ম্যাসিডনের তৃতীয় আলেকজান্ডার যিনি মহান আলেকজান্ডার বা আলেক্সান্দ্রোস হো মেগাস নামে জগদ্বিখ্যাত ছিলেন । তাছাড়াও তিনিই ম্যাসিডন নামক প্রাচীন গ্রিক রাজ্য শাসনকারী আর্গিয়াদ রাজবংশের একজন রাজা। ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পেল্লা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন আলেকজান্ডার মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তার পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের স্থলাভিষিক্ত হন। তার শাসনকালের অধিকাংশ সময় তিনি উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়া জুড়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে তিনি মিশর থেকে উত্তর পশ্চিম ভারত পযন্ত প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই অপরাজেয় সমরবিদ ইতিহাসের অন্যতম সফল সেনানায়ক হিসেবে পরিগণিত হন।প্রথম জীবনে ষোল বছর বয়স পযন্ত আলেকজান্ডার দার্শনিক অ্যারিস্টটলের নিকট শিক্ষালাভ করেন। ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় ফিলিপকে হত্যা করা হলে আলেকজান্ডার পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি পিতার স্বপ্নপূরণের উদ্দেশ্যে পারস্য অভিমুখে সেনাবাহিনী পরিচালনা করেন।৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন । আনাতোলিয়া শাসন করেন এবং এরর দশ বছর ব্যাপী পরপর সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তার ফলে ইসাস এবং গগ্যামিলা প্রভৃতি স্থানে অনুষ্ঠিত ব্বশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে পারস্যের শক্তি বিনষ্ট হলে তার সাম্রাজ্য আড্রিয়াটিক সমুদ্র থেকে সিন্ধু নদ পর্য্যন্ত বিস্তৃত হয়।পৃথিবীর শেষপ্রান্তে পৌছনোর স্পৃহায় তিনি ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারত অভিযান শুরু করেন কিন্তু তার সেনাবাহিনীর দাবীর কারণে ফিরে যেতে বাধ্য হন। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলন শহরে তার মৃত্যু হলে তার সেনাপতি ও উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকটি গৃহযুদ্ধে তার অধিকৃত সাম্রাজ্য বহু খন্ডে ভেঙে যায়।
আলেকজান্ডার ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক মাস হেকাতোম্বাইওনের ষষ্ঠ দিনে বা ২০শে জুলাই ম্যাসিডন রাজ্যের পেল্লা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ম্যাসিডনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ এবং তার চতুর্থ স্ত্রী অলিম্পিয়াসের পুত্র ছিলেন। দ্বিতীয় ফিলিপের সাত বা আটজন পত্নী থাকলেও আলেকজান্ডারের জন্মদাত্রী হওয়ার কারণে অলিম্পিয়াস ফিলিপের প্রধানা পত্নী ছিলেন।
আলেকজান্ডারের জন্ম নিয়ে বেশ কিছু কল্পকথা প্রচলিত রয়েছে। গ্রিক জীবনীকার প্লুতার্কের রচনানুসারে ফিলিপের সঙ্গে বিবাহের দিনে অলিম্পিয়াসের গর্ভে বজ্রপাত হয়। বিবাহের কয়েকদিন পর ফিলিপ একটি স্বপ্নে দেখেন যে অলিম্পিয়াসের যোনিদ্বার সিংহের ছাপযুক্ত একটি শীলমোহর দ্বারা বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। প্লুতার্ক এই সমস্ত অলৌকিক ঘটনার বেশ কিছু ব্যাখ্যা দেন এই ভাবে যে অলিম্পিয়াস বিবাহের পূর্ব হতেই গর্ভবতী ছিলেন এবং আলেকজান্ডার জিউসের সন্তান ছিলেন। যদিও ঐতিহাসিক ইতিহাসবেত্তাদের মতে উচ্চাকাঙ্খী অলিম্পিয়াস আলেকজান্ডারের ঐশ্বরিক পিতৃত্বের কাহিনী প্রচলিত করেন। আলেকজান্ডারের জন্মের দিন ফিলিপ পটিডিয়া অবরোধের পরিকল্পনা করছিলেন। সেই দিনই তিনি তার সেনাপতি পার্মেনিয়ন দ্বারা ইলিরিয়া এবং পীওনিয়া রাজ্যের সেনাবাহিনীর পরাজয়ের ও অলিম্পিক গেমসে তার অশ্বের জয়লাভের সংবাদ লাভ করেন। আলেকজান্ডারের জন্মদিবসের প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য হিসেবে পরিগণিত আর্তেমিসের মন্দির ভস্মীভূত হয়। আর্তেমিস আলেকজান্ডার জন্ম উদযাপন করতে যাওয়ায় এই ঘটনা ঘটে বলে কল্পকাহিনী প্রচলিত হয়। আলেকজান্ডারকে অতিমানবিক ও মহান কার্য্যের জন্য নির্দিষ্ট হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্যে তার সিংহাসনলাভের পর সেই সমস্ত অলৌকিক কাহিনীর প্রচলন করা হয় বলে মনে করা হয়ে থাকে।
আলেকজান্ডারের শিক্ষা লাভ
