করোনাকাহন ০১
করোনা মহামারির এই দূর্যোগকালের পরের পৃথিবীতে করোনা বিষয়ক প্রচুর গ্রন্থ প্রকাশিত হবে। অনেক লেখকই এই বেদনা সময়ের কাতর কাহিনী লিখে রাখবেন। এমন একটা অকস্মাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কে এই পৃথিবী দেখতে পাবে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টুকিটাকি অভিজ্ঞতা বা ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের বাহিরে করোনা নিয়ে বিশেষ ভাবে কিছু লিখতে ইচ্ছা করছিলো না। মূলত যেকোন খারাপ বা ভালো সময় কিংবা বাস্তবিক অভিজ্ঞতালব্দ আবেগঘন কোন বিষয় নিয়ে সরাসরি লিখতে আমার ভালো লাগে না। যতটা সম্ভব কবিতায় লিখি। কেউ বুঝে, কেউ না। অধিকাংশ সময়েই পরিচিতজন কবিতা এড়িয়ে চলেন, নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতিটুকু নিজের থেকে যায়, ভালো লাগে।
কেন তবে করোনা নিয়ে এবার একটি বড় লেখা লিখতে বসতে হলো? মনে হচ্ছে এই জীবনের সবচেয়ে জটিল একটা সময় পার করছি আমি। খারাপ সময় বলবো না। করোনা মহামারি যেভাবে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে এবং মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তাকে বিশেষ ভাবে এক ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য খারাপ বলা যাবেনা। সামগ্রিক ভাবে মানব সভ্যতার জন্যেই একটি জঘন্যতম সময় এটি। আমার ক্ষেত্রে জটিল বিভিন্ন কারণে। এই কারণগুলোর অন্যতম হচ্ছে আমার বৃদ্ধ মা বাবা এই বিপন্ন বিপর্যস্ত সময়ে আমার কাছে নেই। আমি ইচ্ছা করলেও এই সময়ে তাঁদের কাছে যেতে পারবোনা বা তাঁদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবোনা। আগামী জুলাইতে তাঁদের সাথে আমার দেখা হবার কথা, এর মধ্যেই এই বৈশ্বিক দূর্যোগ।
চীনে করোনা প্রাদুর্ভাবের প্ৰথম দিক থেকেই গণমাধ্যমে নিয়মিত খবর দেখছিলাম। চীনে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের বিশেষ বিমানে বাংলাদেশে নিয়ে আসা বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাসও দিয়েছিলাম। তখন পর্যন্ত এই করোনা ভাইরাসের বর্তমান জীবনবিধ্বংসী রূপ নিয়ে বা বিশ্বময় ছড়িয়ে যাবার বিষয়ে ভাবতে পারিনি। ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার সংক্ৰমণ কিছুটা ধীরগতিতেই হয়েছিল। সবচেয়ে খারাপ ছিল এখানকার গণমাধ্যমের ভূমিকা। এমন একটি মারাত্মক ভাইরাস তাদের দিকে ধেয়ে আসছিলো, অথচ তাদের গণমাধ্যম বা বিশেষজ্ঞ মহলে তেমন কোন উৎকন্ঠা বা গবেষণা ছিল না । ইউরোপের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অবশ্যই আমাদের দেশের তুলনায় অনেক দুর্বল এবং অন্তর্মুখী। ফেইসবুক ইনস্টাগ্রাম বা স্নেপচ্যাটে ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক যোগাযোগের বাহিরে জনসচেতনতা বিষয়ক কার্যক্রম অনেক কম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা তো দূরের কথা করোনা ভাইরাস সংক্ৰমনরোধে ১২ মার্চ ফরাসি রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের মাধ্যমে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্টান বন্ধ ঘোষণা করার পরও এই দেশটির অধিকাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্টান বন্ধের মূল কারণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দলবদ্ধ ভাবে এদিক ওদিক চলাফেরা করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেভাবে অনেক আগে থেকেই জনসচেতনতা মূলক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এখানে অর্থাৎ ফ্রান্সে সেরকম প্রচারণা বা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বিষয়ক কোন ধরনের গবেষণা ছিলোনা। একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে বুঝতে পারলে হয়তোবা এই খারাপ সময়টাতে মা বাবার সাথে থাকার একটা বিশেষ পরিকল্পনা করা যেতো। যখন বাস্তব পরিস্থিতি আমরা বুঝতে পেরেছি তখন একটি আক্রান্ত দেশ থেকে বাংলাদেশে ফিরে ভাইরাস বাহক হবার ইচ্ছে আর করেনি।
