মানুষ #মহামারী নিয়ে সচেতন হচ্ছে না কেন?
পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ চলমান #মহামারী নিয়ে সচেতন হচ্ছে না বা হতে চাচ্ছেনা। #কোভিড-১৯ এর মতো মারাত্মক এক #মহামারী রোগ নিয়ে সমগ্র পৃথিবী আজ মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অনিশ্চিত সময় যাপন করছে! কেউ বলছেন, এটা আল্লাহর #গজব! কেউ বলছেন, এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ! এই প্রতিশোধ নেয়া হচ্ছে আমাদের #অপকর্মের জন্য; #গজব এসেছে মানুষের কুকর্মের জন্য! প্রশ্ন হলো, মানুষ কি এমন মারাত্মক মহামারীর মুখোমুখি হয়েও #অপকর্ম থেকে বিরত হয়েছে বা হচ্ছে?
মৃত্যুকে নিজের কাছাকাছি দেখতে পেয়ে মানুষ আজ এতটাই সন্ত্রস্ত যে, নিজের মাকে করোনা রোগী নিশ্চিত হয়ে বাগিচায় ফেলে দিয়ে আসছে, বা করোনায় মৃত নিজের বাবার লাশ ফেলে রেখে দাফন না করে পালিয়ে যাচ্ছে! সেই মানুষগুলোর অধিকাংশই কি আবার একই অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে না? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগেঃ #গজব বা #মহামারী নিজ চোখে দেখতে পেয়েও মানুষ কেন দুষ্কর্ম এবং #অপকর্ম ছেড়ে দিচ্ছে না?
যদি যুক্তিগ্রাহ্যভাবে #চিন্তা করি, বাস্তবে কিন্তু এমনই হওয়ার কথা। প্রত্যেক মানুষ গজবকে দেখতে পাবে, মহামারী আকারে মৃত্যুকে দেখতে পাবে, ভীত সন্ত্রস্ত হবে কিন্তু বিপদ কেটে গেলেই আবার সে খারাপ কাজে লিপ্ত হবে। অতীতের উম্মাতগুলোর ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে। অধিকাংশ মানুষ খারাপ কাজ থেকে স্থায়ীভাবে দূরে সরে আসে নি, বা আসবে না।
কেন?
কারণ, অধিকাংশ মানুষের মধ্যে #চিন্তাশীলতা ছিল না বা, বর্তমানকালেও, নেই! যে চিন্তা করে না তার উপর এসব কর্মকান্ডের স্থায়ী প্রভাব পড়ার কথা নয়। তাই আমাদেরকে হা-হুতাস না করে, গোড়ায় হাত দিতে হবেঃ মানুষকে চিন্তাশীল হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
আসুন তাহলে, আমরা মানুষের #চিন্তাশীলতা নিয়ে কথা বলি।
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা করে। মানুষের পরিচয় হচ্ছেঃ হোমো সেপিয়েন্স! Homo sapiens: Man, the Thinker. #মানুষ, যে চিন্তা করতে পারে। মানুষের সাথে অন্য সকল প্রাণীর তফাৎ একটাই। সেটা হলো, #মানুষ #চিন্তা করতে পারে। মানুষের মধ্যে চিন্তার ক্ষমতা দিয়েই স্রষ্টা মানুষ সৃষ্টি করেছেন।
প্রায় ২০ কোটি বছর ধরে তেলাপোকা এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে। তার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি, সেও পৃথিবীতে পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে নি। প্রায় ১২ কোটি বছর ধরে পিঁপড়ে এই পৃথিবীতে আছে, তার জীবন যাপনের নিজস্ব শৃংখলার গণ্ডির মধ্যে। সে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারেনি, নিজেও এতটুকু পরিবর্তিত হয় নি। অল্প কয়েক দিনের হায়াত নিয়ে যে প্রজাপতির জন্ম হয় সেও এই পৃথিবীর হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে গত প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বছর ধরে। একইভাবে পৃথিবীর অনেক প্রাণী মানুষ সৃষ্টির বহুকাল আগে থেকেই এই পৃথিবীতে বসবাস করলেও তারা নিজেরা নিজেদের পরিবর্তিত করতে পারিনি এবং পৃথিবীরও কোন পরিবর্তন করতে পারেনি। সেই তুলনায়, মানুষের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়! মাত্র তিন বা পাঁচ লক্ষ বছর! তারপরও মানুষ নিজের পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং এই পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। তার এই পরিবর্তনের মূল ভিত্তি হলো, তার চিন্তা করার ক্ষমতা এবং জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে উন্নয়নের সক্ষমতা। এখানেই অন্য যে কোন #পশু-প্রাণীর সাথে মানুষের তফাৎ। মানুষ হতে হলে চিন্তাশীল হতে হবে; চিন্তা না করলে মানুষ হওয়া যায় না। যে চিন্তাশীল নয় তার জীবন ও তার আচরণ পশুর মত।
পশুর জীবন কেমন?