শৈশবে আলেকজান্ডারকে লানিকে নামক একজন সেবাব্রতী পালন করেন। পরে অলিম্পিয়াসের আত্মীয় লিওনাইদাস এবং দ্বিতীয় ফিলিপের সেনাপতি লুসিম্যাকোস শিক্ষাপ্রদান করেন। অন্যান্য সম্ভ্রান্ত ম্যাসিডনীয় কিশোরদের মতই তাকে পড়া, যুদ্ধ করা, শিকার করা প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। তেরো বছর বয়স হলে দ্বিতীয় ফিলিপ আলেকজান্ডারের শিক্ষার জন্য আইসোক্রাতিস এবং স্পিউসিপাস নামক দুইজন গ্রিক শিক্ষাবিদকে গণ্য করেন কিন্তু তারা সেই কাজে অস্বীকৃত হন। অবশেষে দ্বিতীয় ফিলিপ গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলকে আলেকজান্ডারের শিক্ষক হসেবে নিযুক্ত করেন এবং মিয়েজার মন্দিরকে শ্রেণীকক্ষ হিসেবে প্রদান করেন। আলেকজান্ডারকে শিক্ষাপ্রদান করায় দ্বিতীয় ফিলিপ অ্যারিস্টটলের শহর স্তাগেইরা পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। তিনি সেই শহরের সকল প্রাক্তন অধিবাসী যারা দাস হিসেবে জীবনযাপন করছিলেন তাদের মুক্ত করেন এবং নির্বাসিতদের শাস্তি মুকুব করেন। মিয়েজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলেকজান্ডারের সাথে প্রথম টলেমি সোতের, হেফাইস্তিওন, কাসান্দ্রোস ইত্যাদি ম্যাসিডোনিয়ার সম্ভ্রান্ত পরিবারের কিশোরেরা শিক্ষালাভ করেন । যাদের মধ্যে অধিকাংশই পরবর্তীকালে আলেকজান্ডারের বন্ধু এবং সমর অভিযানের সেনাপতি হিসেবে পরিগণিত হন। অ্যারিস্টটল তাদের চিকিৎসাবিদ্যা, সর্শন, নীতি, ধর্ম, তর্কবিদ্যা ও কলা সম্বন্ধে শিক্ষাপ্রদান করেন। তার শিক্ষায় আলেকজান্ডারের হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যের প্রতি প্রগাঢ় প্রেমের উন্মেষ ঘটে যা তিনি তার ভবিষ্যতের সকল অভিযানে সঙ্গে নিয়ে যেতেন।
ষোল বছর বয়সে অ্যারিস্টটলের অধীনে আলেকজান্ডারের শিক্ষালাভ শেষ হয়। সে সময় দ্বিতীয় ফিলিপ তাকে রাজপ্রতিনিধি এবং উত্তরাধিকারী হিসেবে নিয়োগ করে বাইজেন্টিয়ন আক্রমণ করেন। ফিলিপের অনুপস্থিতিতে থ্রেস অঞ্চলের মাইদোই জনজাতিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে আলেকজান্ডার দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে যাত্রা করে তাদের বিতাড়িত করেন ও তাদের অঞ্চলে আলেকজন্দ্রোপোলিস মাইদিকা নামক একটি নগরীর পত্তন করেন।ফিলিপ তার অভিযান থেকে ফিরে এলে তিনি আলেকজান্ডারকে দক্ষিণ থ্রেস অঞ্চলে একটি বিদ্রোহ দমন করতে পাঠান। সে সময় পেরিন্থাস নামক একটি গ্রিক শহরের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় আলেকজান্ডার তার পিতার জীবনরক্ষা করেন। ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিলিপ এবং আলেকজান্ডার বহু কষ্টে থিবসের নিকট হতে থার্মোপেলি অধিকার করে আরো দক্ষিণে ইলাতেইয়া নগরী অভিমুখে অভিযান শুরু করেন। এথেনীয়দের পক্ষে দিমোস্থেনিস ম্যাসিডোনীয়দের বিরুদ্ধে থিবসের সহযোগিতা প্রার্থনা করলে ফিলিপ থিবসের দিকে মিত্রতার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু এথেন্সের সঙ্গে থিবসের মিত্রতা স্থাপিত হলে ফিলিপ অ্যাম্ফিসা নগরী অধিকার করেন। তারপর ইলাতেইয়া নগরী অভিমুখে পুনরায় যাত্রা শুরু করে শান্তি প্রস্তাব করলে এথেন্সের সঙ্গে থিবস উভয়েই এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন।ফিলিপ দক্ষিণে যাত্রা শুরু করলে তার প্রতিপক্ষরা তাকে কাইরেনিয়া নামক স্থানে প্রতিহত করেন এবং যুদ্ধে ফিলিপ ডানদিক হতে ও আলেকজান্দার বামদিক হতে আক্রমণ পরিচালনা করেন। দ্বিতীয় ফিলিপ ইচ্ছাকৃত ভাবে পিছু হটে এথন্সের সমর অনভিজ্ঞ যোদ্ধাদের প্রলুব্ধ করে তাদের প্রতিরক্ষা ভেঙে ফেলেন। অন্যরদিকে আলেকজান্ডার এবং ফিলিপের সেনাপতিরা থিবসের প্রতিরক্ষা ভাঙ্গতে সক্ষম হন। তারপর তাদের দিকে আক্রমণ শুরু করে প্রথমে এথেনীয়দের পরাজিত করে থিবসের সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলে তাদের পরাজিত করা হয়।সে জয়লাভের পর দ্বিতীয় ফিলিপ তাদের অভিযান স্পার্টা শহর পর্য্যন্ত বজায় রাখেন ও স্পার্টা ব্যতীত প্রত্যেক শহরে সম্মানের সঙ্গে তাদের স্বাগত জানানো হয়। করিন্থ শহরে দ্বিতীয় ফিলিপ স্পার্টা ব্যতীত প্রত্যেক গ্রিক শহরের সঙ্গে একটি স্বর্গীয় মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করেন যার ফলে তাকে সেই মিত্রগোষ্ঠীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে গণ্য করা হয়।
ছবি তথ্য উইকি পডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১:৩৬