আমার বরাবরই মনে হয়েছে বাংলাদেশ একটি একান্নবর্তী পরিবার। বিশেষতঃ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ভয়ঙ্কর এক মহামারীর আগ্রাসন সমগ্র পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে দেখে মনে হয়েছে এই অনিশ্চিত দূর্যোগের মুখে আমরা একান্নবর্তী পরিবারের মতো এক হয়ে দাঁড়াতে পারি! এত ছোট্ট ভুখন্ডের মধ্যে এত বেশি মানুষ, একই আচারের একই ব্যবহারের একই বিশ্বাসের একই সংস্কৃতি ও কৃষ্টির, পৃথিবীর আর কোথাও নেই। একই ভাষার একই আবহাওয়া এই অনিন্দ্যসুন্দর দেশে আমরা সবাই গাদাগাদি করে একসাথে বসবাস করছি একটি #একান্নবর্তী #পরিবারের মতো।
একান্নবর্তী পরিবার কি? সে সম্পর্কে আজকাল অনেকের শুদ্ধ ধারণা নেই। অনেকের ধারণা নিতান্তই কেতাবী। বাস্তবে তারা বুঝে না একটি #একান্নবর্তীপরিবারে কি হয়, কিভাবে হয়, এখানে কতটুকু ছাড় দিতে হয়, আবার তা কতটুকু আনন্দেরও হয়! কারণ, আজকাল অধিকাংশ পরিবারের সন্তান সংখ্যাই তো এক বা দুই, বড়জোর তিন জন। তার ভিতরে যদি এক ছেলে বা এক মেয়ে হয় তাহলে তো আহ্লাদের আর সীমা থাকে না! ওই #পরিবারে সন্তানদের বেড়ে ওঠার জন্য প্রতিযোগিতা তো নয়ই বরং মা-বাপ অতি আদরে মাথায় তুলে সন্তানদের যে ভাবে লালন করেন তাতে এই সন্তানরা #একান্নবর্তী পরিবারে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার যে অম্ল-মধুর প্রতিযোগিতা এগুলোর কিছুই তারা বোঝে না! ওরা বুঝতে শেখে না যে একত্রে থাকতে হলে অন্যের ভিন্নমত সহ্য করতে হয়, ওরা বুঝে না একত্রে শান্তিতে সহাবস্থান করতে গেলে অন্যকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়, আর তাতেই পরবর্তীতে সবার জন্য আনন্দদায়ক পরিবেশ তৈরি হয় যেখানে কোন হিংসা বা ঘৃণা থাকে না বরং বিরাজ করে সৌহার্দ্য, ভালোবাসা ও সহমর্মিতা- রক্তসম্পর্কের মানুষ গুলোকে নিয়ে এক #পরিবারের মতো। ওরা এসব শিখতে পারে না, কারণ বেড়ে ওঠার নানা ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতা তাদের হয়না।
খুব ছোটকাল থেকেই একান্নবর্তী পরিবার দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমাদের দাদার পরিবারে চাচা-জেঠারা মিলে সদস্য ছিলেন অনেক। আমরা যখন দেখেছি তখন যদিও তাদের সম্পত্তি ও ঘর বিভক্ত হয়ে গেছে, আলাদা পরিবার নিয়ে সকলেই আলাদা করে থাকেন, কিন্তু সবাই ছিলেন একই উঠোনের চতুর্দিকে পাশাপাশি ঘরে। ধানের গোলা আলাদা হলেও গোলাগুলির অবস্থান ছিল পাশাপাশি। সকালবেলা দরজা খুলে ঘর থেকে বের হলেই ডানে-বাঁয়ে তাদের সাথেই দেখা হতো। আবার এক ঘরের হাসি বা কান্নার শব্দ অন্য ঘরে পৌঁছে যেত; এটাও সহ্য করতে হতো। বাড়ির পেছনের বাগিচার আম-জাম-কাঁঠালের ফল একা খাওয়ার উপায় ছিল না। সবাইকে নিয়ে ভাগ করে খেতে হতো। এই ভাগাভাগির মধ্যে কেউ কেউ যে 'দাদাগিরি' করত না তা নয়, কিন্তু তা মেনে নিতে হতো। আনন্দটা হলোঃ সবাই মিলে একসাথে আম কুড়ানো, সবার ঘরেই একসাথে আম, জাম ও কাঁঠাল খাওয়া!