পশুর জীবন হলো জন্ম-মৃত্যু ঘেরা জীবনে ক্ষুধা-বিশ্রাম-উপভোগ দিয়েই পরিপূর্ণ। এই নিয়ে তার পূর্ণাঙ্গ জীবন। তার মধ্যে যেটা নেই সেটা হলোঃ #চিন্তাশীলতা। মানুষের জীবনেও জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে ক্ষুধা, বিশ্রাম ও উপভোগ থাকবেই। কিন্তু যেটা অতি অবশ্যই থাকতে হবে, #পশু থেকে মানুষকে পৃথক করার জন্য, তা হলোঃ চিন্তাশীলতা।
আসুন তাহলে, এবার আধুনিক মানুষের দিকে তাকাই! আধুনিক মানুষের জীবন কেমন?
ক্ষুধা নিবারণের জন্য একটি ভালো আয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার! সেজন্য একটি চাকরি দরকার, এবং সেজন্যই লেখাপড়া করে 'বড়' হতে হবে। এই বড় হওয়ার মধ্যে চিন্তার কোন বড়ত্ব নেই; যা আছে তা হলো, প্রাপ্তি ও প্রতিষ্ঠার বড়ত্ব। পড়ালেখার পথে না গেলে অন্য পথ হলো, পুঁজি থাকলে ব্যবসা আর জমি থাকলে চাষাবাদ। এই সব ক'টি পন্থার উদ্দেশ্য একটাই, খেয়ে-পরে বাঁচা। ঠিক যেভাবে অন্য যে কোন প্রাণী বা পশু বাঁচে।
এছাড়া, জীবনকে বহমান রাখার জন্য ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেরই শারীরিক বিশ্রাম দরকার, এবং, আধুনিক মানুষও, সকলেই ঘুমায়। ঠিক পশুদেরও যেমন ঘুমের প্রয়োজন হয়।
আবার, সব ধরনের প্রাণী প্রজনন-সুখে কাতর থাকে। প্রায় সকল প্রাণীরই জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ এটি। মানুষের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। কিছু মানুষ বরং যৌনতাকে অপব্যবহার করে এমন সব কাণ্ড করে, যেমনঃ সমকামিতার ইত্যাদি, যা পশুদের রুচিতেও ধরে না! এরপরও, ভোগ-বিলাসের নানা উপকরণ ও প্রক্রিয়া মানুষ আবিষ্কার করে যা পশুদের মগজে কখনো ধরে না। এখানে ধনী-দরিদ্র্যের পার্থক্য দৃশ্যমান হয় নানাভাবে। এই সবই তো করা হলো জীবন প্রক্রিয়ায় অনিবার্য অনুসঙ্গ হিসেবে, অন্য যে কোন প্রাণী বা পশুর মতো।
কিন্তু, মানুষের মগজে যে বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, মগজকে ব্যবহার করে চিন্তা করা, তা আধুনিক মানুষের কয়জন করে? যারা করে তারা মানুষ, নিঃসন্দেহে। কিন্তু, যারা করে না তাদের মানুষ বলি কীভাবে? গাড়ি বাড়ি নারীসঙ্গ সম্পদ ও ভোগবিলাস এই নিয়েই কি আজকাল অধিকাংশ মানুষ সন্তুষ্ট নয়? চিন্তা করার তাদের সময়ও নেই, ধৈর্যও নেই! আধুনিককালের মানুষ একটি শ্লোগান তৈরী করেছেঃ “খাও-দাও ও ফুর্তি করো!” এই বিশ্বাস নিয়ে যারা জীবন যাপন করে, মনুষ্য-সৃষ্টির সংজ্ঞা অনুযায়ী তাদের মানুষ বলা যায় না।
