জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহন করা সত্বেও তারাশঙ্কর তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষদের । গভীর নিরীক্ষা আর পর্যবেক্ষনে তিনি নিম্নবর্গদের সমাজ এবং জীবনচিত্রের রূপটি বরাবরই এঁকেছেন অসাধারণ নিপুনতায় । ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ উপন্যাসে দেখা যায় শোষিত নিম্নবর্গদের প্রতিবাদী বিপ্লবী রূপ; আবার ‘কবি’ উপন্যাসে তিনি অপরূপ রোমান্টিসিজম ঢেলে তৈরী করেছেন নিচুশ্রেনীর ডোম বংশে জন্ম নেওয়া নিতাই চরিত্রটিকে।তাঁর হাঁসুলী বাঁকের উপকথা ,কালিন্দী, নাগিনী কন্যার কাহিনী ইত্যাদি উপন্যাসেও উঠে এসেছে নিম্নবর্গদের জীবনকাহিনীর নিপুন চিত্রায়ণ । বেদে ,ডাকাত, ডোম ,সাঁওতাল ,আদিবাসী, সমাজের প্রান্তিক শোষিতরা, প্রাচীন বাংলার রাঢ় অঞ্চলের মানুষদের বিচিত্র জীবনচিত্র ঘুরেফিরে এসেছে তারাশঙ্করের গল্প-উপন্যাসে ।
নাগিনী কন্যার কাহিনী; তারাশঙ্করের এ উপন্যাসে বেদেগোষ্ঠীর বিচিত্র ধর্মবিশ্বাস ,আদি সংস্কার আর বৈচিত্রময় জীবনচর্চার কাহিনী উঠে এসেছে তাদের নিজস্ব পৌরানিক গাঁথার মিশেলে ।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে বিষবৈদ্যদের নিবাস ছিল চম্পাই নগরের সাঁতালী পাহাড়ে , চাঁদ সওদাগরের কাছ থেকে তারা পেয়েছিল নিষ্কর বসবাসের ছাড়পত্র। মা-মনসার সাথে বিবাদ বাঁধল মর্ত্যধামের অধিকারী শিবভক্ত চাঁদ সওদাগরের সাথে, মা-মনসা কেড়ে নিল সওদাগরের ছয় পুত্র, মহাজ্ঞান, সপ্তডিঙ্গা মধুকর। অভিশাপ দিলেন- সওদাগরের চাঁদের মত আরেক পুত্র লখিন্দরের বাসরে হবে সর্পাঘাত। তবুও সওদাগর ভেঙ্গে দিলেন মনসার ঘট তার হিন্তাল কাঠের লাঠির আঘাতে ,লখিন্দরের বিয়ের আয়োজন করল বেহুলার সাথে। বিষবৈদ্যদের আবাস মন্ত্রসিদ্ধ সাঁতালী পাহাড়ে বানানো হল বেহুলা-লখিন্দরের লোহার বাসরঘর। মন্ত্র পড়ে সীমানা কাটা সাঁতালী পাহাড়ে কোন বিষধর , পিশাচ,ডাকিনী ঢুকতে পারে না। লখিন্দরের বাসরের রাতে বিষবৈদ্যরা পাহাড়ায় বসল, মনসার পাঠানো সাপকে ঢুকতে দেবে না তারা সাঁতালী পাহাড়ে। ডালে ডালে ময়ূর আর নেউলেও রইল তাদের ধারালো দাঁত আর সতর্ক দৃষ্টি মেলে, কোন বিষধর ভুল করেও সাঁতালী পাহাড়ের সীমানার ভেতর ঢুকে দাঁতে দিয়ে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে দিবে ।
“সে রাত্রে পালটে গেল গেল বিষবৈদ্যদের ভাগ্য।সে কি রাত্রি! আকাশে মেঘ জমেছে, সে মেঘের পুরীতে মা-বিষহরির দরবার বসেছে থম থমে অন্ধকারে বিষবৈদ্যদের লালচোখ আঙরার টুকরার মত জ্বলছিল ।মধ্যে মধ্যে শিরবৈদ্য(সর্দার) তার গম্ভীর গলায় হাঁকছিল-কে? কে যায়?সাঁতালী পাহাড়ের গাছপালা সে হাঁকে দুলে উঠছিল, গাছের ডালে ডালে ময়ূরেরা উঠছিল পাখসাট মেরে, গর্তে গর্তে নেউলেরা মুখ বার করে রোঁয়া ফুলিয়ে নরুনের মত ধারালো সাদা দঁত বের করে গর্জে উঠছিল সেই হাঁকের সঙ্গে।
