somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রফেসর হ্যানাহ গরডোন | একজন ব্যতিক্রমী মানুষ গড়ার কারিগর | [ উইমেনস ডে স্পেশাল]

০৯ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৩:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সমাজে এমন কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা নিজেরা যেমন হন আপন আলোয় আলোকিত, তেমনি সেই আলোর ঝলকানিতে উজ্জ্বল করে তোলেন তাঁদের আশেপাশের মানুষদের। তাঁদের সততা, নিষ্ঠা, আর মহানুভবতায় অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রয় সারা বিশ্ব। তাদের সৃজনশীলতার চরম উৎকর্ষতা—ই হয় তাদের পরিচায়ক। তাদের ব্যতিক্রমী কর্মপন্থা হয় সকলের জন্য আদর্শ। তাঁরা অভাবনীয় জীবনীশক্তি আর সংকল্পরত শক্তিশালী মানুসিকতার সমন্বয়ে পরিণত হন সকলের প্রিয় মানুষে। তেমনি এক বীরংগিনীর কথা বলব আজ। তিনি হলেন নিউ ইয়র্ক সিটি কলেজ অফ টেকনোলজি’র ইংরেজীর অধ্যাপক মিস হ্যানাহ গরডোন।

চল্লিশের দশকে বর্বরোচিত নাতসি বাহিনীর ভয়ানক তাণ্ডবের শিকার তার বাবা, মা, এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। “আমার মা—বাবা এবং অন্যান্য চাচা—চাচী এবং চাচাতো ভাই-বোনেদের সবাই নাতসি বাহিনীর জারিকৃত অমানবিক আইনের ফলে স্কুল এবং কলেজে যাওয়া থেকে নিষিদ্ধ ছিল”, তিনি বলেন। কিন্তু মিস গরডোনের মজবুত মানুসিকতা থেকে তার বাবা—মায়ের চিত্তের পরিচয় পাওয়া যায়। সহজে হাল ছেড়ে দেবার লোক ছিলেন না তারা। গরডোনের বাবা—মা জন্মস্থান পোল্যান্ড ছেড়ে চলে আসেন কানাডাতে। এরপর বিভিন্ন স্থানে কাজের মাধ্যমে তার অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল অবস্থায় ফিরে আসতে লাগলেন। তারা তাদের অনাগত সন্তানের জন্য টাকা-পয়সা জমাতে শুরু করলেন।

মিস গরডোন জন্ম গ্রহণ করেন নিউ জার্সির ফ্রিহোল্ড সিটিতে। এরপর তিনি স্থানীয় হাইস্কুল শেষ করে ভর্তি হন নিউ জার্সির মনক্লের স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে সাহিত্যে এবং ইতিহাসে মাস্টার্স এবং পরবর্তিতে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।

“আমি মনে করি, যে বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে তা হল, আমি শুনেছি আমার বাবা যখন কানাডাতে প্রথম এসে কাজ শুরু করলেন, তখন কাজের মাঝে তিনি দুপুরের খাবারের জন্য যে সময় পেতেন, তখন তিনি দোকানের পেছনের কোন স্থানে গিয়ে নীরবে একা একা বই পড়তেন আর এভাবেই তিনি নিজে নিজে লিখতে এবং পড়তে শিখেছেন”। আপনি কেন শিক্ষকতাকে আপনার পেশা হিসেবে নিলেন?—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আসলে আমরা চার ভাই—বোনের মধ্যে দুই জন ইতিহাসে পড়েছিলেন, ফলে আমিও সে বিষয়ে আগ্রহী ছিলাম, সাথে আমার ইংরেজী ব্যাকরণের পারদর্শীতাই আমাকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আমি আজ ৩০ বছর যাবত শিক্ষকতা করছি ফলে সত্যি বলতে, আমি ভুলে গেছি কিভাবে এ পথে এসেছিলাম.”।

