তৃতীয় পর্বের পর
আস সাফা পাহাড়ের পাদদেশে এক ঘরের ভেতরে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ), হজরত হামজা (রঃ) সহ অন্যান্য সাহাবীদের নিয়ে তখন উমরের জারী করা মৃ্ত্যু পরোয়ানা নিয়ে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শে ব্যস্ত। ঠিক তখনই দরজায় কে যেন ধাক্কা দিলো পরমূহুর্তেই উমরের গলার আওয়াজ শুনে ঘরের ভেতরে সাহাবীরা শংকিত হয়ে উঠল হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনশংকা নিয়ে । এমন সময় সাহাবীদের ভেতরে ইতিস্তত ভাব দেখে হামজা দাড়িয়ে বলে উঠলেন তোমরা কিসের জন্য এত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছো। অন্যান্য সাহাবীরা বলে উঠলেন বাইরে উমর অপেক্ষা করছে ভেতরে প্রবেশের জন্য। হামজা বলে উঠলেন উমর বিন খাত্তাব? ভয় কেন দরজা খুলে দাও তার জন্য । যদি আজ আল্লাহতায়ালা তার জন্য কিছু ভাল রেখে থাকে তাহলে সন্দেহ নেই সে আমাদের মত আজ আরেকজন মুসলমানে পরিনত হবে। আর উমরের মনে যদি অন্য কোন খারাপ উদ্দেশ্য থাকে তাহলে আমরা সকলে মিলে তাকে হত্যা করব।এই কথা বলে হজরত হামজা (রঃ) দরজা খুলে উমরের একপাশে তিনি নিজে আর অন্যপাশে আরেকজন সাহাবী উমরের হাত চেপে ধরলেন । ঘরের ভেতরে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলে উঠলেন তাকে আসতে দাও । হামজা ও আরেকজন সাহাবী উমরকে ধরে আল্লাহর নবীর সামনে নিয়ে গেল। উমর কোন ওজর আপত্তি করলেননা ভাবলেশহীন চোখে চেয়ে রইলেন হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দিকে। তাকে দেখে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) উঠে দাড়ালেন নিচু হয়ে উমরের জামার অস্তিন ধরে তাকে দাড় করিয়ে কিছুটা রাগতস্বরে বলে উঠলেন " তোমাকে কে বললো এখানে আসতে হে খাত্তাব পুত্র? আমার মনে হয় আল্লাহ তোমার উপর গজব না দেয়া পর্যন্ত তুমি মনে হয় থামবেনা।" উমর আল্লাহর নবীর চোখে চোখ রেখে বললেন " হে আল্লাহর প্রেরিত দূত আমি এক আল্লাহর এবং তার প্রেরিত দূতের উপর এবং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করছি।" উমরের কথা শোনা মাত্র আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন " আল্লাহু আকবার"।
হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর আল্লাহু আকবার ধ্বনি যেন ঘরের ভেতরের আনন্দের হিল্লোল বয়ে আনলো । সাহাবীরা বুঝতে পারলো আরবের সিংহ উমর ইবনে আল খাত্তাব আজ থেকে বিশ্বাসীদের দলে যোগ দিয়েছে। অবশেষে নবীর দোয়া আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন। মুসলমানদের দলে আজ থেকে উমর ইবনে আল খাত্তাব নাম লিখিয়েছেন।একদিকে হামজা বিন আব্দুল মোত্তালিব অন্যদিকে উমর ইবনে আল খাত্তাব, আরবের এই দুই বীরকে নিজেদের দলে পেয়ে মুসলিমরা নতুন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠল।