এই অ-মানুষদের উপর আল্লাহর গজব আর মহামারির কোন প্রভাব পড়ে না, যেমন পড়ে না অন্যসব পশুদের উপর! পশুরা যে বিপদ বুঝে না বা বিপদ চেনে না তা নয়! পশুর মতোই বুঝে ও চেনে; বিপদ এসে গেলে লেজ তুলে পালায়, আর বিপদ কেটে গেলে আবার তার পূর্বের জীবনে ফিরে যায়! যা ঘটে গেল তা নিয়ে সে চিন্তা করে না, বিপদ কেন এলো বা কে পাঠালো এসব চিন্তা তাকে কোন শিক্ষা দেয় না। তাই, সে কোন অন্যায় থেকেও ফিরে আসে না! অ-মানুষগুলো বরং অন্যায় ও অপকর্মের মাত্রাকে আরো বৃদ্ধি করার ফন্দি আঁটে! তাই, যারা মানুষের মতো চিন্তাগ্রস্থ হয়, সচেতন হয়, নিজেদের শুধরে নিয়ে আগায়, এদের সংখ্যা যদিও সর্বযুগেই খুব কম, তাদেরকে এই অ-মানুষগুলোকে অ-মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেই কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
চিন্তাশীলতা কি?
চিন্তাশীলতা হলো, মানুষকে নিয়ে সমাজকে নিয়ে সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে নিয়ে ভাবা। পরিবেশ নিয়ে ভাবনা, সমাজকে কীভাবে দূষণমুক্ত করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা; তা পরিবেশ দূষণ বা চরিত্রের দূষণ যা’ই হোক না কেন! চিন্তাশীলতা হলো, চতুপার্শ্বের মানুষকে কীভাবে দুঃখ কষ্ট থেকে বাঁচানো যায়, কীভাবে জীবন-মান উন্নত করা যায়, কীভাবে ভালোবাসাকে বিজয়ী করা যায় আর শান্তিকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়,- এসব নিয়ে চিন্তা করা। চিন্তাশীলতা হলো, অন্তরাত্মাকে (Soul)জাগ্রত করার, উন্নততর করার পথ খোঁজা। আর আত্মাকে পরমাত্মার (মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর)ইচ্ছার সান্নিধ্যে ও সমর্পনের মধ্যে নিয়ে যাওয়া। চিন্তাশীলতা মানে ‘পরের তরে’ ভাবা; প্রয়োজনে নিজের স্বার্থ বিলিয়ে দেয়া। চিন্তা মানে পরশীর কথা চিন্তা করা। চিন্তা মানে যে দেয় তার কথা শুধু নয়, যে দেয় না এমনকি যে ছিনিয়ে নেয় তার কথাও চিন্তা করা।
চিন্তা মানে, একা একা নয় আশেপাশের সব মানুষকে নিয়ে জান্নাতে যাওয়ার চিন্তা করা; কত বেশী মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো যায় সে চিন্তা করা। চিন্তা মানে, কোভিড-১৯এর সর্বগ্রাসী থাবার নীচে নিজে কীভাবে আপন পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকবো সেই চিন্তা নয় বরং আশেপাশের সকলে, পাড়া-প্রতিবেশীদের সকলে কীভাবে টিকে থাকবো সেই চিন্তা করা। চিন্তাশীলতা মানে শুধু নিজে নিজে করোনা ভাইরাস থেকে বেঁচে থাকা নয়, অন্যদেরও এর সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্যে ভাবনা। যাদের ভাবনা নেই, যারা চিন্তা করে না বা করতে পারে না তাদেরকে নিয়েও চিন্তা করা। এই চিন্তা মানে শুধু বসে বসে ভাবা নয়, বরং সাধ্যমত কাজ করা এবং অন্যদের দিয়ে কাজ করানো।
চিন্তাশীলতা মানে দুশ্চিন্তা নয়!