মিস গরডোন একজন ব্যাতিক্রমী শিক্ষক। তাঁর ব্যাতিক্রমী পাঠ দান পদ্ধতি তাকে অন্য সব অধ্যাপক থেকে আলাদা পরিচয়ে পরিচিত করে। যেহেতু তিনি রাইটিং এর অধ্যাপক, তিনি তার ছাত্র—ছাত্রীদেরকে গতানুগতিকভাবে কোন বিষয় নির্ধারণ না করে দিয়ে যেকোন বিষয়ে লেখার অনুমতি দেন। ফলে ছাত্র—ছাত্রীরা তাদের লেখনীধারাকে ত্বরাণ্বিত করতে পারে। আশ্চর্য্যজনকভাবে, তিনি পাঠদানকালে যদি ভুলবশতঃ কিছু লিখে ফেলেন বা কোন কিছু করেন, তিনি নিজেকে এক ডলার জরিমানা করেন। “আর সেই টাকা আমি ছাত্র—ছাত্রীদেরকে আটলান্টিক সিটিতে বিনোদনের জন্য খরচ করতে দিই না, বরং সেই টাকা দিয়ে আমি তাদের জন্য লেখাপড়া সহায়ক বিভিন্ন বস্তু যেমন ঈনডেক্স কার্ড, কলম, বই ইত্যাদি দিয়ে থাকি”, তিনি বলেন। তার প্রদত্ত গ্রেডে যদি কোন ছাত্র বা ছাত্রী সন্তুষ্ট না হয় তবে তিনি ছাত্র-ছাত্রীকে অন্য সব শিক্ষার্থীদের জন্য সেই পেপারের একটি করে কপি আনতে বলেন এবং সবাই মিলে আবার গ্রেডিং করার সুযোগ দেন।“আমি যদি কাউকে সে গ্রেড দিই এবং ক্লাস যদি তাকে এফ গ্রেড দেয় তবে আমার দেওয়া সি চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। অপর পক্ষে, আমি যদি কাউকে সি দিই এবং ক্লাস তাকে এ দেয়, তবে সেই এ চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। সব সময় সর্বোচ্চ গ্রেডকে আমি প্রাধান্য দিই”

আদর্শ শিক্ষাদানকে কিভাবে সঙ্গায়িত করা যায়? এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ছাত্র—ছাত্রীদেরকে শিক্ষক সরাসরি কিছু না শিখিয়ে বরং বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীকে নিজে থেকে শেখার ব্যবস্থা করা হল সবচেয়ে ভালো শিক্ষাদান পদ্ধতি। আমি কিন্তু আসলে কাউকেই কিছু সরাসরি শেখায় না। কারণ আমি মনে করি শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষা নেওয়া এ দুটোই আসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে”।
আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থা সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হলেও সম্প্রতি এক রিপোর্টে দেখা গেছে গণিত এবং বিজ্ঞানে আমেরিকার হাইস্কুলের ছাত্র—ছাত্রীরা ৬৪টি দেশের পরে অবস্থান করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরনের উপায় কি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন”। তিনি চীন এবং ভারতের কথা উল্লেখ করে বলেন, “তাদের তুলনায় আমাদের স্কুলগুলোতে অনেক কম সময় ব্যয় করা হয় আবার স্কুল বন্ধের দিক চিন্তা করলে তাদের চেয়ে অনেক বেশী সময় আমাদের স্কুল বন্ধ থাকে”। তিনি আমেরিকার স্কুলগুলো দিনে আরো বেশী সময় ব্যয় করা উচিত বলে মনে করেন। তিনি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দেন।

তিনি বাংলাদেশী কমিউনিটির উদ্দেশ্যে বলেন, “বাংলাদেশীরা তাদের মেধা দিয়ে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে আমেরিকার বিভিন্ন পর্যায়ে। আশা করি তাদের কর্মদক্ষতা আমেরিকার সামগ্রিক উন্নয়ে তাতপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে”।

হ্যানা গরডোন একটি সততার উপর প্রতিষ্ঠিত এক কর্মবীরঙ্গিনীর নাম। পারিবারিক শত প্রতিকূলের মধ্যেও তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে, হয়েছেন মানুষ গড়ার কারিগর, শিক্ষক। সময়ের পরিবর্তনে আর কালের আবর্তে তিনি হয়ত হারিয়ে যাবেন অতল গহব্বরে। কিন্তু থেকে যাবে তার আদর্শে ঘেরা ত্রিশ বছরে শিক্ষকতা জীবন, থেকে যাবে তার ব্যাতিক্রমী পাঠদান পদ্ধতি। “আমি আশা করি সামান্য হলেও হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে সাহায্য করেছি, আর তারা আমাকে এতো বেশী আনন্দ এবং উৎসাহিত করেছে যে আমার মনে হয় আমি সারা জীবনেও তাদের সে ঋণ শোধ করতে পারব না”, তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৩:২৫
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মত প্রকাশ মানে সহমত।

লিখেছেন অনুপম বলছি, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৭

আওয়ামী লীগ আমলে সমাজের একটা অংশের অভিযোগ ছিলো, তাদের নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। যদিও, এই কথাটাও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন, লিখে অথবা টকশো তে।

এখন রা জা কারের আমলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প বলেছে, বাংলাদেশ পুরোপুরি এনার্খীতে, তারা মাইনোরিটির উপর অত্যাচার করছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৬



৩ দিন পরে আমেকিকার ভোট, সাড়ে ৬ কোটী মানুষ ভোট দিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে; ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৫১ ভাগ। এই অবস্হায় সনাতনীদের দেওয়ালী উপক্ষে ট্রাম্প টুউট করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

×