নানাভাইয়ের গল্পের আসর জমে উঠেছে। উমেইর আর উমাইজা গা ঘেঁষে বসেছে দুই পাশে, আর জয়নব এসে নানাভাইয়ের কোলের উপর তার জায়গা করে নিয়েছে। নানাভাই বললেন,
: আজকে তোমাদেরকে মিস্টার জ্যাকের #গল্প বলবো।
: মিস্টার জ্যাক কে, নানাভাই?
: আমাদের #পাহারাদার, আমাদের বাড়ি পাহারা দিত।
পাহারাদারের #গল্প বলার আগে যে বাড়ি সে পাহারা দিতো তার খানিকটা বর্ণনা দিয়ে নিই। আমার দাদার বাড়ি হলো ইউসুফ তালুকদার বাড়ি। এর দীর্ঘ ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আছে। কিন্তু, তা'হলে কি হবে? এই বাড়িতে এখন লোক হয়ে গেছে অনেক। এই বাড়ির চারিদিকে অন্য আরো অনেকগুলো বাড়ি গড়ে উঠেছে। ফলে, এই #বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমার আব্বা নতুন একটি বাড়ি করলেন রেলওয়ে স্টেশনের কাছে, উনার গড়া স্কুলের পাশে। বাড়িটার মূল দালানের সামনে বিরাট উঠোন, এবং তারপর সদর দরজা। সদর দরজার পাশে উঠোনের এক প্রান্তে একখানা কাচারি ঘর। আব্বার সামাজিক কাজকর্মের বৈঠক গুলো এখানেই হতো। উঠানের দক্ষিণ পাশে একখানা ছোট ঘর, মূলতঃ মেহমানদের থাকার জন্য, আমরা বলতাম দেউড়ি ঘর। পাশেই ছিল একটা চাপা কল। মূল দালানের পেছনে ছোট্ট আর একটি উঠোন ছিল। তার এক পাশে রান্নাঘর। উঠোনের অপরপাশে পুকুর, ভেতর-বাড়ির ছোট্ট পুকুর। বাড়ির উত্তর পাশে অনেকখানি জায়গা নিয়ে একটি বাগিচা, নানা রকম গাছগাছালিতে ভরা। বাড়ির এক পাশ দিয়ে চলে গেছে রাস্তা আর অন্যদিকগুলোতে ফসলের মাঠ। পশ্চিম পার্শ্বে কয়েকটা #বাড়ি ছিল, আমাদের বাড়ি থেকে পৃথক। আমাদের বাড়ি আর রাস্তার মাঝখানে ছিল সীমানা-দেয়াল। অন্যদিকে ফসলের মাঠ থেকে বাড়িটাকে পৃথক করা হয়েছিল খাল কেটে। ওই খালে পানি ছিল, মাছ ছিল। এই খাল, দেওয়াল আর গাছ গাছালি দিয়ে বাড়িটা এমনভাবে ঘেরা ছিল যে বাইরে থেকে সদর দরজা ছাড়া অন্য কোন পথে কোন ভদ্র লোক বাড়িতে ঢুকতে পারতো না। এই পুরো বাড়াটাই পাহারা দিতে হতো জ্যাককে।
: উনি কি তোমাদের #দারোয়ান? কোন দেশের মানুষ, নানাভাই?- উমেইর প্রশ্ন করলো। নানা ভাই হাসলেন, জবাব দিলেন না, শুধু বললেন,
: হ্যাঁ, #পাহারাদার বটে! তার আগে চলো তোমাদের নিয়ে অন্য জায়গা থেকে ঘুরে আসি।