দুশ্চিন্তা হলোঃ মানুষ যখন নিজের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উদ্বেগ তাড়িত হয়, নিজের ক্ষতি বা হারানোর ভয়ে উদ্বেল হয়, তা'ই হলো দুশ্চিন্তা। এটা ক্ষুদ্রস্বার্থ-চিন্তা, নিতান্তই ব্যক্তিগত লাভ-অলাভ! এটা ব্যক্তির স্ট্রেস বা মানসিক চাপ বাড়ায় মাত্র। কিন্তু, দার্শনিক যখন চিন্তাক্লিষ্ট থাকেন, সমাজ-চিন্তক যখন নির্ঘুম রাত কাটান, দায়িত্বশীল যখন উদ্বেগে থাকেন, সেটা দুশ্চিন্তা নয়।
মানুষের মগজের যে বিশেষ ক্ষমতা সেটা মানুষকে দান করা হয়েছে চিন্তা করার জন্য। এই চিন্তা-ক্ষমতা ভোগবিলাসে মত্ত থাকার জন্য নয়। মগজ থেকে বেরিয়ে আসবে চিন্তাশীলতা, সৃষ্টিশীলতা, গবেষণা, উন্নতি এবং উন্নততর জীবন যাপন। এই উন্নতি উপভোগের উন্নয়ন নয়!
আপনর সন্তান!
আপনার ছেলে বা মেয়ে যদি ঘরে এসে বলেঃ “মা! আমার অমুক বন্ধুর বাসায় কোন খাওয়া-দাওয়া নেই, লকডাউনের জন্য গত দুই দিন ধরে ওরা সকলে কেবল মুড়ি আর পানি খেয়ে আছে! দাও না মা কয়েক কেজি চাল, ওদের বাসায় লুকিয়ে দিয়ে আসি!” মনে করবেন আপনি ভাগ্যবান, সন্তানকে চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে গড়তে পেরেছেন। আর যদি এমন হয় যে, নাদুস-নুদুস সন্তানকে যত্ন করে অষ্টপ্রহর খাওয়াচ্ছেন আর আপনার সন্তানও গেমস-বই-ইন্টারনেট নিয়ে এতই ব্যস্ত যে, এমন পৃথিবী-কাঁপানো মহামারিতেও তার অন্যকিছু নিয়ে ভাবার সময় নেই, তাহলে ব্যর্থতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠার আগেই আপনাকে ভাবতে হবে!
চিন্তাশীলতা ও শিক্ষা।
মানুষের ইতিহাসকে বুঝতে হলে চিন্তাশীলতার পাশাপাশি মানুষের শিক্ষাকে আমলে নিতে হবে। মানুষ নিজে শিখেছে এবং অন্যকে শিখিয়েছে এবং এই ক্রমাগত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ ক্রমাগত উন্নতির দিকে এগিয়ে গেছে। এটাই মানুষকে অন্য যে কোন প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। এক জেনারেশন বা প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে মানুষের জ্ঞানের ও শিক্ষার ক্রমোন্নতি হয়েছে। মানুষ ক্রমশঃ পরিবর্তিত হয়েছে। মানুষের মধ্যে 'ফ্রিডম অফ চয়েজ' বা ভালো-মন্দ বাছাই করে নেয়ার ক্ষমতা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই দিয়েছেন এবং সেটাই মানুষকে আলাদা করেছে অন্য সকল পশু ও প্রাণী থেকে। পশু-প্রাণীদের মধ্যে ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই, মানুষের তা আছে। তাই যেসব মানুষ ভালো-মন্দ বাছ-বিচার করে না, তারা পশুদের কাতারেই থেকে যায়!
