অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা কিংবা বৃহত্তর বাংলাদেশ একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ কেন্দ্রিক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক মতবাদ যা দক্ষিণ এশিয়ার সকল বাংলা ভাষাভাষী মানুষের একটি কেন্দ্রীভূত স্বাধিন বাঙালি রাষ্ট্র ব্যবাস্থার দাবি করে । বাঙালি জাতীয়তাবাদী রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজ্রুল ইসলাম, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, মাওলানা ভাসানি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এরা সকলে প্রখ্যাত বাঙালি একটি অবিভক্ত স্বাধিন বাংলা প্রজাতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ হল একটি রাজনৈতিক অভিব্যক্তি যার মাধ্যমে প্রাচিন কাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসরত বাঙালি জাতি , তথা বাংলা ভাষাগত অঞ্চলের অধিবাসীদের বুঝানো হয়ে থাকে। বাঙালি জাতি উপমহাদেশের একটি অন্যতম জাতীয়তাবাদী চেতনায় প্রভাবিত এক প্রভাবশালী জাতি। বাঙালি জাতীকে উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রুপকার বলা হয়ে থাকে।
অবিভক্ত বাংলা পরবর্তীতে ব্রিটিশ চক্রান্তে বিভক্ত করা হয়। প্রাচীন বঙ্গদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম ও আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায়ের একতাবদ্ধ জাতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ধারনাকে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা বা বৃহত্তর বাংলাদেশ বলা হয়ে থাকে যাদের ইতিহাস অন্তত চার হাজার বছরের পুরোনো
ব্রিটিশ রাজ ভারতে ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ প্রেরন করলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সে সময় বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আনুষ্ঠানিকভাবে অবিভক্ত বাংলাকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র করার এক পরিকল্পনা পেশ করেন।নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসুও তার সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্রের এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালের ২৬শে এপ্রিল ইংরেজ বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সাথে এক সভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উত্থাপন করেন অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি তার সেই পরিকল্পনার পক্ষে সমর্থন সৃষ্টির জন্য মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকে দুমাস সময় চেয়ে নেন। মাউন্টব্যাটেন তাকে জানান যে তিনি দেশ বিভাগের বিরুদ্ধে তবে ঐক্যবদ্ধ ভারত না হলে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবকেই তিনি অগ্রাধিকার দেবেন। ওইদিনই কায়েদে আজম জিন্নাহর সাথে সাথে মাউন্টব্যাটেনের এক বৈঠক হয়। সে বৈঠকে তিনি জিন্নাহকে জানান সোহরাওয়ার্দি তাকে বলেছেন যে ভারত বা পাকিস্তান কারো সাথে যোগ দেবে না এই শর্তে অবিভক্ত বাংলা থাকা সম্ভব। জিন্নাহ ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব সমর্থন করেন।
মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী যাবার পথে ৪৭ সালের ৯ই মে কোলকাতায় আসলে তার সাথে অবিভক্ত বাংলার অন্যতম মূল প্রস্তাবক শরৎচন্দ্র বসু আলোচনা করেন। তার পরের দিন মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম, মহাত্মা গান্ধীর সাথে অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাব নিয়ে আলাপ করেন।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা সৃষ্টির জন্য ১৯৪৭ সালের ২০শে মে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টির নেতা শরৎচন্দ্র বসুর বাড়িতে নেতা পর্যায়ে একটি ত্রিদলীয় আলোচনা সভা হয়। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দি, মুহম্মদ আলী, ফজলুর রহমান, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম,
আব্দুল মালেক, অবিভক্ত বাংলার কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা কিরণশঙ্কর রায়, সত্যরঞ্জন বক্সী এবং শরৎ বসু। সে সভায় আবুল হাশিম এবং শরৎ বসু সবার সাথে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিরণশঙ্কর রায় কংগ্রেস পার্টির দলের ঘোষিত নীতির বিরোধিতা করে এই প্রস্তাবের সাথে যুক্ত হন। সোহরাওয়ার্দি এবং আবুল হাশিম একইভাবে মুসলিম লীগের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে কাজ করেন। সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর মধ্যে বাংলার সার্বভৌম মর্যাদা কি হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু তাদের উভয়েরই প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বাংলা প্রদেশের বিভক্তি রোধ করা।
কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম তাদের পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রদেশের হিন্দু নেতাদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। সোহরাওয়ার্দী নানা সময়ে বিষয়টি নিয়ে ফ্রেডারিক বারোজ, জিন্নাহ এবং মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তাদের সঙ্গে তার সন্তোষজনক আলোচনাও হয়। শরৎ বসু মার্চে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি (AICC) কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিরণশঙ্করের বিশ্বাস ছিল যদি মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ হিন্দুদের জন্য এমন কিছু প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেন তাহলে প্রদেশটির অখন্ডতা রক্ষা পেতে পারে। ১৯৪৭ এর মে মাসের গোড়ার দিক থেকে অবিভক্ত বাংলার পক্ষপাতীরা একে অন্যের কাছাকাছি আসেন। কলকাতায় গান্ধীর সফরকালে তারা তাদের প্রস্তাব নিয়ে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন এবং তার পরামর্শ কামনা করেন। তারা তাদের অভিমত সম্পর্কে কংগ্রেস এবং লীগ শীর্ষ নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন।
