বাংলাদেশে যখন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা দেখা দেয় তখন কিছু মানুষ এই দুর্যোগের নামে রঙ চং লাগিয়ে সরাসরি আজাব, গজব বলে প্রচার শুরু করেন ,ধর্মীয় সিম্প্যাথি আদায়ের চেষ্টা করেন ।
কিছু দিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত ছিল অতি সম্ভাব্য ৪৩ বছরের মধ্যে সবচে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় "ফণী" এর আক্রমন নিয়ে ।এই "ফণী"র আগমনী বার্তা শুনেই একটা পক্ষ সরকার ,বিধর্মী আর পাপাচারে লিপ্ত মানুষদের গালাগাল শুরু করে দেয় কারণ এই সমস্ত মানুষদের জন্যই বাংলাদেশ ধ্বংস হতে যাচ্ছে। কিন্ত অবশেষে ফণী তার ছোবল উঠিয়ে নিয়েছে । এতদিন ধরে আপনারা যারা সমাজে অন্যায় -অনাচার-পাপাচার এর জন্য এই গজব আসছে বলে প্রচার করলেন ,এখন তারা বলুন এই গজব না আসার অভ্যন্তরীণ কারণ কি ?
আমার প্রশ্ন রাখার আগে এই গোষ্ঠীর উত্তর তৈরি ।তারা বলবে ",৯০ ভাগ মুসলমানদের দেশ হওয়ায় আল্লাহ করুনা করেছে ,সবাই তউবা করে কান্না কাটি করায় আল্লাহ গজব উঠিয়ে নিয়েছে ।এই যে দেখুন পাশের বিধর্মীদের দেশ ভারতে কিন্ত ঠিকই আঘাত হেনেছে ,কিন্ত আমরা বেঁচে গেছি কারণ এদেশ ১২ হাজার আউলিয়া গাউস কুতুবের দেশ ।" তারা ভুলেও ভাববে না পাশের দেশ বিধর্মী দেশে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি মুসলমান রয়েছে ,তারাও আমাদের মতই স্রষ্টার দরবারে কান্না কাটি করেছে কিন্ত তারা রেহাই পায়নি ।আহা আমরা কত ভাগ্যবান ।তবে ,আমরা ভাগ্যবান ছিলাম না ১৯৭০ সালে ,যখন প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল ,আমরা ভাগ্যবান ছিলাম না ১৯৯১ সালে যখন প্রায় ২ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল ।আমরা ভাগ্যবান ছিলাম না ১৫৫৪ সালের দিকেও ... তখনো প্রায় আড়াই লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল সর্বধ্বংসী ঝড়ে ।
এই সময় গুলোতেও মানুষ পাপ করেছে ,সরকার ধর্মের বিরুদ্ধে আইন করেছে দেশ চালিয়েছে ,ওয়াজিনে কেরামগন তখনো এসব দুর্যোগ কে গজব বলে চালিয়েছে ।মানুষ কে তউবা করতে বলেছে ।মানুষ তউবা করেছে ,কান্নাকাটি করেছে তবু রেহাই পায়নি ।কিন্ত এবার সৌভাগ্য ক্রমে রেহাই পেয়েছে যেমন পেয়েছিল আইলা ,নার্গিসের সময় ।
কিন্ত দুর্ভাগ্য হল এই সমস্ত ওয়াজিনে কেরামগন কখনোই এই দুর্যোগের কারণ সম্পর্কে জানতে চান না বরং গজব নামক একটা শব্দ উচ্চারন করে সব জিজ্ঞাসাকে মাটি করে দেন ।
ইতিহাস ঘাঁটলে এই প্রকৃতির মানুষদের সাথে শুধু বর্তমানে নয় অতীতেও দেখা মেলে ।একটা সময় পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশে গুটি বসন্ত রোগের বেশ প্রাদুর্ভাব ছিল ।আর এই প্রাদুর্ভাবকেই পুঁজি একটা গোষ্ঠী ব্যবসা শুরু করে দেয় ।তাদের ঝাড়ফুঁক আর পানি পড়ার মাধ্যমেই নাকি গুটি বসন্ত নামক গজব থেকে মানুষকে রক্ষা পেত । প্রশ্ন হল কতটুকু রক্ষা পেত ?? যদি রক্ষাই পেত তাহলে গ্রামের পর গ্রাম কেন উজাড় হয়ে যেত ?কি উত্তর বা ব্যাখ্যা আছে ?
