আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধ বা আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধ ছিল গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আমেরিকার তের উপনিবেশের বিদ্রোহ। তার ফলেই আজকের যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। প্রথমে সে লড়াই শুধু উপনিবেশে সীমাবদ্ধ থাকলেও ফরাসি এবং স্প্যানিশদের আগমনের ফলে তা ইউরোপ, ক্যারিবীয় ও ইস্ট ইন্ডিজে ছড়িয়ে পড়ে ।ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক কর আরোপের কারণে মূলত সে যুদ্ধটি শুরু হয়েছিল। সেই করকে আমেরিকানরা বেআইনি হিসেবে দেখত। ১৭৭৪ সালে সাফোক রিসলভস ম্যাসাচুসেটস বে প্রদেশের রাজকীয় সরকার অধিকার করলে বিদ্রোহ শুরু হয়। তার ফলে সৃষ্ট উত্তেজনার ফলে পেট্রিওট মিলিশিয়া এবং ব্রিটিশ নিয়মিত সেনাবাহিনীর মধ্যে ১৭৭৫ সালে লেক্সিংটন ও কনকর্ডের যুদ্ধ সংঘটি হয়েছিল। ১৭৭৬ সালের বসন্ত নাগাদ পেট্রিওটরা ১৩ টি উপনিবেশে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেন এবং ১৭৭৬ সালের ৪ জুন কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
তার মধ্যে ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করার জন্য বৃহৎ আকারে সেনা সমবেত করেন। আমেরিকান বিদ্রোহী সেনাদের বিরুদ্ধে তারা গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেন। এসময় জর্জ ওয়াশিংটন তার নেতৃত্বে ছিলেন। ১৭৭৬ সালে নিউ ইয়র্ক এবং ১৭৭৭ সালে ফিলাডেলফিয়া জয় করা হয়। কিন্তু তারা ওয়াশিংটনের বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত কোনো হামলা করতে সক্ষম হননি। ব্রিটিশদের কৌশল আমেরিকান অনুগতদের চালনা করার উপর নির্ভর করে চলছিল। সামঞ্জস্যের দুরবস্থার কারণে ১৭৭৭ সালে আলবেনির বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের অগ্রযাত্রা ব্যহত হয়।ফ্রান্স ও স্পেন এবং ডাচ প্রজাতন্ত্র ১৭৭৬ সালের শুরুতে গোপনে বিপ্লবীদেরকে রসদ ও অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে। সারাটোগায় আমেরিকানদের বিজয়ের ফলে ব্রিটেন উপনিবেশে পূর্ণ স্বশাসনের প্রস্তাব করেন। কিন্তু আমেরিকানদের আপোস থেকে বিরত রাখার জন্য ফ্রান্স যুদ্ধে প্রবেশ করে। ১৭৭৯ সালে তাদের মিত্র স্পেনও এতে যোগ দেন। ফ্রান্স এবং স্পেনের যোগদান বিজয়সূচক ছিল। তারা স্থল ও নৌ ক্ষেত্রে আমেরিকানদের সহায়তা দেন এবং ব্রিটিশদেরকে উত্তর আমেরিকা থেকে হটিয়ে দেন।
১৭৭৮ সালের পর ব্রিটিশরা দক্ষিণ উপনিবেশগুলোতে মনোনিবেশ করে এবং ১৭৭৯ ও ১৭৮০ সালে জর্জিয়া এবং সাউথ ক্যারোলিনা জয় করতে সক্ষম হয়। ১৭৮১ সালে ব্রিটিশরা ভার্জিনিয়া দখলের চেষ্টা চালায় কিন্তু ফরাসি নৌ বিজয়ের ফলে ফরাসি আমেরিকানদের কর্তৃক ইয়র্কটাউন অবরোধ করা হয় এবং ৭০০০ এর বেশি ব্রিটিশ সৈনিককে বন্দী করা হয়। তার ফলে যুদ্ধ এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ব্রিটেনের ইচ্ছায় পরিবর্তন আসে। ১৭৮২ সাল পর্যন্ত সীমিত আকারে লড়াই চলতে থাকে। ১৭৮৩ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিসের চুক্তি মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং বর্তমানকালের হিসেবে উত্তরে কানাডা, দক্ষিণে ফ্লোরিডা এবং পশ্চিমে মিসিসিপি নদী দ্বারা চিহ্নিত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়। পক্ষগুলো বৃহৎ পরিসরে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিতে একমত হয় যাতে কয়েকটি অঞ্চল বিনিময় করা হয়। ব্যয়বহুল যুদ্ধ ফ্রান্সকে বড় অঙ্কের ঋণগ্রস্ত করে। তার ফলেই পরবর্তীতে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়।
ফরাসি বিপ্লব এর ইতিহাস
ফরাসি বিপ্লব ছিল ফরাসি ও ইউরোপ এবং পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। সেই বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং একই সাথে দেশের রোমান ক্যাথলিক চার্চ সকল গোঁড়ামী ত্যাগ করেন এবং নিজেকে পুনর্গঠন করতে বাধ্য হন। ফরাসি বিপ্লবকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি জটিল সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যার মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতা নিরঙ্কুশ রাজনীতি ও অভিজাততন্ত্র থেকে নাগরিকত্বের যুগে পদার্পণ করে।
ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি ছিল Liberté, égalité, fraternité, and “ou la mort!" এর অর্থ হল স্বাধীনতা ও সমতা এবং ভ্রাতৃত্ব অথবা মৃত্যু। এই শ্লোগানটিই বিপ্লবের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছিলো যার মাধ্যমে সামরিক এবং অহিংস উভয়বিধ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই শ্লোগানটি তখন সকল কর্মীর প্রাণের কথায় পরিণত হয়েছিলো।
ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক প্রকৃইতিকে ইতিহাসবিদরা স্বীকার করেননা। কারণ সম্বন্ধে একটি ধারণায় বলা হয় অ্যানসিয়েন সরকারের প্রাচীন অভিজাত নীতি এবং আইনসমূহ একটি উদীয়মান বুর্জোয়াতন্ত্রের উচ্চাভিলাষের খোরাক যোগাতে শুরু করে যা আলোকসম্পাতের দ্বারা ছিলো ব্যাপকভাবে আক্রান্ত।সেই বুর্জোয়ারা শহরের বিশেষত প্যারিস এবং লিওনের চাকুরিজীবী এবং অত্যাচারিত চাষী শ্রেণীর সাথে মিত্রতা সৃষ্টি করেন। আরেকটি ধারণা অনুসারে অনেক বুর্জোয়া এবং অভিজাত মহল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা করতে থাকেন যা পরবর্তীতে চাকুরিজীবী শ্রেণীর আন্দোলনগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে যায়। তার সাথে এক হয় প্রাদেশিক চাষীদের আন্দোলন। এই ধারণা অনুসারে তাদের মধ্যে কোন মূলবন্ধন কেবল ঘটরাক্রমে হয়েছে তা কোন পরিকল্পিত ছিলোনা।যে ধারণাকেই ধরা হোক না কেন অ্যানসিয়েন সরকারের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিলো যা বিপ্লবের মূল হিসেবে পরিগণিক হতে পারে। একদিক দিয়ে সেগুলো ছিলো অর্থনৈতিক কারণও।নিম্নমানের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বল্গাহীন জাতীয় ঋণ। তার মূল কারণ ছিল অসম করারোপন যার বোঝা মোটেই বহনযোগ্য ছিলনা । সম্রাট লুই ১৬-এর অত্যধিক খরচ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর বিভিন্ন যুদ্ধসমূহ।বেকারত্বের উচ্চহার এবং খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য।বিপ্লবের ঠিক আগের মাসগুলোতে বিরাজমান খাদ্য সংকট।
অন্যদিকে তার পিছেন কিছু সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারনও ছিল। আলোকিত সমাজ সেই কারণগুলোকে কেন্দ্র করেই তাদের
আন্দোলন শুরু করে যারা ছিল আলোকসম্পাতের যুগ দ্বারা প্রভাবিত। সেই কারণগুলো হলঃ
১।নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের পুনঃস্থাপন যা রাজত্বের পক্ষে ছিল ক্ষতিকর।
২।সমাজের একটি বিশেষ পেশাদার শ্রেণী এবং উঁচুশ্রেণীর লোকদের ব্যাপক সুবিধা দেয়া হচ্ছিলো যা জনসাধারণের জীবনকে নিজের প্রভাবাধীনে রাখতে শুরু করেছিলো।
৩।কৃষক ও চাকুরিজীবী শ্রেণী এবং কিছু পরিমাণ বুর্জোয়া কর্তৃক জমিদারতন্ত্রের উচ্ছেদের পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়।
৪।বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারীর মধ্যে সুযোগ সুবিধার বৈষম্য ও যাজকশ্রেণীর ভোগ বিলাস চরমে উঠে। অপরদিকে ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে একটি জোয়ার সৃষ্টি হয়।
৫।স্বাধীনতা এবং প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের অনুপ্রেরণা।
সবশেষে যে কারণ সম্বন্ধে বলতে হয় তা হল এই সমস্যাগুলোর যেকোনটির সমাধানে সম্রাট লুই ১৬-এরv চূড়ান্ত ব্যর্থতা।
ফ্রান্সের সম্রাট লুই ১৬ যখন রাজকীয় অর্থের সংকটে পড়েন, তখনই বৈপ্লবিক সংকটকাল শুরু হয়। অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে বলতে হয় ফরাসি রাজের শোধক্ষমতা solvency ছিল ফরাসি রাষ্ট্রের শোধক্ষমতার সমমানের। ফরাসি রাজ বিপুল পরিমাণ ঋণের ফাঁদে পড়েছিলো যা তদানীন্তন অর্থ সংকটের সৃষ্টি করে।
লুই ১৫ এবং লুই ১৬-এর শাসনকালে মূলত অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সিদ্ধান্ত রাজকীয় অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য গৃহীত হয়েছিলো। মন্ত্রীদের মধ্যে মূল হিসেবে বলা যায় Baron de Laune Anne Robert Jacques Turgot অর্থ বিভাগের মহানিয়ন্ত্রক এবং জ্যাক নেকারের অর্থ বিভাগের মহানিয়ন্ত্রক নাম। তারা বারবার অর্থ সমস্যার সমাধানের জন্য ফরাসি করারোপণ পদ্ধতিকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করেন যা কোন সফলতার মুখ দেখেনি। আর এই ধরনের উদ্যোগ সংসদ থেকে ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। সংসদ তখন ছিলো Robe Nobility দের করায়ত্তে যারা নিজেদেরকে জাতির অভিভাবক জ্ঞান করতেন। এর ফলশ্রুতিতে দুজন মন্ত্রীই পদচ্যুত হন। চার্লস আলেকজান্ডার দ্য ক্যালোঁ যিনি ১৭৮৩ সালে অর্থ বিভাগের মহানিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পান, বিশিষ্ট ব্যয়সমূহের জন্য একটি নতুন নীতিমালা হাতে নেন যার মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রের প্রধান ঋণদাতাদের বুঝানোর চেষ্টা চালান।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:০৪