৩১মার্চ এই লেখাটির প্রথম অংশ যেদিন লিখতে শুরু করি, কিছুটা অনিচ্ছা অনাগ্রহ নিয়েই সেই লেখাটা শুরু করেছিলাম। বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম পৃথিবী শান্ত হয়ে যাবে, করোনা নামের এই মানবঘাতি ভাইরাসটি মানুষের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। ভেবেছিলাম এই লেখার পরের অংশগুলো হয়তো আর লিখতে হবেনা। অন্তর মনের সকল চিন্তা বিশ্বাসকে বিবশ করে দিয়ে করোনা এখনো উর্দ্ধগামী। মানুষের মৃত্যুর হার অনিয়ন্ত্রিত, অসহায় অতন্দ্র বিশ্ববাসী এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে।
আজ ১৩ এপ্রিল ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমান্যুয়েল ম্যাক্রোন করোনা পরিস্থিতি নিয়ে চতুর্থবারের মতো জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। সকলের অপেক্ষা ছিল একটা কিছু আশাজাগানিয়া শোনার। প্রেসিডেন্ট তাঁর ভাষণের পুরোটা জুড়েই মানুষের মনোবল শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন। ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই অনাহুত মসিবতের হাত থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করার কথা বলেছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি যখন ঘোষণা দিয়েছেন আরো প্রায় একমাস অর্থাৎ আগামী ১১মে পর্যন্ত লকডাউন চলমান থাকবে, মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আশাহত হয়েছে , মানুষ বুঝতে পেরেছে ভেতরের অবস্থা কতটা খারাপ।
দৃশ্যত অবস্থা আসলেই খারাপ। অন্তত ফ্রান্সের নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার হার এবং মৃত্যুহার ইউরোপের অন্য যেকোন দেশের চেয়ে এই সপ্তাহে বেশি। শুধু যদি আজকের পরিসংখ্যানটাই বলি আজ ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ, ৪১১৮ জন। মৃতের সংখ্যা আজ ৫৭৪জন যা ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ। যুক্তরাজ্যকে ইউরোপের বাহিরে ধরেই এই হিসাব।
কিন্তু রাষ্ট্রপতির বক্তব্য এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তর থেকে বলা হচ্ছে ফ্রান্সের অবস্থা উন্নতির দিকে যাচ্ছে। এই উন্নতির দিকে যাবার দুইটি ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। প্রথমত সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ফ্রান্সে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশি হবার কারণ হচ্ছে দেশটির প্রায় দুই হাজার বৃদ্ধাশ্রম, যা এই দেশে ইফাদ নাম পরিচিত, আছে। যেখানে প্রচুর বয়স্ক এবং বেশি ওজনের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মৃত্যুবরণ করছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বলতে চাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে হাসপাতালে সাধারণ রোগীর সংখ্যা এবং মৃতের সংখ্যার যে হার দেখা যাচ্ছে তা আশাব্যঞ্জক, অর্থাৎ পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। উন্নতির দিকে যাবার আরেকটি ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে প্রথম দুই সপ্তাহে আক্রান্ত রোগীরা যে হারে খারাপ অবস্থার দিকে অর্থাৎ ক্রিটিকাল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছিলেন সেটা এখন নিয়ন্ত্রণে এবং ক্রিটিকাল রোগী বৃদ্ধির হার দিন দিন কমছে।
ফরাসি সরকার সব সময়ই তার জনগনের মনোবল উন্নত রাখার চেষ্টা করছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। অপরদিকে নতুন করে ১ মাসের অবরোধ ঘোষণা কিছুটা হলেও মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
