আমাদের স্বাধীনতার বয়স প্রায় ৪৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে । এই দীর্ঘ সময়ে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে রচিত হওয়া উচিত ছিল। অর্থাৎ ইতিহাসে যার যা পাওনা তাকে ঠিক সেই স্থানটি দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিধি বাম। একজন মানুষকে দেবতার আসনে বসাতে গিয়ে কিছু লোক গোটা জাতির ইতিহাসকেই শুধু বিকৃত করছে না, তারা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবময় সুচনাপর্বের লগ্নটিকেও গুম বা হাইজ্যাক করতে চায়। এরা ভুলে গেছে, উপরে থুতু দিলে নিজের গায়ে লাগে। মাত্র কিছুদিন হলো, তাজউদ্দিন কণ্যা শারমিন আহমদ স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ষড়যন্ত্রকারী ক্ষমতাসীন এই মোনাফেক চক্রের মুখে শুধু থুতুই ছিটিয়ে দেননি তিনি মিথ্যা মহাদেবতার মুখে চুনকালিও কম লেপন করেন নি। তাই এই সাহসিকতার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিশেষ করে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে এই দিনে শেখ মুজিব তাঁর নিজের পরিবারের নিয়মিত মাসোহারা নির্ধারন করে পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন বা বন্দি হন। কেন না পাকিস্তান ভাঙার দায়-দায়িত্ব তিনি নিতে চান নি। কোটি কোটি মানুষ ছিল সেদিন দিশেহারা। অরক্ষিত এই জনপদে আচমকা হানা দিল পাকিস্থানীরা। সমগ্র দেশটি যেন পরিণত হলো এক কিয়ামতের ময়দানে। সেদিন নিজের ও তাঁর পরিবারের জীবন বাজি রেখে বীর-দর্পে অসম সাহসিকতার সাথে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানালেন জিয়া, তিনি আবারও প্রমাণ করলেন, উপ মহাদেশে " হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে ইন্ডিয়া থিংকস টুমোরো"। শুধু যুদ্ধের আহবান জানিয়ে তিনি ক্ষান্ত হন নি, তিনি জর্জ ওয়াশিংটনের মতো এই যুদ্ধের সকল দায়-দায়িত্ব অর্থাৎ যুদ্ধ ঘোষণা, পরিচালনা, রণ-কৌশল নির্ধারণ ও তার বাস্তবায়নের পূর্ণাংগ দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। কারো নির্দেশ-আদেশ বা পরিকল্পনা মাফিক যুদ্ধের ময়দানে হাজির হন নি তিনি। সে দিনের সেই পথহারা, অন্ধকারচ্ছন্ন ও দিশাহীন জাতিকে সঠিক পথের দিশাটি তিনিই দিয়েছিলেন। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে শুরু হল বিদ্রোহ, চট্টগ্রামের ষোলশহরের বিপব উদ্যানে সেনা-জনতার সমাবেশে ও কালুরঘাটের বয়েটার কেন্দ্রের মাধ্যমে তার সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের আহবান বিশ্বময় ছড়িয়ে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যেই। সারা বিশ্ব সেদিন প্রথমবারের মতো জানলো, স্বাধীনতার ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে একটি জাতি এক মহানয়কের নেতৃত্বে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেই মহা-পরাক্রমশালী, অসম সাহসী মহাবীরের নাম জিয়াউর রহমান। আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, এই ঘোষণার মাধ্যমেই তিনি স্বাধীন বাংলা বয়েটার কেন্দ্রেরও জন্ম দিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতীতি মানুষের একান্ত কাছের মানুষ, প্রাণের মানুষ জিয়া। তিনি আমাদের বড় আদরের জিয়া। যত দিন বাংলাদেশ টিকে থাকবে, ততোদিন টিকে থাকবে এই অসম সাহসী সমরবিদের বীর গাঁথা। গোটা জাতি থাকবে তার কাছে ঋণী আজীবন।
ঐতিহাসিকদের মতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিহাসে একটু ঠাই করা বড়ই কঠিন সেখানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কমপক্ষে তিন-তিনটি বার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা গোটা জাতিকে তিনি প্রচণ্ড বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছেন বারবার।
প্রথমটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আহবান ও তাঁর নেতৃত্বদানের মাধ্যমে, দ্বিতীয়টি ছিল ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে। এই দিনটিতে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেন। আর তৃতীয়টি ছিল ১৯৭৭ সালে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে 'বাকশালের' কবল থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, স্ব-নির্ভর মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচলন করেন। একই সময় খাল-নদী খনন, পরিবেশ সংরক্ষণ, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রণয়ন, সার্ক গঠনসহ বাংলাদেশকে একটি তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বিশ্বে একটি মর্যাদা সম্পন্ন দেশ হিসাবে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশ্ব ইতিহাসে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেন। আর এ সবই সম্ভব হয়েছিল জিয়ার একনিষ্ঠতা- প্রত্যুপন্নমতিত্ব, সৎ নেতৃত্ব, বুদ্ধিমত্তা, আত্মত্যাগ, নিরাহংকার এবং সর্বোপরি আলাহ পাকের ওপর তাঁর অবিচল আস্থা। এই কারণেই জিয়া আমার দৃষ্টিতে আধুনিক বাংলাদেশের জনক ও প্রথম রূপকার।
কিন্তু ভাবতেও অবাক লাগে, আজ স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর যারা স্বাধীনতার চেতনাকে ট্যাবলেট হিসাবে বিক্রি করছে তারা গাইয়ের জোরে সঠিক ইতিহাসকে বিক্রিত করে সেই চেতনার ট্যবলেট এখন গনগনকে গলধকরণের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এরা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও গৌরবময় ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। আমাদের জাতিকে বিশ্বের সামনে অপমানিত করে চলেছে। ও’রা অপপ্রচার চালাচ্ছে এই বলে যে জিয়া বেঁচে থাকতে কখনোই স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে নিজেকে ২৬ মার্চের ঘোষণায় উলেখ করেন নি। আমরা তাদের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। আমার হাতে ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহ অর্থাৎ ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০ ও ৩১ মার্চে প্রকাশিত ভারতসহ সারা বিশ্বের কমপক্ষে ৪০ টিরও বেশি দলিল জিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের আহবানসহ প্রথম রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের দলিল রয়েছে। আমরা প্রথম কিস্তিতে ১৯৮০ সালে দৈনিক দেশ প্রথম বর্ষ্পূর্তি সংখ্যায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্বহস্তে লিখিত জাতির সামনে পেশ করলাম। প্রসঙ্গক্রমে আমি আরও বলতে চাই দেশে এবং বিদেশে যারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারক বাহক তাদেরকেও অবশ্যই জিয়ার আদর্শ সম্পর্কে জানতে হবে।
লেখকঃ
ডঃ শওকত আলী
অধ্যাপক, লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটি, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র ।
সাবেক সহকারী সম্পাদক, দৈনিক দেশ, ঢাকা, বাংলাদেশ।