“মনসার নাগেরা দূর থেকে থমকে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে মাথা হেঁট করে ফিরে যাচ্ছিল।আকাশে মেঘ ঘন থেকে ঘন হয়ে উঠছিল- বিষহরির ভ্রুকুটির ছায়া পড়ছিল।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল ঘন ঘন, মায়ের চোখে ঝিলিক মেরে উঠছিল ক্রোধের ছটা ”
কূটিল মা-মনসা চালাকি করে শিরবৈদ্যের মৃত মেয়ের রূপে পাঠালেন কালনাগিনীকে ।ছদ্মবেশী কালনাগিনীর ছলনায় ভুলল শিরবৈদ্য ,ভুলল ময়ূর আর নেউলে। কন্যারূপী কালনাগিনীকে সীমানা পার করে ঘরে এনে শিরবৈদ্য তাকে পরিয়ে দিলেন মৃত কন্যার অলঙ্কার। নাগিনী কন্যা প্রতশ্রুতি দিল সারাজীবন সে থাকবে শিরবৈদ্যের ঘরে। ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে শিরবৈদ্যকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মনসা দেবীর আদেশ নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকে লখিন্দরকে দংশন করল কালনাগিনী।
পুত্র শোকে পাথর চাঁদ সওদাগর শাপান্ত করল বেদেগোষ্ঠীকে, উৎখাত করল সাঁতালী পাহাড় থেকে। নতুন আবাসের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল তারা। সাঁতালীর সীমানায় এসে শিরবৈদ্যের মনে পড়ে গেল সেই নাগিণী কন্যার ছলনার কথা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির কথা।
“সে আক্ষেপ করে চিৎকার করে উঠল –আঃ মায়াবিনী রে! তোর ছলনায় সব হারালাম, তোকেও হারালাম! বাক দিয়ে বাকভঙ্গ করলি সর্বনাশী!
কাঁধের বাঁকে ঝুলানো ঝাঁপি থেকে শিস দিয়ে কে যেন বলে উঠল-না বাবা,না ।আমি আছি তোমার সঙ্গেই আছি”
ঝাঁপি খুলতেই কালনাগিণী বেরিয়ে এসে শিরবৈদ্যের কানের কাছে ফোঁস ফোঁস করে বলল চাঁদের আজ্ঞায় বাসভূমি হারালেও মা-বিষহরির নতুন আবাসভূমি দিবেন বেদেগোষ্ঠীকে। নাগিনী কন্যা বলে গঙ্গায় নৌকা ভাসাতে, সে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে নতুন আবাসে ।কাল কন্যা প্রতিশ্রুতি দেয় বেদেগোষ্ঠীতেই সত্যিকারের কন্যা হয়ে সে জন্ম নিবে বারবার ।লক্ষণ দেখে চেনা যাবে সে নাগিনী কন্যাকে। পাঁচ বছরের আগে সে বিধবা হবে, স্বামী মরবে নাগের বিষে ।ষোল বছর আগে সে কন্যার বিয়ে দেওয়া যাবে না। ষোল বছরের আগে ফুটবে নাগিনী লক্ষণ –কপালে ফুটে উঠবে চক্রচিহ্ন ।
নৌকা চালিয়ে হিজল বিলের ধারে নতুন আবাসে বেদেদের পথ দেখিয়ে আনল নাগিনী কন্যা । নাগিনী কন্যা বলে এইখানেই আছে মা বিষহরির আটন, এই হিজল বিলের তলাতেই মা-মনসা ডুবিয়ে রেখেছেন চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা মধুকর। বালক কৃষ্ণের কাছে পরাজিত হয়ে কালীয়ানাগ এখানে এসেই বাসা বাঁধে।