আমাদের যে পুরাতন দাদার বাড়ি সেটা আমাদের বাড়ি থেকে মাইল দুয়েক দূরে। আমরা দুই ভাই মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম। কারণ, আমাদের খেলার সাথীরা সবাই ছিল ওই বাড়িতেই! একবার খবর পেলাম সেখানে বাঘা কুকুরটা বাচ্চা দিয়েছে। আমি আর সেজো ভাই গিয়ে একটি কুকুরছানাকে খুব পছন্দ করে ফেললাম। আমাদের আগ্রহ এত বেশি ছিল যে কুকুরটা মায়ের দুধ ছাড়ার আগেই আমরা তাকে নিয়ে আসলাম আমাদের বাড়িতে। যদি আবার কেউ নিয়ে যায়, সেই ভয়ে! বাড়িতে আনার পর আমরা একটু টেনশনে থাকলাম এই ভেবে যে আব্বু এটাকে কীভাবে নেবেন! কারণ, আমরা তো আব্বুকে বলিনি যে বাড়িতে কুকুর আনছি! তাছাড়া, মুরব্বিদের কাছে শুনেছি, #কুকুর ঘরের ভেতরে আনতে নেই, তাহলে ঘরে ফেরেস্তা আসেনা। আমরা দুই ভাইয়ের যুক্তি হলো, ওকে তো আমরা ঘরে ঢুকাবো না! সে তো ঘরের বাইরে থাকবে, তবে বাড়ির ভেতরে। অফিস থেকে ফিরে আব্বু ঘটনাটা জানতে পারলেন কিন্তু কিছুই বললেন না। আমরা খানিকটা স্বস্তি বোধ করলাম। আমরা কুকুর ছানাটাকে দুধ খেতে দিলাম। ভাত খাওয়ার বয়স তার এখনো হয়নি! ওর তো ভালো করে চোখও ফোটেনি! #কুকুর ছানাটি সারাক্ষণ মায়ের জন্য কান্নাকাটি করল। কিন্তু আমাদের আদর-যত্নের কমতি নেই। আম্মা আমাদেরকে সহযোগিতা করেন, কিভাবে কি করতে হবে বলে দেন। ওর কান্নার মাত্রা ধীরে ধীরে কমে এলো। শুধু দুধ খায় আর কাপড়ের কুন্ডলীর ভেতর ঘুমায়।
ওর নাম কি দেবো তা নিয়ে আমাদের মধ্যে উত্তেজনার শেষ নেই! কেউ বলে, বাঘা। কেউ বলে, টমি। কেউ বলে, ভুলো। নাহ! সবই পরিচিত নাম, গল্প-কবিতায় আর মুখে মুখে এইসব নামই তো শোনা যায়! অফিস থেকে ফিরে আব্বু বললেন, ওর নাম হবে, জ্যাক। বাহ্, সুন্দর নাম তো! একেবারেই আনকমন! সবার মনে ধরলো নামটা। এইবার জয়নব বললো,
: ও নানাভাই! এটাই তোমাদের দারোয়ান, মিস্টার #জ্যাক?' নানাভাই হো হো করে হেসে উঠলেন, আর হাসতে হাসতেই বললেন,
: হ্যাঁ, নানাভাই। এতো বিশ্বস্থ দারোয়ান আর হয় না! সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা সবাই তাকে খুব ভালোবাসতাম, আর জ্যাকও আমাদের ভীষণ ভালোবাসতো।' এবার উমেইজা বললো,
: সেই গল্পটাই বলো, নানাভাই!