নানার বাড়িতে অনেকগুলো মামা ও খালা ছিলেন আমাদের। আমরা তাঁদের সব সন্তানরা মিলে যখন নানাবাড়িতে একত্রিত হতাম, মাটির তৈরি এত বিশাল দোতালা বাড়িতেও থাকার জায়গার সংকুলান হতো না! কেউ কেউ ভালো জায়গাটা দখল করে নিত, আর অন্যরা একজন আরেকজনের গায়ের উপর শোয়ার মত অবস্থায় রাত কাটিয়ে দিত। খেতে বসে কেউ কেউ ভালো জিনিসটা নিজের দখলে নিয়ে নিল, এটা বুঝতে পেরেও অন্যদের মধ্যে এ নিয়ে কোন বিবাদ ছিল না। কারণ, সবচেয়ে মজা হলো এতগুলো আত্মীয় একসাথে সময় কাটানো কোনরকম হিংসা-বিদ্বেষ ছাড়াই।
আমাদের ঘরে আমরা ভাই-বোন ছিলাম অনেক। বড় হতে হতে আমাদের পড়ার টেবিল আলাদা হয়ে গেলো, হারিকেনটাও আলাদা হয়ে গেলো। তখন প্রতিযোগিতার ছিল কে কোনটা দখল করবে, কারণ সবগুলো তো একই মানের ছিল না! কিন্তু, কেউ কেউ মনোক্ষুন্ন হলেও এ নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে স্থায়ী কোনো বিবাদ তৈরি হতো না। যেমন, খেতে বসলে শুধুমাত্র ডাল নিয়ে যেরকম সমস্যা হতো তা ভেবে আমার এখনো হাসি পায়। কেউ পছন্দ করে ডালের উপরের পাতলা পানিটা, কেউ পছন্দ করে নিচে তলায় বসে থাকা ঘন ডালটুকু, আর কারো রুচি সম্মত হচ্ছে পুরো বাটিতে একটা ঘুঁটা দিয়ে সেখান থেকে কিছুটা নেয়া! এই নিয়ে আমরা ভাইদের মধ্যে প্রায়ই কথা কাটাকাটি বা বকাঝকা হতো। কিন্তু ব্যাপারটাকে আম্মা অদ্ভুতভাবে সামাল দিতেন। এটা কখনো এমন কোন পর্যায়ে চলে যায়নি যে খাবার প্লেট আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে ঘর থেকে কেউ বেরিয়ে গেল রাগ করে, অথবা না খেয়ে মন খারাপ করে রুমে চলে গেল! এ ধরনের কান্ড যে কোথাও হয় না তা নয়! কিন্তু আমার আম্মা তা হতে দেননি কখনো। তিনি সুন্দরভাবে পরিচালনা করতেন এসব কিছু। একটি পরিবারে মুরুব্বি যাঁরা থাকেন তাঁরাই সীমারেখা নির্ধারণ করে দেন, এবং সবকিছুকে সুন্দরভাবে সামলে নেন। তাহলেই সংসারে সুখ থাকে, এবং আনন্দ বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশ একটি পরিবারের মতো। তাই, এখানে আমাদের আপন লোকগুলোই বিভিন্ন মতবাদের হতে পারবে; তাই বলে তারা আমাদের শত্রু নয়। এদেশের সব মানুষ একটি রাজনৈতিক মতাদর্শকে ধারণ করবে, এ কথা বলা ভুল। কারণ, আজ যিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করছেন কয়েকদিন পরে তিনিও তার মতাদর্শ পাল্টাতেই পারেন। তাই, ভিন্ন মতাদর্শের কাউকে আমি তেমনভাবে ঘৃণা করা উচিত নয় যেভাবে আমি আমার শত্রুকে ঘৃণা করি। এটা কোন শত্রুতার ভিত্তি হতে পারে না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বলে জাতিকে বিভক্ত করা নিতান্তই রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কারণ, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কর্মকাণ্ড যেমন দেশের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে, ঠিক তেমনি একজন রাজাকারের সন্তানও দেশ প্রেমিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। আমরা এখন অদৃশ্য এক বিভাজনকে সামনে এনে স্থায়ী বিভক্তি সৃষ্টি করাটা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