উন্নত চিকিৎসার কারণে ডাইরিয়া রোগে এখন মানুষ মারা যায়না বললেই চলে ।কিন্ত একটা সময় ছিল মানুষ এই "ওলা বিবি"র আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য বাড়ি বন্ধ করত,ওজা এনে ঝাড়ফুঁক করত ।ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হত ,তাদের বয়কট করা হত । বসন্ত ,ডায়রিয়া ,যক্ষ্মা এই ধরনের সংক্রামক রোগ গুলোকেও সেসময় গজব বলে চালিয়ে দেওয়া হত ।এসব নিয়ে ব্যবসা করা হত ? প্রশ্ন হল বর্তমানে এই গজব গুলো স্রষ্টা কেন দিচ্ছেন না ? মানুষ তাহলে আগের চেয়ে বেশি আল্লাওয়ালা হয়ে গেছে নাকি উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তি ???
আচ্ছা,ধরে নিলাম প্রতিটা প্রাকৃতিক স্রষ্টা প্রদত্ত আজাব বা গজব ।এখন তাহলে জানা যাক ,স্রষ্টা গজব কেন দেন ?কুরআন ,হাদিস থেকে যত টুকু জানা যায় তার সারমর্ম হল "যখন সমাজে অন্যায় -অবিচার বেড়ে যায় ,মানুষ একাধারে বিভিন্ন পাপাচারে লিপ্ত হয় তখন স্রষ্টা মানুষকে তার পরাক্রমশালী ক্ষমতা বুঝাতে আজাবে গ্রেপ্তার করেন ।"
আর বর্তমানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত হানার কারণ মানুষের আল্লাহ ভোলা মনোভাব ।মানুষের অন্যায় আর পাপাচার বৃদ্ধি কিংবা শাসনকর্তাদের আল্লাহ ভীতি কমে যাওয়া সহ আরও বিভিন্ন কারণ।
কিন্ত এসমস্ত পাপাচার কি শুধু বর্তমানেই হচ্ছে নাকি অতীতেও হয়েছে ? ইতিহাস কথা বলে আমরা যত অতীতের দিকে যাবো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আক্রমণ তত কম দেখব ।একই ভাবে পাপাচার বা স্রষ্টা ভোলা মনোভাব তত বেশি দেখব ।আজ থেকে কয়েক শত বছর পূর্বেও এই ভারত উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম বলতে কিছু ছিল না ,আল্লাহ নাম উচ্চারন করার মত কেউ ছিল না।সবাই ছিল অগ্নি উপাসক ,মূর্তি পূজারী ।তার আল্লাহর সব ধরনের বিরুদ্ধাচরণ করত কিন্ত তবুও স্রষ্টা তাদের আজাব ,গজব দিয়ে তখন পাকড়াও করেনি ,বর্তমানে যতটা তথাকথিত গজবে মানুষকে পাকড়াও করেছে । অবশ্যই সেই সময়ের চেয়ে বর্তমানে ইসলাম ধর্মীয় উপাসকের সংখ্যা বেশি ,মসজিদ মাদ্রসার সংখ্যা বেশি ,আল্লাহওয়ালা অলি আউলিয়া পীর মুর্শিদের সংখ্যা এখন বেশি ।তবে কেন সেসময়ের চেয়ে বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ?