কয়েকদিনের মধ্যেই #জ্যাক আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেললো। সে আর খুব বেশি চেঁচামেচি করে না বা ভয় পায় না। আমরা চাইলাম তাকে বাঘা কুকুর হিসেবে বড় করতে। আব্বার পরামর্শে আমরা একটা পদ্ধতি বের করলাম। সেটা হলো, জ্যাককে রাতের বেলা আমরা ছেড়ে দিতাম কিন্তু দিনের বেলা একটি ড্রামকে উপুড় করে তার ভিতরে তাকে রেখে দিতাম। উপরের কাটা অংশ দিয়ে আলো-বাতাস যেত কিন্তু সে আর কোথাও বের হতে পারতো না, এবং কাউকে দেখতে পেতো না। সে কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করতো, তারপর ঘুমিয়ে পড়তো। সঠিক সময়ে তাকে বের করে এনে খাবার-দাবার দেওয়া হতো, আবার তার ঘরে তাকে রেখে দেয়া হতো। দিনে দিনে জ্যাক বেড়ে উঠতে থাকলো। ওর রঙ ছিল লাল, গলার কিছু অংশ ছিল সাদা, কান দুটো ছিল ঝুলঝুলে। ওকে দেখতে ভালোই লাগতো। নানা ভঙ্গিমা করে সে আমাদের #আদর নিতো। কয়েকদিন পর আব্বু ওর জন্য গলার একটি বেল্টসহ সুন্দর একখানা চেইন নিয়ে আসলেন। তাতে ওকে নিয়ে চলাফেরা করতে আমাদের সুবিধা হলো। দিনের বেলায় তাকে আমরা খুব অল্প সময় বাইরে রাখি, বাকি সময় সে তার ঘরে অন্ধকারের মধ্যে থাকে এবং রাত্রিবেলা তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। সে সারা রাত জেগে জেগে বাড়ীর চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ায় এবং যেকোনো জীবন্ত কিছু দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে তাড়িয়ে দেয়।
কিছুদিন যাওয়ার পর ওকে আর আমরা দিনের বেলা অন্ধকার ঘরের মধ্যে রাখতাম না। ঘরের পেছনের দাওয়ায় তাকে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। আমাদের বাড়ির সবাইকে সে ভালো ভাবেই চিনতো। কিন্তু অন্য অজানা কাউকে দেখলেই সে ঘেউ ঘেউ করে উঠতো। এর কিছুদিন পর আমরা দিনের বেলায়ও তাকে ছেড়ে দিয়ে রাখতাম। সে সারাদিন মূল দালানের দরজার বাইরে অথবা সদর দরজার কাছে শুয়ে বিশ্রাম নিতো এবং অনাহুত কেউ আসলেই ঘেউ ঘেউ করে উঠতো। আমরা কেউ গিয়ে সামলে নিলে তারপর সে নিষ্ক্রান্ত হতো। এই পুরো বাড়িটাই তার একার দখলে যেন! এমন কি উঠোনের উপর দিয়ে কাকা উড়ে যেতে দেখলেও সে ঘেউ ঘেউ করে জানিয়ে দিতো, “এই বাড়িতে এসো না বাপু!” আমরা বিকেলে উঠোনে খেলার সময় জ্যাকও আমাদের সাথে যোগ দিতো। আমাদের সবার #ভালোবাসা ছিল ওর জন্যে, সেও #ভালোবাসতো এবাড়ির সবাইকে। সে জানতো কীভাবে #আদর নিতে হয়! আমাদের জন্য সে ছিল এক বাড়তি আনন্দ! কিন্তু রাত্রিবেলা তাকে কখনো দেখিনি কোথাও শুয়ে বা বসে থাকতে। সে সারাক্ষণ বাড়ীর চতুর্দিকে ছুটে বেড়াতো এবং পাহারা দিতো। চোর তাড়ানোর অনেকগুলো ঘটনা তার আছে। তার মধ্যে কয়েকটা তোমাদেরকে বলি। উমেইর বললো,
: হ্যাঁ! হ্যাঁ! ওই ঘটনাগুলোই বলো, নানাভাই!’ অন্যরাও বলল, হ্যাঁ! হ্যাঁ!' নানাভাই বলতে শুরু করলেন।