এখন আমাদের আছে একটি স্বাধীন ও কার্যকর রাষ্ট্র! এখানে আইন আছে, প্রশাসন আছে। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে তার শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং বাকি সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। স্বধীন নাগরিক হিসেবে রাজনীতির সময় রাজনীতি করবে, যাদের এ ব্যাপারে আগ্রহ আছে তারা। কিন্তু সব বিষয়ে সব ক্ষেত্রে আমরা যদি রাজনীতিকে টেনে আনি তাহলে আমাদের জাতির বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে, উন্নতি ও অগ্রগতি ব্যাহত হবে। বর্তমানে এই সর্বগ্রাসী মহামারির (কোভিড-১৯) সময় প্রত্যেকের এগিয়ে আসা উচিত একসাথে কাজ করার জন্য, একযোগে কাজ করার জন্য এবং দূর্যোগ-পরবর্তী অবস্থা সামাল দেয়ার জন্য। এখন কেউ কাউকে গালিগালাজ করে, ছোট করে, সুযোগ না দিয়ে, বঞ্চিত রেখে, অথবা দলবাজি করে জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা মোটেই সঠিক হবে না।
এখানে উল্লেখ করতেই হয় যে, একান্নবর্তী প্রত্যেকটি পরিবারে কিছু শত্রু থাকে। কেউ ঘরের ভেতরের আর কেউ ঘরের বাইরের। যাঁরা পরিচালক আছেন মুরুব্বি আছেন তাঁদেরকে চিহ্নিত করতে হয় এই শত্রুদেরকে। সেটা নিয়ে পুরো ঘরকে বিষিয়ে না তুলে আপন ঘরকে পরিচালনা করতে হয় সুন্দর ভাবে, যাতে করে শত্রুরা কখনো ঘরের ভেতর অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পারে।
#বাংলাদেশেরও কিছু শত্রু আছে, ঘরের ভিতরে অথবা ঘরের বাইরে, অস্বীকার করার উপায় নেই। শত্রু না বলে বলতে পারি, তারা এমন কিছু লোক বা পক্ষ যে তারা অন্তর থেকে চায়না এদেশের উন্নতি হোক। তারা সারাক্ষণ এই দেশের মানুষের ভিতর বপন করে রাখবে অনৈক্যের বীষাক্ত বীজ! বাইরে বন্ধুর মতো চেহারা দেখালেও অন্তর থেকে তারা এদেশের মানুষকে বিভক্ত করে রাখার, অশিক্ষিত করে রাখার, মাদকাসক্ত করে রাখার, বিশৃংখল করে রাখার আপ্রান চেষ্টা চালাবে। আমরা যারা দেশ প্রেমিক তারা যদি কথাটাকে বুঝতে না পারি তাহলে সেটা হবে আমাদের জন্য আত্মহত্যার শামিল। এজাতির সার্বিক উন্নতির জন্য চাই ইস্পাত-কঠিন #ঐক্য আর সুদৃঢ় সম্পর্ক।
বাংলাদেশের সকল মানুষ, আসুন আমরা এদেশের প্রতিটি মানুষকে ভালোবেসে এগিয়ে যাই।
আশরাফ আল দীন।। শিক্ষাবিদ, কবি, গবেষক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।
মিরপুর, ১৯/০৪/২০২০
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১১:৫৭