১৯৪৭ এর ২০শে মে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার পক্ষপাতী নেতাদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির শর্তগুলি ছিলঃ
১। বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারণ করবে।
২। স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের সংবিধানে যুক্ত নির্বাচন এবং বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে আর সে সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান জনসমষ্টির সংখ্যানুপাতে আসন সংরক্ষিত থাকারও ব্যবস্থা থাকবে। হিন্দু এবং তফশিলি হিন্দুদের আসনগুলি তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের জনসমষ্টির অনুপাতে তাদের জন্য বণ্টনের ব্যবস্থা থাকবে কিংবা এমন ভাবে সে ব্যবস্থা করা হবে যাতে উভয় সম্প্রদায়ের সম্মতি থাকবে। নির্বাচনী এলাকাগুলি হবে কার্যত বহু নির্বাচনী এলাকা এবং ভোট হবে বণ্টন অনুসারে, সামগ্রিক নয়। নির্বাচন চলাকালে কোনো প্রার্থী তার নিজ সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেলে এবং একইভাবে প্রদত্ত অন্য সম্প্রদায়গুলির ২৫ শতাংশ ভোট পেলে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। যদি কোনো প্রার্থী এ শর্তাবলি পূরণ না করতে পারেন তাহলে যিনি তার সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পাবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন।
৩। স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে ও বাংলা বিভক্ত করা হবে না এ মর্মে ব্রিটিশ রাজকীয় সরকারের ঘোষণার পর বাংলার বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেওয়া হবে। তদস্থলে একটি নতুন অন্তবর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। এ মন্ত্রিসভায় মুসলিম এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের (তফশিলি হিন্দু ও হিন্দুসহ) সমান সংখ্যক সদস্য থাকবেন। তবে মুখ্যমন্ত্রী এ হিসেবের বাইরে থাকবেন। এ মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলিম এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু।
৪। নতুন সংবিধানের আওতায় একটি আইন পরিষদ এবং একটি মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত পর্যায়ে গঠিত হওয়া সাপেক্ষে ইত্যবসরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন (তফশিলি হিন্দুসহ) ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন চাকরিতে সমান অংশের অধিকারী হবেন। আর এসব চাকরি-বাকরি করবেন বাঙালিরা।
৫। গণপরিষদ ৩০ জন বাক্তিকে নিয়ে গঠিত হবে। এদের মধ্যে ১৬ জন হবেন মুসলিম ও ১৪ জন অমুসলিম। ইউরোপীয়রা ছাড়া ব্যবস্থাপক পরিষদের মুসলিম এবং অমুসলিম সদস্যরা তাদেরকে নির্বাচিত করবেন।
নিজেদের মধ্যে এক সমঝোতায় উপনীত হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী, কিরণশঙ্কর রায় এবং শরৎচন্দ্র বসু তাদের এ পরিকল্পনার পরীক্ষামূলক চুক্তির শর্তগুলির ব্যাপারে কংগ্রেস ও লীগ হাই কমান্ডের অনুমোদন আদায়ের চেষ্টা করেন। তবে কংগ্রেস এবং লীগ নেতাদের মধ্যে তৎকালে বিরাজমান ভুল বোঝাবুঝি ও পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে এ সমঝোতার প্রণেতারা দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কংগ্রেস এবং লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতারা চুক্তির শর্তগুলির সরাসরি নিন্দা করেন। কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক সংবাদপত্র ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের খাজা গ্রুপের সংবাদপত্রগুলি চুক্তির শর্তগুলির বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান শুরু করে। খাজা গ্রুপের এ ধারণা হয় যে এ চুক্তির অর্থ হবে হিন্দুদের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ, আর কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা নেতাদের মতে এ চুক্তিটি পাকিস্তানের সীমানা সম্প্রসারণের একান্ত লক্ষ্যেই করা হয়েছে।জাতি হিসেবে বাংলার নিজস্ব সত্তার অব্যাহত বিকাশের পথে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রবল বাধা হয়ে ওঠে। বিগত কয়েক শতকে এ অঞ্চলে কারুশিল্প, নির্মাণ এবং শিল্প কারখানা, শিক্ষা ও প্রশাসন ক্ষেত্রে যাবতীয় অর্জন ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শিক্ষা, প্রশাসন ও অর্থনৈতিক নানা নীতির মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন দেশে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চালু করে। ঔপনিবেশিক পরিবর্তনগুলো বিগত কয়েক শতকে গড়া-ওঠা সামাজিক কাঠামোকে দুর্বল করছিল, এমন কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাকে ধ্বংসও করে দিয়েছিল। উনিশ শতকের ঘটনাবলি এক ধরনের বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলে।
ব্রিটিশ দের ভারত ত্যাগ
আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নজনিত সমস্যার সমাধানে একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মে দেশবিভাগের প্রশ্নটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
তথ্যসূত্র: Huseyn Shaheed Suhrawardy : His Life
An interview with prof. Ahmed sharifColonialism, politics...
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১০:২৫