এধরনের হাজারো প্রশ্ন তোলা যায় ।
যাই হোক আমাদের বর্তমান সময়ের এই অতি ধার্মিকতা আর অতি নাস্তিকতা দুই হতেই বেরিয়ে আসতে হবে ।যেকোন দুর্যোগ ঘটলেই তাকে পর্যালোচনা না করে গজব বলে চালিয়ে দেওয়া যাবেনা ।এর অভ্যন্তরীণ কারণ খতিয়ে দেখতে হবে ।
গত দুবছর আগে হাওর অঞ্চলে বন্যা দেখা দিল ।কিছু মানুষ গজব গজব বলে চিল্লাইয়া উঠলো ,একবারের জন্যও ভাবলও না কেন হাওরের বাঁধ সঠিক ভাবে মেরামত করা হয়নি ।
রানা প্লাজা ধ্বসেও কিছু আলেম ওলামা আল্লাহর আজাব ,গজব বলে চিল্লানি শুরু করে দেয় ।তারা বলে ,গার্মেন্টসে নারী পুরুষ অবাদ মেলামেশা করে তাই আল্লাহর লানত পড়েছে কিন্ত একবারের জন্যও তারা ভেবেনি ভবন নির্মাণের ত্রুটি ছিল কিনা ।
কোথাও আগুন লেগেছে কিংবা দুর্ঘটনা ঘটেছে মাত্রই আল্লাহ এর গজব নেমে আসছে বলে প্রচার শুরু হয়ে যায় ।এমন কি অতীতের মত বর্তমানেও বিভিন্ন রোগ নাকি আল্লাহ প্রদত্ত গজব ।এসব গাঁজাখুরি আহাম্মমকি মন্তব্য বলে বেড়ায় এক টাইপের ধর্ম ব্যবসায়ী ,বিশ্বাস ব্যবসায়ী ।তারা সব মানুষকে অজ্ঞ ভাবে আর অজ্ঞদের আর অজ্ঞ বানিয়ে রাখতে চায় ।এরা কুরআন ,হাদিস শুধু মুখস্ত করেই নিজের মত কিছু একটা বলে দেয় ,কুরআন হাদিস অনুভব করেনা ,গভীরে পৌছায় না ।এবং তারা যা বলে সেটা যে তারা নিজেরাও মানেনা সেদিকেও খেয়াল করেনা ।
আন্তর্জাতিক স্ট্যাটিকসে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবন ১৫ টি দেশের মধ্যে ৯ম তম ।এর অন্যতম কারণ আমাদের নিন্মতম ভূমি আর উপকুল ঘেঁষা বদ্বীপ হল বাংলাদেশ ।এদেশে দুর্যোগ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক ।এই বেশি মাত্রায় দুর্যোগের সাথে ওলামাদের দেওয়া ফতুয়া মানে বেশি মাত্রায় পাপাচারের কোন সম্পর্ক নেই ।বৈশ্বিক ভাবে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে ।জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অন্যান্য দেশের তুলনায় বঙ্গীয় বদ্বীপে বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।সেকারনেই ঘূর্ণিঝড় বা বন্যায় বারবার এদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ,এবং ভবিষ্যতেও হবে ।আমি এটাই বিশ্বাস করি ।
আমি নিজেও ধর্মে বিশ্বাসী । আমি অজ্ঞেয়বাদে বিশ্বাসী নই বরং স্রষ্টায় সর্বোচ্চ বিশ্বাসী ।তবে ,আমি বিশ্বাস ব্যবসায়ী নই ,আমার বিশ্বাস অবশ্যই যুক্তি দ্বারা পরিক্ষিত ।আমার বিশ্বাস আদিম বা মধ্যযুগের মানুষদের মত নয় একই ভাবে বর্তমানের কপট বক ধার্মিকদের মত নয়।
তাই ,প্রত্যেকের উচিত নিজের বিশ্বাস কে কষ্টি পাথরে ঘষে দেখা ,নিজের বিশ্বাস কে প্রশ্ন করে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা ।তবেই,অহেতুক বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ,দুটাই মূর্খতার সর্বোচ্চ প্রমান ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৯ রাত ৯:২৮