মৃত্যু বিষয়টাকে আমার কেন জানি খুব ভয় করে না। ২০১৬ সালের অক্টবরের প্রথম সপ্তাহে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্যারিসের গনেশ হাসপাতালে আমি ৫ দিন গভীর পরিচর্যায় (আইসিইউ) ছিলাম। দেশে পরিবারকে পর্যন্ত জানতে দেইনি। ঘনিষ্ট বন্ধু শাহবাজপুর সামাজিক রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রিয়মুখ সমাজ সেবক আবুল হোসেন আলম সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখ আততায়ীর হাতে নিহত হবার পর আমার সেই শারীরিক বিপর্যয় হয়েছিল। আইসিইউতে শুয়ে আমার তখন খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছা করতো। আমার স্ত্রী সন্তান তখনো ফ্রান্সে আসেনি। নিশ্চিত মরে যাবো ভেবে কখনো হয়তো তাদের কথা ভাবতাম। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগতো এই ভেবে যে কিছু ভালো কবিতা লেখা এখনো বাকি। আজ করোনাময় পৃথিবী। ঘরের বাহিরে মৃত্যু অপেক্ষমান, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে মৃত্যু। কেন জানিনা আজও মৃত্যুকে ভয় করছে না খুব। কিন্তু সেই মন খারাপের অনুভূতি আজও কাজ করছে। কবিতা নয়, সন্তানদের ফ্রান্স নিয়ে আসতে না পারা নয়। আজ মনটা খারাপ হচ্ছে এই ভেবে যে দৈবভ্রমে যদি এই জীবনফুল এই অসময়ে ঝরে যায় আমার মৃতদেহটি আমার জন্ম গাঁও, আমার নাড়ি পুতা করমপুরে যাবেনা। একমুঠো মাটির স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা এই মানুষ জীবন কোন এক অচেনা আলো ঝলমল পরের শহরে হারিয়ে যাবে। মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান বলেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণে নিজের মৃত্যু পরবর্তী অবস্থানটা চিরকাল চেয়েছি বাংলাদেশে হোক করমপুরে হোক। পরিচিত ঘনিষ্টজনদের সকলে আমার সে আশার কথা স্বপ্নের কথা জানে। ভাইরাসকালে মৃত্যু হলে আমিও চাইনা আর দেহ হয়ে জন্ম ঘর ভাইরাস ফিরে যাক।
আজ ৩০ মার্চ। ১৪ মার্চ থেকে ফ্রান্সে লকডাউন বা জরুরি অবস্থা চলছে। সেদিন থেকেই স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে আছি। অসহায় বিজ্ঞান, অসহায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটাই নিরাময় কৌশল সবাইকে মানতে বাধ্য করছেন, ঘরে থাকা। অন্যের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা মানে মরণব্যাধি করোনা ভাইরাসকে এড়িয়ে চলা। গৃহবন্দী হয়েছি শনিবার রাতেই কিন্তু মঙ্গলবার সকালে ফ্রান্সে নতুন আসা এক বোনের হাসপাতালে এপয়েন্টম্যান্ট। ভাষাগত জটিলতায় অসহায় বোনটি দু সপ্তাহ আগেই তার ডাক্তারের পাশে বসে আমাকে দিয়ে কথা বলিয়ে হাসপাতালের ঐ এপয়েন্টমেন্টটি নিয়েছিলেন। ডাক্তার এপয়েন্টমেন্ট দেবার সময়ই শর্ত দিয়েছিলেন, ফোনে কথা বলা চলবেনা, ভাষা জানা কাউকে সাথে নিয়ে সেই এপয়েন্টম্যান্ট এটেন্ড করতে হবে। নিজে থেকেই বলেছিলাম আমি যাবো। ভেবেছিলাম আমার দুটি বোনও তো দেশে আছে, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তাদেরও কোন সাহায্যে কখনো এগিয়ে আসছে। কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণের এই চরম ঝুঁকির সময়ে বাচ্চাদের ঘর থেকে এভাবে বাহিরে যাওয়া কী উচিৎ হবে? প্রায় নির্ঘুম একটি রাত কাটিয়ে বউকে না জানিয়েই সকাল নয়টায় বের হই। পরিবহনগুলো সেদিনও মোটামোটি লোকময় ছিলো। কিন্তু ভয় ধরিয়ে দেয় হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ৩ ফুটের বেশি দূরত্বের প্রক্রিয়াটা সেদিন সেখানেই প্রথম প্রত্যক্ষ করে আসি। অবশ্য ওই বোনটির ডাক্তার মহিলা খুবই আন্তরিক একজন মানুষ ছিলেন। এপয়েন্টম্যান্ট শেষ হলে একটা ভূতুড়ে পরিবেশের মধ্য দিয়ে ঘরে ফিরে আসি। সেই থেকে ঘরে আছি। বন্দি আছি। ভালো আছি অদ্যাবধি।
প্যারিস, ফ্রান্স থেকে
৩০ জুলাই ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২০ ভোর ৬:৩১