একবার রাত দশটার দিকে হঠাৎ #জ্যাক প্রচন্ড শোরগোল শুরু করলো। আমাদের ঘরের উত্তর দিকে বাগিচার সাথে ঘরের কোনায় কচু-বনের মতো কিছুটা জায়গা ছিলো। সেদিকে লক্ষ্য করে সে প্রচন্ড ঘেউ ঘেউ করছে, এক পলকের জন্যও সেদিক থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি সরাচ্ছে না। আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সে একটুখানি দরজার সামনে এসে আবার ঘেউ ঘেউ করে ওই দিকে ছুটে যাচ্ছে। আব্বা বুঝতে পারলেন তাঁর প্রিয় কুকুরটা কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। তিনি হাতে লাঠি ও টর্চ লাইট নিয়ে বের হলেন। আমি তাঁর পিছে পিছে হাতে হারিকেন নিয়ে বের হলাম। তখনও আমাদের এলাকায় ইলেকট্রিসিটি আসেনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। আমাদেরকে এগোতে দেখে #জ্যাক কচুবনের মাঝখানটা লক্ষ্য করে প্রচন্ড লাফালাফি এবং ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করলো। আমার ভীষণ ভয় ভয় লাগছিলো! হারিকেনের আলোতে বেশি দূরে স্পষ্ট দেখা যায় না! আব্বা হাতের টর্চ লাইট জ্বেলে কচুবনের ভেতর লক্ষ্য করে দেখলেন একটি ছোট্ট ছেলে উদাম গায়ে সেখানে লুকিয়ে আছে। আব্বা তাকে সেখান থেকে বের করে আনলেন।
ছেলেটা যদিও মিথ্যা করে বলছিল যে সে ভুল করে এখানে এসেছে এবং কুকুরের ভয়ে লুকিয়ে আছে! কিন্তু আব্বা আমাদেরকে যা বললেন তা হলো, গ্রামে ওই সময়ে চোর-ডাকাতদের উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। ওদের একটা পদ্ধতি ছিল এই যে তারা ছোট কোন ছেলেকে বাড়ির আশেপাশে পাঠিয়ে দিত। বাড়ির লোকেরা দরজা খোলা রেখে কিছু করছে এই ধরনের সুযোগে ছেলেটা লুকিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে যেত। পরে রাত্রিবেলা সে দরজা খুলে দিত এবং চোরেরা খুব সহজে ঘরের ভেতরে ঢুকে যেত। জ্যাকের সতর্কতার জন্য আল্লাহ্ সেবার একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন।
: #চোর ঢুকলে সব জিনিস নিয়ে যেত না?' উমাইজা যেন আশ্বস্ত হয়ে বললো। এর জবাবে উমেইর অনেকটা বড়দের মতো করে বললো,
: তাছাড়া মানুষেরও তো ক্ষতি করতে পারতো! চোর-ডাকাতরা তো মানুষের ক্ষতিই করে! জ্যাক আসলেই ভালো পাহারাদার ছিলো, নানাভাই। তোমাদের উপকার করেছে অনেক!' নানাভাই বললেন,
: ওর জীবনের অনেকগুলো ঘটনাই আছে। সব তো বলে আজ শেষ করা যাবে না! আরেকটি ঘটনা বলি।একথা শুনে তিন শ্রোতাই খুব উৎফুল্ল হয়ে বললো,
: হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো বলো!’
রাতটা ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার, আকাশে কোন চাঁদ ছিল না। পাশের লোককেও দেখা যায় না, এমন অন্ধকার! চারিদিকে সুনসান নিরবতা। আমরা রাতের খাবার শেষ করেছি মাত্র। তখন, হঠাৎ জ্যাক খুব শোরগোল শুরু করে দিলো। সে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বারবার দরজার সামনে আসে আবার ঘেউ ঘেউ করতে করতে দৌড়ে ঘরের উত্তর দিকে ছুটে যায়! এবারও আব্বা হাতে লাঠি এবং টর্চ নিয়ে বের হলেন, আর হাতে হারিকেন নিয়ে আমি আব্বার পিছু পিছু গেলাম। জ্যাক যেখানে লাফালাফি করছিল এবং ঘেউ ঘেউ করছিল সেখানে কয়েকটা কলা গাছ ছিল। একটি কলা গাছে অনেক বড় একটা কলার ছড়ি এসেছিল বলে সেই কলার ছড়ির ভারে কলা গাছটি যেন ভেঙ্গে না পড়ে তার জন্য ঠেকা দেয়া হয়েছিলো একটা বড় বাঁশ দিয়ে। চোর এসেছে কলার ছড়িটা চুরি করতে, আর কুকুরের ধাওয়া খেয়ে সে ওই বাঁশ বেয়ে উপরে উঠে আত্মরক্ষা করছে। কুকুর তো আর বোঝাতেও পারে না বা আঙ্গুল দিয়ে দেখাতেও পারে না! সে শুধু