রহস্যময় প্রকৃতি আর পুরাণের মিশেলে অপূর্ব বর্ণনায় পাঠকদের কাছে হিজল বিলকে হাজির করেছেন তারাশঙ্কর । রহস্যময় হিজল বিল যেন এক জাগ্রত সত্তা । চতুর কুটিল চিতাবাঘের আবাসভূমি এই হিজল বন ,বুনো শূয়োরের দল মারামারি করে এখানে । রাতে চিতাবাঘ শিকারে বের হলে চিতাবাগের পেছন পেছন চলে ফেউ।বিলের হাঙ্গরমুখী খালে রয়েছে কামট-কুমির ।ঝাউ আর দেবদারূ গাছের মাথায় পেঁচিয়ে থাকে বিষধর সাপ, পাখি বসতেও সাহস করে না এসব গাছে।
নতুন আবাস হিজল বিলে শিকার করে আর সাপ ধরে বেদেরা ,কখনও বা নৌকায় হিজল বিল থেকে বেরিয়ে গৃহস্থের ঘরে ঘরে গিয়ে ভিক্ষা সংগ্রহ করে ,গৃহিনীদের খেলা দেখিয়ে , পুরুষুদের বাঁকা চোখের চাহনি ঠেরে টাকা বস্ত্র সংগ্রহ করে ছলাকলা পটীয়সী বেদেনীরা ।
ধূর্জটি কবিরাজ নাগিনীর বিষ থেকে সূচিকাভরণ তৈরী করে, সাপের কামড়ে এক অব্যার্থ ঔষধ এই সূচিকাভরণ ।নাগিনীর বিষ সংগ্রহ করতে ধূর্জটি কবিরাজ তার শিষ্য শিবরামকে সাথে নিয়ে আসে হিজল বিলের বেদেদের কাছে ।শিবরামই এ উপন্যাসের কথক ।তার কাছ থেকেই জানা যায় প্রাগঐতিহাসিক সংস্কারে বাঁধা এই গোষ্ঠীর নানান জীবনাচার। সৃষ্টিতত্ব ,জীবন রহস্যে আগ্রহী মহাজ্ঞানী আচার্য ধূর্যটিও শিবরামকে জানায় মহাকালের রহস্যময় রীতিতে জড়িয়ে যাওয়া এইসব আদিমানবদের অতীতের গূঢ় তত্ব ।
“বেদেদের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করি কেন জান? আর ওদের জন্য আমার মমতাই বা এত গাঢ় কেন জান?ওরা হল ভূতকালের মানুষ। পৃথিবীতে সৃষ্টিকাল থেকে কত মন্ব্নতর হল,ধর্ম বিপন্ন হল, মাৎসন্যায়ে ভরে গেল ,এক মনুর কাল গেল, নতুন মতুন এল নতুন বিধান নতুন ধর্মাবর্তিকা হাতে নিয়ে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে , আচার-ব্যবহারে, রীতিতে-নীতিতে,পানে-ভোজনে,পরিচ্ছদে-প্রসাধনে কত পরিবর্তন হয়ে গেল ।কিন্তু যারা আরন্যক, তারা প্রতিবার বিপ্লবের সময়েই গভীরতর অরণ্যের মধ্যে গিয়ে তাদের আরন্যক প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখলে।সেই কারণে এরা সেই ভুতকালের মানুষই থেকে গেছে ”
তাদের বিশ্বাস ,তাদের সামাজিক রীতি আর জীবনাচারের মূল চালিকাশক্তি হল যুক্তিহীন সংস্কার আর প্রাগৈতিহাসিক পৌরানিকগাঁথা ।
“তাদের অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী আদিম আরণ্যক মন। সমস্ত কিছুর মধ্যে এক অসম্ভব সংঘটনের প্রকাশ দেখতে তারা উদগ্রীব হয়ে রয়েছে”
আর তাই বিলের পদ্ম ফুলের প্রাচুর্যে, নাগের দংশনে চিতাবাঘের মৃত্যুতে, হিজলের ঘাসবনে সবুজের গাঢ়তায় তাদের অলৌকিকত্বে বিশ্বাসে আদিম আরন্যক মন স্ফুর্তি খোঁজে । চিরায়ত জীবানাচারের সামান্য বিচ্যুতিতেই তারা দৈবতার উপসর্গ খুঁজতে চায় ।
ভিত্তিহীন এসব দৈব ঘটনা আর পৌরানিক ঘটনাকে আশ্রয় করে কখনও সুবিধাবাদী হিসেবে আবির্ভূত হয় বেদে সর্দাররা । বেদেদের বিকৃত পৌরানিক কাহিনী আর সেসব কাহিনীতে দেবতাদের লাম্পট্য উপস্থিত হয়েছে যেন তাদের নিজেদের খল বাসনা চরিতার্থ করবার সহায়ক হিসেবে ।আর তাই ব্যাভিচারের মত অপরাধও খুব সাধারণ হয়ে ওঠে ।