করোনার বিশ্ব পরিস্থিতি সকলের জানা, তবুও যদি কিছুটা এখানে লিখে রাখতে হয় তবে নিশ্চিত ভাবেই করুণ মর্মাহত চোখে তাকাতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। আজ পর্যন্ত ৫ লক্ষ ৮২ হাজার মানুষ সেখানে আক্রান্ত যার মধ্যে প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ সুস্থ হয়েছেন, মারা গেছেন ২৩৪১৪ জন মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের এই মৃতের সংখ্যাটা এই মুহূর্তে করোনা আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর যেকোন একটি রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বোচ্চ।
কোন আক্রান্ত বা মৃত মানুষকে কোন রাষ্ট্র সমাজ বা গোত্রের পরিচয়ে আলাদা করার সুযোগ নেই। আমরা একটি বৈশ্বিক মহামারীর মাধ্যমে যে মানুষগুলোকে হারাচ্ছি তাঁরা এই পৃথিবীর সন্তান। এই পৃথিবী থেকে এই ভাইরাসটাকে নির্মূল করতে না পারলে মানুষের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে, কোন বিশেষ রাষ্ট্র সমাজ বা ধর্ম একক ভাবে ধ্বংস হবেনা।
বিশ্ব পরিস্থিতি বলতে গেলে ইতালির কথাটা বিশেষ ভাবে বলা উচিৎ, একটা ভয়ংকর অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় পেরিয়ে আলোর দিকেই খুব ধীর গতিতে এগুচ্ছে তারা। ওপর দিকে স্পেন এখনো ফ্রান্সের মতোই খারাপ ভালোর সমন্বয়ে এগিয়ে চলছে। প্রায় দুই সপ্তাহ পরে চায়নায় আবার আক্রান্তের সংখ্যা শতকের ঘর ছাড়িয়েছে, আজ সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন ১০৮ জন। তবে তাদের সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে, কমছে ক্রিটিকাল রোগীর সংখ্যা।
আমার এই লেখাটার শিরোনাম করোনাকাহন, মূলত এই সময়ে নিজের থাকা ইত্যাদি নিয়েই লেখার কথা, পরিসংখ্যান তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গণমাধ্যমেই বর্তমান। তবুও কিছু লিখেই দিলাম।
প্রায় ৮০ স্কয়ার মিটারের একটি বাসাতে বন্দি হয়ে আছি আজ ২৯ দিন। এর মধ্যে চারবার বাহিরে গিয়েছি, সরকার ঘোষিত এটাস্ট্যাশন সাথে নিয়ে যেতে হয়েছে। বাহিরে থাকতে মন সায় দেয়না, দ্রুতই ফিরেছি ঘরে। বারবার ছেলেগুলোর চেহারা মনে পড়ে। ভয় হয়, বুঝি কোন একটা মাধ্যমে ভাইরাসটা আমার কাছে চলে আসবে আর আমার মাধ্যমে ঘরে। ছোট ছেলে মুনিম একটা টনিকের মতো কাজ করছে এই দুঃসহ সময়ে, তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি দিনের একটা লম্বা সময়। হামাগুঁড়ি তো শিখেছেই, ওয়াকারে করে হাঁটতেও পারে, আব্বা পাপা সহ আরো কত শত অভিনব উচ্চারণে সে আমাকে তার কাছে ডাকে, ভালো লাগে, অনন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়েও মুখে হাসি ফুটে, তাকে আনন্দ দিতে গান ধরি, চিৎকার করে করে কবিতা পড়ি। সে হাসে, স্বর্গীয় একটা আনন্দের অনুভূতি পাই।
দিনের একটা বড় অংশ যায় আম্মা আব্বার সাথে কথা বলে। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে আব্বার সাথে কথা হয়েছে হাতেগুনা কয়েকদিন। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা অনেক জরুরি কোন বিষয় ছাড়া আব্বার সাথে খুব বেশি কথা হতোনা আগে। কিন্তু এখন আমার সাথে কথা না বলে আব্বা ঘুমুতে যান না। আমারও একটা অপেক্ষা থাকে কখন হবে সেই কথাগুলো। মনে হচ্ছে এক জীবনের জমানো কথাগুলোই বলে যাচ্ছি ইদানিং আব্বার সাথে। আব্বা টিভি নিউজ নিয়মিতই দেখছেন তবুও আমার কাছ থেকে না শুনলে যেন সেই সংবাদগুলোর সত্যতা নিশ্চিত হতে পারেননা তিনি। বাংলাদেশের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। সেটা আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত নিরীক্ষণ। আমার মনে হচ্ছে অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বাংলাদেশে করোনা ছড়াচ্ছে কম। আব্বাকে সেটা বললে তিনি হাসেন। আব্বার সেই হাসির অর্থ আমি বুঝিনা। আব্বাকে আসলেই আমি খুব কম বুঝি। তবে এটুকু বুঝি আমার আব্বার হাসির অন্যতম কারন আজকের বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অবস্থা এখন পর্যন্ত তুলনামূলক ভালো। সেটা হয়তো আক্রান্তের দিক দিয়ে। কিন্তু মানুষের সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা আর মৃতের সংখ্যা গণনার মাধ্যমে হিসাব করলে বাংলাদেশের মৃতের হার ভয়ংকর। অর্থাৎ বাংলাদেশের রিকোভারিং ক্যাপাবিলিটি অনেক কম। সেটা নিশ্চয়ই চিন্তার বিষয়। এই হিসাবটা আমার আব্বা খুব বুঝেন বলেই তিনি হয়তো আমার কথায় হাসেন।
আমার আব্বা হয়তো এই খারাপ সময়ে সরকার নির্ধারিত ত্রাণসামগ্রীর লুটপাট নিয়ে হাসেন,
এই অসুন্দর হতাশাচ্ছন্ন সময়েও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে দেবার জন্য পরিকল্পিত ভাবে মিথ্যা চাল চুরির অভিযোগে একজন নির্দোষ মানুষকে হেনস্থা করা দেখে হাসেন হয়তো তিনি।
আমার আব্বাই আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। না, প্রাতিষ্টানিক শিক্ষা বলতে আমার আব্বার তেমন কিছু নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়েই তাঁর সহযোদ্ধা ঘনিষ্ট বন্ধুদের সহযোগিতায় প্রথম তিনি বাংলা বর্নমালার সাথে পরিচিত হোন। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর দিতে পারার জন্যেই সেই শুরু। যুদ্ধ পরে নিজের চেষ্টায় শিখে নিয়েছেন প্রয়োজনীয় লিখতে ও পড়তে পারা। আমার আব্বার দিব্য দৃষ্টি খুবই প্রখর। আমার জীবনের সকল জটিল সময়গুলো পেরিয়ে এসেছি উনার সাহস আর ভবিষ্যৎ বলতে পারার অমোঘ চেতনায়।
চোরের চুরি দেখে অথবা নির্দোষ মানুষকে চোর বানিয়ে দেবার কিছু মানুষের অশুভ কৌশল দেখে কিংবা করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের অব্যস্থাপনা দেখে আমার আব্বা যখন হাসেন, শুকনো ভাবে হাসেন আমি ভীত হই। আমি প্রার্থনা করি এই মহামারি সময়ে এসে মৃত্যুকে এতো পাশাপাশি দেখে গরিব মানুষের ত্রাণের চাল চোর মানুষগুলো সাময়িক সময়ের জন্য হলেও সৎ হোক মানবিক হোক।
এই করোনা আক্রান্ত সময়ে বিশ্বব্যাপী যেখানে প্রায় লক্ষ্যাধিক মানুষ নিহত হয়ে গেছে, আক্রান্ত হয়ে আছে প্রায় বিষ লক্ষ মানুষ সেখানে কিভাবে কিছু মানুষ পূর্ব শত্রূতার কারনে অথবা রাজনৈতিক কারনে একজন নিরপরাধ মানুষকে চোর হিসেবে প্রতিষ্টিত করে দেবার ষড়যন্ত্রে সামিল হয়, ভেবে আকুল হই, প্রার্থনা করি এই মানবিক বোধহীন মানুষগুলো আয়নায় নিজের চেহারার সামনে দাঁড়িয়ে অথবা নিজের সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও নিজেকে নির্মোহ এবং মানবিক করুন। পৃথিবীর সব মানুষকে এই সত্যটুকু উপলব্ধি করা উচিৎ নিজের উপার্জিত সম্মান এবং সম্পদের উত্তরাধিকার যেমন সন্তানরা হয়, পাপকাজ ষড়যন্ত্র বা মানুষের বিরুদ্ধে অমানবিক আচরণের কারণেও সেই সন্তানরাও কোন না কোন ভাবে আক্রান্ত হয়।
করোনা কাল পেরিয়ে যাবে, নিশ্চয়ই একদিন আমরা মানুষেরা মানুষের পৃথিবীতে মানুষের মতোই বেঁচে থাকবো। ভালো হোক সকলের।
কয়েছ আহমদ বকুল
প্যারিস ১৩/০৪/২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০২০ ভোর ৬:০৬