ওপারের ঘাসগুলো সবসময়ই সবুজ (grass is greener on the other side)। এই ধোকায় পড়ে জীবনের অর্ধেকের বেশি পার করে দিলাম। কিন্তু সবুজ ঘাসের দেখা আজ অব্দি পেলাম না।
ছোটবেলায় যখন স্কুলে যেতে মন চাইত না কিন্তু আম্মা জোর করে পাঠাত তখন আমাদের বাড়িতে কাজ করা সালেহা ফুপুর আমার বয়সী ছেলে বাচ্চুকে খুুব হিংসা হত। আমি কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে যেতাম আর বাচ্চু ব্যাটা সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াতো। তখনো বোঝার বয়স হয়নি দুবেলা ভাতের জন্য বাচ্চুর কত কষ্ট।
কিংবা ছোটবেলায় পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় ধানক্ষেতে শফিককে তার বাবার সাথে কাজ করতে দেখলেও প্রচন্ড হিংসা হতো। ইস্ শফিকের কত মজা, ওর কোন পরীক্ষা দিতে হয় না। কিন্তু ওই অল্প বয়সে ধানের আটির ভাড়ে শফিকের মাথা যখন নূয়ে পড়ত তখন আমাকে দেখেও নিশ্চই ওর হিংসা হতো। ইস্ শুভর মতো আমিও যদি স্কুলে যেতে পারতাম, তাহলে ধানক্ষেতের আইলে আমাকে আর কাজ করতে হতো না।
একে একে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি শেষ করলাম। কর্মজীবনের শুরুটা ভালই ছিল। কিন্তু বন্ধুদের সবাইকে এক এক করে দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে দেখে এক ধরণের অস্থিরতা অনুভব করি। ফেসবুকে ওদের ছবি দেখে মনে হয় দুনিয়ার কত কিছু দেখা বাকী। আর ওদের জীবন কত সুখী। কীভাবে কীভাবে যেন আমারও দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হলো। তাও আবার সরাসরি চাকরি নিয়ে। আমার খুশি আর ধরে না। কিছুদিন যেতেই মোহ ভাঙলো। বাড়িতে ফেলে যাওয়া মা আর অসুস্থ (পোলিওতে পঙ্গু) ভাইয়ের চিন্তায় চিন্তায় প্রথমবারের মত প্যানিক ডিসঅর্ডার নামক রোগের সাথে পরিচয়। সাথে যোগ হলো ইনসোমনিয়া। একবার ভয়ংকর মাত্রার প্যানিক এ্যাটাক হলো। তারপর থেকে জীবনটাই বদলে গেল। বিদেশ বিভূইঁয়ে শুধু মনে হতে থাকে পরিবারের সাথে বেঁচে থাকাটাই আনন্দের। তখন একমাত্র চিন্তা, দেশে গিয়ে যদি একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা প্রাইভেট টিউটর হয়েও জীবন পার করি তাতেও আমার চলবে। অবশেষে ৩-৪ মাস প্যানিক ডিসঅর্ডার, ইনসোমনিয়া আর নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে দেশে ফিরি।
দেশে ফিরে ৩ মাস বেকার থাকি। তবুও মনে হতো সুখেই আছি। পরে একটি ছোট প্রতিষ্ঠানে বেশ ভাল পদেই যোগ দেই। বেতন-বোনাসসহ দেশের বাইরের চেয়ে প্যাকেজটা খুব একটা খারাপ ছিল না। কিন্তু আশেপাশে সবার অবস্থা দেখে জব সিকিউরিটি নিয়ে ঘাবড়ে যাই। সবার মুখের কথা প্রায় একইরকম। হয় দেশের বাইরে সেটেল্ড হও না হয় সরকারি চাকরি করো। আমি ভাবি, দেশের বাইরের জীবনতো একবার দেখা হয়েই গেছে। এবার বাকী শুধু সরকারি চাকরি । কিন্তু ততদিনে চাকরির বয়সও প্রায় শেষের দিকে। তবুও জোর প্রস্তুতি চালালাম। বেশ কয়েকটা চাকরির পরীক্ষা দিলাম। ততদিনে আগের প্রত্ষ্ঠিান ছেড়ে দেশের সবচেয়ে নামকরা টেলিকমিউনিকেশন্স সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানীতে বেশ ভাল পজিশনে যোগ দেই। এর মাঝেই একটি সরকারি সায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির চাকরি পেয়ে যাই। পরিবারের সবার চাপাচাপিতে মাত্র দেড় মাসের মথায় টেলিকমিউনিকেশন্স-এর চাকরি ছেড়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেই।
সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর আমার আম্মা মনে হলো হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। এতদিনে তার ছেলে কোথাও থিতু হতে পেরেছে। বলে রাখি আমার নাতিদীর্ঘ কর্মজীবনে ইতোমধ্যে ৭ বার কর্মস্থল পরিবর্তন করেছি। অতঃপর আমারও মনে হলো অনেক হয়েছে আর না। এখানেই থেকে যাই। আর কত! কিন্তু গত কিছুদিন ধরে মনটা আবার অস্থির হয়ে পড়েছে। সন্তানের বাবা হয়েছি অনেকদিন হলো। সে এখন স্কুলে যায়। এখন মনে হয় এখানে থেকে সন্তানকে একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে পারব কি?
আমি কি আবারও সবুজ ঘাসের সন্ধানে?
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০২২ বিকাল ৩:৫৫