“ওদের দেবতা হওয়া সাধারণ কথা নয়।ওই শিবই পারেন ওদের দেবতা হতে ।ওদের পূজা নিতে দেবতাটি অম্লানমুখে গ্রহন করেছেন উচ্ছৃঙ্খলতার অপবাদ, ধরেছেন বর্বর নেশাপরায়ণের রূপ, আরও অনেক কিছু।নিজেদের সমাজপতির শ্রেষ্ঠ শক্তিমানের জীবনের প্রতিফিলনে প্রতিফলিত হয়েছেন রুদ্রদেবতা।বল্গাহীন জৈবিক জীবন স্বেচ্ছাচারে যা চায়, যা করে,তার দেবতাও তাই করেন”
নাগিনিকন্যার নাগচক্র শুধু শিরবেদেই দেখতে পারে, সেই নির্বাচন করে নাগিনী কন্যাকে । দেবীর মত সম্মান করা হয় এই নাগিনীকন্যাকে, পুরষের সঙ্গলাভ থেকে বঞ্চিত হয় সে।পূর্নবয়সে জৈবিক কামনায় আক্রান্ত হলে চাঁপাফুলের সুবাস বের হয় নাগিণী কন্যার শরীর থেকে ।বেদেরা বলে পাপ এসেছে কন্যার মনে, নাগমিলন চাইছে সে। আর তখন নতুন নাগিণী কন্যা নির্বাচন করা হয়।
বেদেদের পুরাণে বলা আছে কৃষ্ণকে কালীনাগ তার মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেন।প্রস্তাবে রাজী হন কৃষ্ণ কিন্তু বাসরের স্বাদ পায় না কালীনাগের কন্যা । কৃষ্ণকামনায় কালীনাগের কন্যার শরীর থেকে বের হয় চাঁপা ফুলের সুবাস ।কামনা সবার মনে থাকলেও এমন স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশে সবাই হাসাহাসি করে কালীনাগের কন্যাকে নিয়ে ।কালীনাগের কন্যার অভিশাপে জৈবিক কামনাতাড়িত সব কালনাগিনীর শরীর থেকে তাই চাঁপা ফুলের সুবাস বের হয়, সেই সুবাসেই নাগ আকৃষ্ট হয়ে নাগিনীর সাথে মিলনে প্রবৃত্ত হয়। নাগিনী কন্যার শরীর থেকেও আসে চাঁপাফুলের ঘ্রান।
এ উপন্যাসে নাগিনী কন্যা শবলা আর আর পিঙ্গলার গল্প বলেছেন তারাশঙ্কর । উচ্ছল প্রতিবাদী শবলা দুশ্চরিত্র শিরবেদের বুকে বিষকাঁটা ঢুকিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় । শবলার স্থলাভিষিক্ত পিঙ্গলার কাছেও অসহ্য হয়ে ওঠে নাগিণী কন্যার জীবন ।নিজ শরীরের চাঁপা ফুলের গন্ধ থেকে অস্বীকার করতে চায় কিন্তু তার প্রতি নাগুঠাকুরের তীব্রা ভালবাসা উপক্ষা করতে পারে না, পথা চেয়ে থাকে নাগু ঠাকুর তাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে, মা বিষহরির কাছ থেকে মুক্তির আদেশ নিয়ে আসবে সে, আবসান হবে তার দুঃখভরা নাগিনী জীবনের।
বেদে সমাজের বিচিত্র নিয়ম,মন্ত্র-জড়িবুটি, প্রেম , কামনা, গোত্রপতিদের শঠতা, আরণ্যক মানুষদের অন্তরের অন্ধাকারচ্ছন্নতায় আটকে পরা কুসংস্কার আর আনেক অপ্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী সাপ বিষয়ক নানা তথ্য তারাশঙ্করের এ উপন্যাসকে এক অনবদ্য রূপ দান করেছে ।
নাগিনী কন্যার কাহিনীতে সাপ ও বেদেদের নিয়ে রয়েছে এক ডজনেরও বেশী পৌরানিকগাঁথা ।এ কাহিনীগুলো নিয়ে একসময় আলাদা করে পোস্ট দেওয়ার ইচ্ছে আছে ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৫৫