়- "১৫৬৪ সনে বিবি ফাতিমা আকবরকে পরিতাপ করে বলেন, খাজা মোয়াজ্জেম (জোহরার স্বামী) তার মেয়েকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই খাজাকে এক চিঠি দেন আকবর, সেখানে তিনি বলেন- খোঁজখবর নিতে তিনি শিগগিরই তার বাড়ি আসবেন। কিন্তু, আকবর যখন তার বাড়িতে প্রবেশ করছিলেন তখনই ছুড়িকাঘাতে জোহরাকে হত্যা করেন খাজা।"
বাদশাহের সামনে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর খাজা মোয়াজ্জেম কী শাস্তি পেয়েছিলেন, বা আদৌ পেয়েছিলেন কিনা- ইতিহাসে তার উল্লেখ নেই।
তবে এই ঘটনার পরও আকবরের অধীনে দায়িত্ব পালন করে যান বিবি ফাতিমা। সন্তান হারিয়ে তিনি যে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে বাকি জীবন কাটিয়েছেন তা স্বাভাবিকভাবেই যে কেউ অনুমান করতে পারবেন।
উর্দুবেগীদের কথা কেন সবাই ভুলে গেল?
সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রতাপশালী নারী দেহরক্ষী দল। খোদ বাদশাহের অন্দরমহলে যাদের অবাধ বিচরণ। অথচ তাদের কথাই মানুষ ভুলে গেল! মনে রইলো শুধু মোগল দরবারের অন্য সব শান-শওকত! কেন এমন ঘটলো- ইতিহাসই সে ইঙ্গিত দেয়।
১৮ শতকে ব্রিটিশদের আগমনের পর থেকেই ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তনমিত হচ্ছিল। ধীরে ধীরে কমছিল রাজ্যের সীমানা, ক্ষমতা আর ধন-দৌলত। শাহজাদাদের উত্তরাধিকার নিয়ে গৃহযুদ্ধে ক্ষয় হচ্ছিল ভেতর থেকেই। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, অনুগত রাজাদের বিদ্রোহ মোগলদের ভিত্তিকে ঘুণপোকার মতো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। এক পর্যায়ে মোগল তখতের আসীন বাদশাহ হয়ে পড়েন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেতনভূক দাস। বাদশাহী তখন নামেমাত্রই। তবে ১৮৫৮ সালের আগপর্যন্ত শেষ মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করেনি কোম্পানি।
তবে সেপাহী বিদ্রোহের পর জাফরকে বার্মায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। বাদশাহীর অন্তের সাথে সাথে মোগল হারেমের বিলুপ্তি ঘটে। তার সাথে ফুরায় উর্দুবেগীদের প্রয়োজনীয়তা।
মোগলদের রাজনৈতিক দুর্গতি নারীরক্ষীদের প্রতিপত্তিতেও ধস নামায়। তারা হারান আগের ক্ষমতা ও মর্যাদা। ঔপনেবেশিক শাসনে বনেদি পরিবারগুলোও তাদের ক্ষমতা হারায়। তখন নারীদের সামাজিক ক্ষমতায়ন আরও কমে। তারা নিছক অন্তঃপুরবাসীতে পরিণত হন। উর্দুবেগীদের ভাগ্যেও তা ঘটেছে বলে অনুমান করেন ঐতিহাসিকরা।
এভাবে দুই শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসন মোগল আমলের অনেক অর্জনকেই মুছে দিয়েছে। কলোনিয়াল ইতিহাস রচয়িতারাও তার পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
তবে দুঃখের বিষয়- উর্দুবেগীদের বাহিনী হিসেবেই আজ একটু-আধটু চেনেন কেউ কেউ। এই বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে আলাদা আলাদা করে জানাশোনা খুবই কম। অথচ, ভারতের বুকে এমন দুধর্ষ নারী যোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন বিখ্যাতকে জানা গেলে তা কতোই না আকর্ষণীয় হতো! তাদের ইতিহাসের মধ্যে দিয়েই আমরা জানতে পারতাম মোগল অন্তঃপুরের আরও চাঞ্চল্যকর সব ঘটনাপ্রবাহ। কারণ উর্দুবেগীরা তো ইতিহাসের পটপরিবর্তনের সবচেয়ে নিকটতম সাক্ষীই ছিলেন।
সুত্র: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:০২