সিরাজউদ্দৌলার পতনের পেছনে প্রধান কারণ ছিল কুসিদজীবী মহাজন শ্রেণীর হিন্দুদের ইংরেজের সঙ্গে সহযোগীতা। আর তখন তার সঙ্গে একইসময় যুক্ত হয় ইংরেজদের কুটকৌশল। সিরাজউদ্দৌলার পতনে বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য আশাভঙ্গের কারণ হয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বছর হচ্ছে ১৭৯৩ সাল। সে সময় ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করে ছিলেন। সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির খাজনা এবং রাজস্ব আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়।আর তখন সেই বিশেষ পদ্ধতির ফল হিসেবে মুসলমানদের ভূস্বামীগত অধিকার কৌশলে বিলুপ্ত করা হয় এবং মুসলমান জমিদারদের হিন্দু আমলা এবং গোমস্তারা ক্রমান্বয়ে সেসব জমিদারি আত্মসাত করেন আর প্রতাপশালী জমিদারে পরিনত হতে থাকেন বা হন।সবদিকদিয়ে মুসলমানরা স্বত্বহীন অসহায় মানবগোষ্টিতে পরিনত হন। আর এর পর সিপাহী বিদ্রোহের ব্যার্থতা মুসলমানদের জন্য আরো চরম সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।সেই তিনটি ঘটনাই ইংরেজ রাজত্বে মুসলমানদের অসহয়তা প্রমানিত করে। মুসলমানরা রাজশক্তি হারায়। আর একই সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে তাদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং ইংল্যান্ডের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করার জন্য রাজস্ব এবং জমিদারি ব্যবস্থার যেসব সংস্কার করল তার সবই গেল মুসলমানদের স্বার্থের প্রতিকূলে।চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তনের ফলে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিস্কর বা লাখেরাজ ওয়াকফ জমির বাজেয়াপ্তির ফলে মুসলমানরা কপর্দকহীন নিঃস্ব হলো এবং মুসলমান জমিদারদের হিন্দু তহশিলদার নায়েব মুহরি এবং গোমস্তা ইংরেজদের কৃপা অনুগ্রহে ভূস্বামীর অধিকার লাভ করে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের উপর আরেকটি আঘাত এল যখন লর্ড বেন্টিংক ফার্সির পরিবর্তে এদেশে ইংরেজিকে রাজভাষা হিসাবে ঘোষনা করেন। দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে তার ফলে যে পরিবর্তন এল তা সুদুরপ্রসারী ছিল। কিন্তু মারাত্মক সর্বনাশ হলো ভাষা এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য। মুসলমানদের যখন এমন অবস্থা তখন কিন্তু বাঙ্গালী হিন্দুরা আপনা স্বার্থ চিন্তায় সুপরিকল্পিতভাবে ইংরেজদের সহযোগীতা করেন।
১৮০১সালে যখন সিভিলিয়ানদের বাংলা শিক্ষা দেয়ার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং হিন্দুদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শিক্ষকতা করতে গিয়ে এবং বাংলা গদ্যসৃষ্টিকে উপলক্ষ করে কোলকাতার মান্যগণ্য প্রতাপশালী হিন্দুদের সঙ্গে ইংরেজদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ঘটে।হিন্দু কলেজে বাঙ্গালী হিন্দুরা লেখাপড়া করতে থাকেন এবং ইংরেজি শিক্ষায় মনোনিবেশ করে। সে সমস্ত ঘটনা পরম্পরায় প্রমানিত হয় যে উনিশ শতকের সূচনা থেকেই হিন্দুরা ইংরেজদের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগীতা করেছিলেন। রাজস্ব সংস্কারের ফলে ইংরেজদের আশাতীত লাভ হয়েছিল এবং বাংলাদেশের টাকা এবং কাঁচামালের সাহায্যে ইংল্যান্ডের ডান্ডী, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার প্রভৃতি বাণিজ্য প্রধান শহরগুলোর দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালী হিন্দুদের ভাগ্যেরও দ্রুত পরিবর্তন হয় এবং এদেশে প্রতাপশালী নতুন হিন্দু জমিদার শ্রেণী প্রতিষ্ঠিত হয়।উনিশ শতকে কিছু মুসলমান তাদের উপর যে অন্যায় আচরণ হচ্ছে সেজন্য বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং সেজন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তেও দ্বিধা করেননি। সেক্ষেত্রে তীতুমীরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূলত তীতু মিয়ার আন্দোলনের সূত্রপাত ছিল মুসলমান সমাজের জন্য একটি সংস্কার আন্দোলন। সেই সংস্কার আন্দোলনকে ফরায়জী আন্দোলন বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা এবং নদীয়া জেলাকে কেন্দ্র করে তীতুমীর তার আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। সেই সংস্কার আন্দোলনে হাত দিতে গিয়ে তীতুমীরকে হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। এবং সংঘর্ষ ক্রমশ ব্যাপক আকার ধারন করে হিন্দুরা তীতুমীরের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে ইংরেজদের সহায়তা কামনা করে। তখন তীতুমীরকে বাধ্য হয়ে স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নারকেলবাড়িয়ায় একটি স্বাধীন সরকারের প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
ইংরেজ সরকার তখন বিচলিত বোধ করেন। বারাসাতের সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার তীতুকে দমন করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হন। শেষ পর্যন্ত তীতুকে দমন করবার জন্য মেজর স্কট নামক একজন ইংরেজ কোলকাতা থেকে একটি পদাতিক বাহিনী নিয়ে তীতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। তীতুমীর বাঁশের কেল্লা তৈরি করে দুর্ধর্ষ ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং ১৮৩১ সালের ২২ শে নভেম্বর শহীদ হন।ফরাজী আন্দোলন শুরুতে কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। সে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান সমাজে ধর্মীয় আচরনের ক্ষেত্রে যেসব ভ্রান্তি অনুপ্রবেশ করেছে সেগুলোর সংশোধন করা কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে হিন্দু জমিদারগণ সে আন্দোলনকে তাদের ক্ষমতা থেকে উতখাত করার আন্দোলন হিসাবে বিবেচনা করেন। যার ফলে শেষ পর্যন্ত ফারাজী আন্দোলনটা একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিনত হয়ে যায়।
সূত্র ইন্টারনেট।
অতঃ আমার লেখাগুলো বা পোস্টগুলো ইতিহাস বিষয়গুলো বোঝা,জানা,এবং আলোচনার প্রেক্ষাপত । অন্তত কোন
ব্লগার ভাই বোন এবং রাজনীতির নেতা কর্মীদের ব্যক্তি আঘার্ত করার জন্য নয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৪:০১