এভাবে চিন্তা #শিক্ষা ও #জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানুষ আদিমতা থেকে আধুনিকতার দিকে এগিয়েছে, মানুষ পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বের দিকে এগিয়েছে। বন্যতা থেকে এগোতে এগোতে যেসব সভ্যতা নিজেদেরকে উজ্জ্বল ভাবে পৃথিবীতে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে তাদের প্রত্যেকটি সভ্যতার এই মূল শক্তি ছিল #চিন্তাশীলতা ও #সৃষ্টিশীলতা। সভ্যতা হিসেবে তারাই বেশি স্বীকৃতি পেয়েছে যাদের সাহিত্য বিজ্ঞান এবং দর্শন যত বেশি সমৃদ্ধ ছিল।
সভ্যতাগুলোর কথা।
ইসলামের অভ্যুদয়ের বহু আগে, পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে গ্রিকরা কঠোরভাবে এবং ক্রমাগতভাবে চিন্তাকে কাজে লাগিয়েছে বুঝা যায়। কারণ, তাদের ধারণা ছিল তাদের চতুর্দিকে বর্বররা ঘিরে আছে, যারা যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে জীবন যাপন করে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মিশরীয় সভ্যতা শতশত বছর কাটিয়ে দিয়েছে মৃতদেহকে কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় (মমি ও পিরামিড) তার পেছনে সময় সম্পদ ও চিন্তার যোগান দিতে গিয়ে। আসিরীয় সভ্যতা শত শত বছর ধরে দেব-দেবীর উপাসনা করে এসেছে যাদের অর্ধেক মানুষ অর্ধেক পশু! এই ধরনের যুক্তিহীন এবং কষ্টকর কল্পনার মধ্য দিয়ে কোন কোন সভ্যতা এগিয়ে গেছে এবং প্রতাপশালী শাসকের উপর দেবত্ব আরোপ করে তাকে আরাধ্য বানিয়েছে নিশ্চিন্তে! এদের মধ্যেও যারা যুক্তিসঙ্গতভাবে তাদের দর্শন বিজ্ঞান এবং সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে তারাই চিন্তাকে এবং সময়কে কাজে লাগাতে পেরেছে এবং কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে গেছে।
তাই দেখা যাচ্ছে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে ক্রমাগত চিন্তাভাবনাই গ্রীক সভ্যতার ভিত্তি। যদিও চরম ভোগ-বিলাস ও পৌরানিক কল্পকথা ভিত্তিক ধর্ম-কৃষ্টি গ্রীকদের মধ্যেও ছিল, তবু চিন্তা ও জ্ঞানের বিবিধ শাখায় বিশেষত সাহিত্য ও দর্শনে তাদের অর্জন ছিল অসাধারণ। তাদের মানসিক অবস্থার বিকাশ লক্ষণীয়। মানুষকে চিন্তাশীল হতে সাহায্য করার জন্যেই তাদের কবি-সাহিত্যিকরা কবিতা ও সাহিত্য রচনা করেছিলেন, দার্শনিক ও ইতিহাসবেত্তারা লিখেছিলেন, আর শিক্ষকরা শিখিয়েছিলেন। হোমার, প্লেটো, এরিস্টোটল এবং আরো অনেকে সমাজে চিন্তাশীল শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। গ্রিক সভ্যতা এখন আর সেই ভাবে টিকে নেই। কিন্তু গ্রীক সভ্যতার চিন্তাভাবনার বিস্তর প্রভাব রয়েছে পাশ্চাত্য সভ্যতার উপর। যার ফলে এখনো পাশ্চাত্য সভ্যতা খবরদারি করছে সমগ্র বিশ্বের উপর, কারণ চিন্তা-গবেষণার ক্ষেত্রে ওরা অন্য সকলের চেয়ে এগিয়ে।
খারাপ চিন্তার ফলাফল