বাঁশটির কাছে লাফালাফি করছে আর অস্থির হয়ে খুব জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করছে। আমরা প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না! চারিদিকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না! ভাবছিলাম, খামোখা সে এত চিৎকার করছে কেন? হঠাৎ আব্বা উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন চোরটা কাচুমাচু হয়ে কুকুরের ভয়ে উপরে বাঁশটাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। এমন অন্ধকারেও #চোর জ্যাকের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে নি। আমরা চোরকে ধরে ফেললাম।
একথা শুনেই ভীষন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো তিনজন শ্রোতাই! তিনজনেই নানা প্রশ্ন শুরু করলোঃ চোর নিয়ে কি করা হলো? চোর দেখতে কেমন? পুলিশ ডাকা হয়েছিল কি-না? ইত্যাদি। নানাভাই তাদেরকে সমঝে দিলেন যে চোর নিয়ে পরে অন্যদিন গল্প হবে, আজকে জ্যাকের কথাই শেষ করি।
নানাভাই বলতে শুরু করলেনঃ জ্যাক আমাদের সবাইকেই খুব পছন্দ করত। প্রতিদিন সে আমার আব্বাকে স্টেশন থেকে এগিয়ে নিয়ে আসতো। কেমনে জানি সে জানতো এই ট্রেনে আব্বা আসবেন! আগে থেকেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে সে অপেক্ষা করত। আব্বাকে এগিয়ে আসতে দেখলে কিছুক্ষণ কাচুমাচু করে তারপর আব্বার সামনে সামনে থেকে সে যেন বীরদর্পে আব্বাকে #পাহারা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতো! আম্মাও কখনো বাড়ির বাইরে গেলে, যেমন নানাবাড়িতে বেড়াতে গেলে, যখন ফিরে আসতেন অনেকক্ষণ ধরে সে আম্মার সামনে এমন অঙ্গভঙ্গি এবং নাচানাচি করতো যে বুঝাই যেতো সে খুব খুশি হয়েছে। এইভাবে সে তার #ভালোবাসা প্রকাশ করতো।
আসলেই জ্যাক ছিল ভীষণ #সাহসী এবং এক বড় যোদ্ধা! আমাদের বাড়িতে রাত্রিবেলা অনেক সময় অন্য বাড়ি থেকে কুকুর আসতো। বিশেষ করে আশ্বিন-কার্তিক মাসে বাইরের কুকুরদের উপদ্রব বেড়ে যেত। জ্যাক তাদেরকে তাড়াতে গেলেই ঝগড়া শুরু হতো। মাঝে মাঝেই কুকুর গুলোর মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া হতো। জ্যাক কখনও অন্য কুকুরকে ছাড় দিত না। এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে কোন #কুকুর আসুক সেটা #জ্যাক সহ্য করতে পারত না। জ্যাকের আকৃতি ছিল সাধারণ কুকুরের মতো ছোটখাটো। একদিন রাতে একটি অনেক বড় আকারের কুকুর এসেছিল। সে জ্যাকের সাথে অনেকক্ষণ ঝগড়া করলো। কিন্তু ছোটখাট আকৃতির জ্যাক তাকে কোনমতেই ছাড় দিতে রাজি নয়! ঝগড়া যখন চরম পর্যায়ে আমরা তখন বের হলাম হাতে লাঠি এবং হারিকেন নিয়ে, ঝগড়া থামানোর জন্য। আমাদেরকে বের হতে দেখে জ্যাকের যেন সাহস অনেকগুণ বেড়ে গেলো! সে এত বড় কুকুরটার গায়ের উপর যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো তা অবিশ্বাস্য! প্রথমে সে ওই কুকুরটার পেছনের একটা পা কামড়ে ধরলো এবং সেটাকে অচল করে দিলো। এবার সে ওই কুকুরের পেছনের অপর পা'কেও প্রচন্ডভাবে কামড়ে ধরলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটাকেও অচল করে দিল। কুকুরটা এবার রণেভঙ্গ দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যেতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু জ্যাকের রাগ তখনও কমে নি। সে তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে কুকুরটার গলায় প্রচন্ডভাবে কামড়ে ধরলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই এত বড় কুকুরটা প্রথমে গোঁ গোঁ শব্দ করলো এবং একটু পরে অনেকটা নির্জীব হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। আমরা কোন মতেই জ্যাককে শান্ত করতে পারছিলাম না! আব্বা অনেক ধমক দিয়ে তাকে কাছে ডেকে আনলেন। আম্মা কাজের মেয়েটাকে দিয়ে জ্যাকের জন্য খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। তারপরও তার রাগ যায় না! সে বারবার ওই কুকুরের দিকে ছুটে যায়! আমরা শেষে তাকে গলায় চেইন দিয়ে আটকে তার সামনে খাবার রাখলাম। পরদিন সকালে আমরা দেখেছিলাম যে বাইরের কুকুরটা একটু দূরেই মরে পড়ে আছে।
এইভাবে অন্য কুকুরের সাথে ঝগড়া করতে গিয়ে #জ্যাক শরীরের নানা জায়গায় কামড় খেতো এবং আঘাত পেতো। আমরা তাকে ঔষধ পত্র দিয়ে সারিয়ে তুলতাম। একবার দেখলাম অন্য এক #কুকুরের কামড় খেয়ে তার ঘাড়ের চামড়া ছিঁড়ে রক্ত ও মাংস বেরিয়ে এসেছে। ঔষধ পত্রেও তা সেরে উঠলো না বরং ঘা হয়ে গেল এবং ঘা'টা দিন দিন বাড়তে থাকলো। জ্যাকেরও বয়স হয়েছে! ঘা'টা তাকে খুব কাবু করে ফেললো এবং সে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল! কয়দিন পর ঘা'টা অনেক বড় হয়ে গেল এবং সেখানে সারাক্ষণ মাছি ভনভন করত। মাছি তাড়ানোর জন্য মাথা ঝাঁকি দিলে চারিদিকে পুঁজ ছিটিয়ে পড়তো। এতে ঘরের দরজার সিঁড়ি নোংরা হচ্ছিল। তাই একদিন আব্বা ওকে একটু ধমক দিয়ে বলেছিলেন, দূরে কোথাও যেতে। মনিবের বিরক্তিটা সে ঠিকই বুঝেছিল! আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এরপর থেকে #জ্যাক আর কখনো আমাদের ঘরের দরজায় আসেনি এবং জায়গাটা নোংরা করেনি!
সে গিয়ে স্থান করে নিলো চাপা-কলের পাশে বকুল গাছের তলায় শুকনো জায়গাটাতে। প্রতিদিন তাকে খাবার দেয়া হয়। খাবার খেয়ে জ্যাক ওখানেই শুয়ে থাকে। ওর ঘাড়ের ঘা'টাও কমেনি বরং বেড়েছে। কয়েকদিন পর দেখলাম তার প্রাণহীন দেহটা পড়ে আছে! আমাদের ঘরের সকলের জন্য এটা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। আমাদের কেউ যেন কান্না চেপে রাখতে পারি নি। মৃত্যুর পর ওর মৃতদেহটাকে চাপা-কলের পাশেই একটি গর্ত করে পুঁতে কবর দিয়েছিলাম আমি। আমি তখন একটা কাজ করেছিলাম। একটি কাঁচের বোতলের ভেতর এক টুকরো কাগজে জ্যাক সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে তার মৃতদেহের সাথে রেখে দিয়েছিলাম, এই ভেবে যে কোনদিন কেউ যদি এই পত্রখানা পায় তাহলে তারা জানতে পারবে যে, এখানেই একটি #প্রভুভক্ত ও নিবেদিতপ্রাণ কুকুরের দেহাবশেষ সমাহিত ছিল!
গল্প শেষ করতে গিয়ে নানা ভাইয়ের গলার স্বর যেভাবে নরম হয়ে এসেছিল, তাতে উমেইররা কেউ কোনো প্রশ্ন করল না। গল্প শুনে সবার যেন মন খারাপ হয়ে গেছে! এটাই জ্যাকের জন্য সবার #ভালোবাসা।
আশরাফ আল দীন।। শিক্ষাবিদ, কবি, গবেষক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।
মিরপুর, ১৭/০৪/২০২০
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১১:৫৩