উমরের ইসলাম ধর্ম গ্রহনের পর থেকে এক নতুন শক্তি বলীয়ান হয়ে উঠল মক্কার মুসলমানরা। শুরু থেকে হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কুরায়শদের পেশীশক্তি আর মুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়ার কারনে গোপনে ইসলাম প্রচার করছিলেন। কিন্ত আজ যখন হামজা আর উমর মুসলিমদের পাশে এসে দাড়িয়েছেন তখন আল্লাহর নবীর কাছে মনে হল মুসলমানদের আজ ঘুরে দাড়াবার সেই মহেন্দ্রক্ষন উপস্থিত। একদিন উমর জিজ্ঞাসা করলেন নবীর কাছে" হে আল্লাহর নবী আপনিই বলুন যে সত্য আমাদের কে প্রেরন করা হয়েছে তাকি আমরা আমাদের জীবন অথবা মৃত্যুর ভয়ে ভীত না হয়ে অনুসরন করবনা?" নবী বললেন অবশ্যই। সাথে সাথে খাত্তাব পুত্র উমর দাড়িয়ে বলে উঠলেন তাহলে কেন আমরা লুকিয়ে থাকবো? কিসের ভয় আমাদের? আপনাকে যে প্রেরন করেছেন সত্যর বাণী দিয়ে সময় এসেছে আজ আপনার সেই সত্যকে জনসম্মুখে প্রকাশ্যে প্রচার করার।" নবী বুঝলেন এখনই সে সময় আসন্ন আজ তাই আল্লাহ যেন স্বয়ং উমরের কথায় সেটা বুঝিয়ে দিলেন তাকে।
দেরী না করে নবী ডাক দিলেন মক্কার সকল মুসলমানদের। ঘরের কাজ ফেলে বাবাকে অবাক করে দিয়ে পুত্র হাঁটা দিলো সে ডাকে, বাজারের কেনাবেঁচা বাকী রেখে ক্রেতাকে অপেক্ষায় রেখে হাটা দিলো দোকানী অথবা কোন এক ক্রেতা । মক্কার জনসমুদ্র থেকে আজ এতদিনের লুকিয়ে থাকা মুসলিমদের দল সাহস আর প্রত্যেয়ে ভর করে এগিয়ে চললো বীরদর্পে সেই ডাকে সাড়া দিতে। আজ কোন বাধা, কোন রক্তচক্ষুই যেন তাদের থামিয়ে রাখতে পারলোনা। কুরায়শরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো সেই গোপন অনুসারীর দলকে নিয়ে ধূলা উড়িয়ে বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার পেছনে মুসলমানরা দুই কলামে ভাগ হয়ে এক কলামের আগে হজরত হামজা (রঃ) অন্য কলামের অগ্রভাগে নব্য মুসলিম হজরত উমর (রঃ) এগিয়ে চলছেন। এই দৃশ্য দেখে কুরায়শরা একদিকে যেমন অবাক হল অন্যদিকে তারা নিজেরা এই প্রথমবারের মত হতাশায় নিমজ্জিত হল।
হজরত উমর (রঃ) এই অগ্রনী ভূমিকার জন্য তাকে আল্লাহর নবী আল-ফারুক নামে ভূষিত করলেন। এভাবেই সেই একক মহান স্বত্তা হজরত উমর (রঃ) কে দিয়ে নবীজির সাথে ইসলামের দাওয়াতের প্রথা নিয়ে বাক্যলাপের মাধ্যমে মুসলিমদের জন্য উন্মোচিত করলেন এক নতুন অধ্যায়ের। ইসলামের শুরুতে নবীজি ছিলেন একা কিন্ত ধীরে ধীরে আল্লাহ স্বয়ং তার হাবীবকে সত্যর অনুসারীদের কে দিয়ে তাকে উৎসাহিত করলেন এবং সবশেষে তার এই ইসলামের দাওয়াতের কাজ দৃড় করার জন্য তাকে হজরত হামজা (রঃ) এবং হজরত উমর (রঃ) এর সাহচার্য দান করলেন। এভাবে ধীরে ধীরে মুসলিমরা তাদের গোপন বলয় থেকে বেরিয়ে নতুন এক শক্তির বাহক হিসেবে স্বরুপে উন্মোচিত হল এবং সেই শক্তি ছিল তাওহীদের শক্তি , এক আল্লাহকে বিশ্বাস করার শক্তি।
(চলবে)