চিন্তা করার ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ অতীতে যে সব সময় চিন্তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করেছে তা নয়। মানুষের লোভ, ভোগের লিপ্সা আর নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার কারণে মানুষ ভালোবাসার বদলে হিংসাকে লালন করেছে, নিজের সীমা লঙ্ঘন করে অন্যের স্বাধীনতা-সম্পদ ও জীবন হরণ করেছে। যে মানুষ কাউকে প্রাণ দিতে পারে না সে মানুষই অন্য মানুষের প্রাণ হরণ করেছে, প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে অতিমাত্রায় হত্যা করেছে পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ ও মৎস্য সম্পদ। গাছপালা ও বন ধ্বংস করেছে নির্বিচারে। মিল-কারখানার বীষাক্ত বর্জ্য-ধোঁয়া ও গ্যাস দিয়ে বীষাক্ত করেছে মিঠা-পানি, নির্মল বায়ু আর ক্ষতিগ্রস্থ করেছে আকাশের ওজন-স্থর, যা পৃথিবীর সুরক্ষার জন্যেই অতীব প্রয়োজনীয়। মানুষ প্রাণবন্ত সবুজ প্রান্তরকে ঢেকে দিয়েছে প্রাণহীন ইট-পাথর আর লোহা দিয়ে। আপন খেয়ালে সে ভরাট করেছে খাল-নদী-হ্রদ আর সমতল করে উপড়ে ফেলেছে পাহাড়ের পর পাহাড়কে! অথচ আল্লাহ বলছেন, তিনি পাহাড়কে স্থাপন করেছেন পেরেক হিসেবে!
এসব অপকর্ম যারা করেছে তারা চিন্তা করেনি, এই পৃথিবীর সাজানো বাগানের প্রতি কী পরিমান অবিচার তারা করছে। মানুষের, এবং অন্যসব প্রাণীর, আত্মার ক্রন্দনকে নিয়ে উদ্ধত অত্যাচারী ক্ষমতাধর মানুষগুলো তামাশা করেছে আর তাদের প্রাণনাশ ও রক্তপাতের হোলিখেলায় মজলুমের আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয়েছে আকাশে-বাতাসে! সব ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া আছে। এর প্রতিক্রিয়ায়, এই ‘সাজানো বাগান’র যিনি সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক তাঁর পক্ষ থেকে এমন ‘গজব’ এসেছে যে, চিন্তাশীল-চিন্তাহীন, অত্যাচারী-অত্যাচারিত নির্বিশেষে সকলেই যেন পালাবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না!
এই সুন্দর পৃথিবীতে সুখে-শান্তিতে বসবাসের অযোগ্য প্রমাণ করেছে মানুষ নিজেকে! এবার শিক্ষা নিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
ইসলাম চিন্তাশীল মানুষের ধর্ম।
ইসলামের আগমন সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। ইসলাম চিন্তাশীল মানুষের ধর্ম। আল্লাহর পাঠানো আল কোরআনের ছত্রছায়ায় সুস্পষ্ট চিন্তা নিয়ে চিন্তাশীল মুসলমান জাতি ইসলামী সভ্যতার পত্তন করে, প্রাচীন সব, গ্রীক-রোমান-পারস্য, সভ্যতাকে যেছনে ফেলে। সেই মুসলমানরাই আবার পিছিয়ে পড়া জাতিতে পরিণত হয়েছে, ভোগ-বিলাসে মত্ত হওয়া, বৈরাগ্যবাদে মূক্তি খোঁজা আর চিন্তাশীলতাকে বাদ দিয়ে জ্ঞান-গবেষণায় পিছিয়ে পড়ার কারণে। অথচ, ইসলাম মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়। আল্লাহ বলেন, তারা চিন্তা করে না কেন? গবেষণা করে না কেন? যারা চিন্তা করে না তাদের কোরআন বর্ণনা করেছে গাধা হিসেবে। অ-মানুষও বলা হয়নি, পশুও বলা হয়নি! বলা হয়েছে ‘গাধার মতো’! গাধারা কি মুসলমান? গাধা কি পশু নয়? গাধাকে কি মানুষ বলা যায়? সুতরাং, যাদের মধ্যে চিন্তাশীলতা নেই তাদের মানুষ যেমন বলা যাবে না তেমনি তাদের মুসলমান বলাও কঠিন! তাই, একজন মুসলমানকে হতে হবে চিন্তাশীল মানুষ। চিন্তাহীন অনুকরণ আর গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে একজন মুসলমান চলতে পারে না।
মুসলমানরা কতটুকু চিন্তাশীল?
বর্তমান পৃথিবীতে সর্বমোট প্রায় ১৬০ কোটি মুসলমানের মধ্যে কতজন মুসলমান চিন্তাশীল? যদিও প্রত্যেক মুসরমানেরই চিন্তাশীল হওয়ার কথা! সেটা তো কেতাবী কথা মাত্র! অনেকে তো আবার নামাজী নয়, কিন্তু মুসলমান! যারা বেনামাজি বা অবিশ্বাসী তারা তো চিন্তার পথ হারিয়েছে জটিলতা পঙ্কিলতা ইত্যাদির মধ্যে। যে ক’জন নামাজী আছেন তার মধ্যে ক’জন সত্যিকার অর্থে চিন্তাকে লালন করেন? ক’জন নামাজী মুসলমান নামাজের ভেতরে (নামাজের ভেতরে যা চিন্তা করার কথা) বা বাইরে (মানুষ,পরিপার্শ, সৃষ্টি এবং স্রষ্টা সম্পর্কে) চিন্তা করেন? যে চিন্তা করে না তার উপর ধর্মের প্রভাবই বা কি আর গজবের প্রভাবই বা কি! তাই, যারা চিন্তা করেন তাঁদেরকে, এখনি শুরু করতে হবে ‘চিন্তাশীল মুসলমান’ তৈরী করার কাজ।
একজন মুসলমানকে চিন্তাশীল হতেই হবে।
যে কোন একজন মুসলমানকে অতি-অবশ্যই চিন্তাশীল মানুষ হতে হবে। কিন্তু বাস্তব হিসেবে দেখা যায় চিন্তাশীল মুসলমান অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ। অন্যদিকে, সুফিবাদ বৈরাগ্য ও পীর-মুরিদীর গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছে যে সকল মুসলমান, তাদের আবার চিন্তাশীলতার সময় কই? নানা বাহানায় ওরা দুনিয়া নিয়ে ভাবেই না! অথচ, দুনিয়া আখেরাতের ভিত্তি। তাই, দুনিয়াকে চিন্তায় স্থান দিতে হবে, আখেরাতকে সামনে রেখে। কিন্তু কেউ যদি এই দুনিয়ায় বর্তমান থেকেও আখেরাতের চিন্তায় পুরোপুরি আচ্ছন্ন থাকেন এবং দুনিয়ার কাজে অবহেলা করেন সেটা কি অপরাধ নয়? এটা এক ধরনের পলায়নপরতা। ইসলাম বৈরাগ্য ও সুফিবাদকে সমর্থন করে না।অথচ এই উপমহাদেশের মুসলমানদের বড় একটি অংশের উপর এবং সামগ্রিকভাবে নানা বিষয়ে রয়েছে বৈরাগ্যবাদ ও সুফিবাদের প্রভাব। ফলে এদেরকে গজব ঈমান ও বিজ্ঞান সম্পর্কে পৃথকভাবে সুস্পষ্ট করে বোঝানো খুবই কঠিন। করোনা মহামারি দেখা দেয়ার পর থেকে এটা আঁচ করা গেছে ভালোভাবেই!
এধরণের ত্রিশঙ্কু অবস্থায় #মহামারি নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা আশা করা অবাস্তব। তাই, সচেতন করতে হলে ধৈর্য না হারিয়ে বিরক্ত না হয়ে বার বার বলতে হবে এবং, আসল কথা হলো, হাত দিতে হবে মূল কাজেঃ মানুষ গড়ার কাজ।
আসুন আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে চিন্তাশীল মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত হই। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
মিরপুর, ঢাকা, ২৩/০৪/২০২০
আশরাফ আল দীন।। শিক্ষাবিদ, গবেষক, কবি ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:৩৮