প্রথমে বামে, তারপর ডানে। সামনে দিকটায় উপর-নিচ করে করতে হবে। ম্যাটাডোর থ্রি এঙ্গেল টুথব্রাশ দিয়ে উপরের পাটির হার্ড-টু-রিচ এরিয়ায় যখন ঘষাঘষি করছি তখন সাত্তার মামা খবরটি দিলো। মুখে টুথপেস্টের ফেনা জমে উঠলে আমি কিছুক্ষণ মুখ বন্ধ করে চুপচাপ থাকি, বড় বড় করে নি:শ্বাস নিই। কিন্তু সাত্তার মামার কথা শুনে চুপ থাকতে পারলাম না। ফুচ্চক করে কলগেটের ফেনা বেসিনে ফেলে চমকে গিয়ে বলি - 'কী বলো মামা? আসলেই?'
সাত্তার মামা তখন গরম গরম পরোটা ছিড়ে মুরগীর গিলা-কলিজার ঝোলে চুবিয়ে ডান হাতে মুখে তুলে দিচ্ছে, চোখ তীক্ষ্মভাবে বাম হাতে ধরে রাখা কাগজের উপর। বেসিনের পাশে ঝুলানো তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আমি আবছা দেখতে পাই - মামার হাতের কাগজে ছক করা ঘর। পাশে গিয়ে বসলে মামা আমার হাতে কাগজটি তুলে দেয়; বিভিন্ন এপার্টমেন্টের লোকেশন, আয়তন আর দাম।
এক নজর চোখ বুলিয়ে আমি অবাক হয়ে যাই - 'দাম এত্তো কম?'
সাত্তার মামা কাঁচা মরিচে কামড় দিয়ে বলেন - 'সে জন্যই বলি ভাগ্নে, সময় থাকতে কিনে ফেলো।'
আম্মা তখন রান্নাঘর থেকে আওয়াজ দেন - 'এইসব মামদো ভূত মাথায় নিবা না। পরে আবার কোনদিন কী হয়ে যায় - - -'।
মামা মাথা নাড়ে - 'বুঝলি, তোর মা ছোটবেলা থেকে এরকম। দুলাভাই কই?'
আব্বা ভোর বেলা বাজারে গেছে। আব্বার ধারণা - বাজার থেকে জিনিস কিনতে হয় ফ্রেশ, নয়টা দশটা করে বাজারে গেলে ভালো জিনিস আর পাওয়া যায় না। তাই শুক্রবার সকালে মিরপুর ছয় নম্বর বাজারে গিয়ে ফ্রেশ গরুর গোশত, নখ না খুঁটানো লাউ, শাক-সবজি, শিশির পড়া ধনে পাতা কিনে নিয়ে আসবেন। সাত সকালে বাজার করার অসুবিধাও আছে। একবার আব্বা সকালে বাজারে গেলেন, তখন বৃষ্টি বাদলার দিন। ট্রাক থেকে খাঁচা ভর্তি মাল ফেলছে ঝপাত ঝপাত করে। হঠাৎ দেখা গেলো লাল শাকের খাঁচা ছিড়ে কাদার মধ্যে একাকার। বৃষ্টি ভেজা কাদা, পানিতে জবজব। পাশে জবাই করা গরুর গোবর-রক্ত ভাসছে এখানে ওখানে। এর মাঝে পড়ে থাকা লাল শাক তুলে নিচ্ছে একজন। পাশ থেকে টোকাইদের পাহারা দেয়া হচ্ছে, কেউ যেন শাক নিয়ে দৌড় না দেয়। আব্বা তখন গাঁওপাড়া জেনারেল স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে। দেখা গেলো বড় ড্রামে শাকের মুঠাগুলো একবার চুবিয়ে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে কাঠের পাটাতনে।
আব্বার মুখে শাকের বিবরণ শুনে আম্মা ওয়াক-ওয়াক করে বেসিনে ছুটে গেলো, আমার ছোট ভাই মুকুল থু-থু করে থুতু ফেললো মেঝে। আমার কিছু মনে হলো না। কারণ, চোখে না দেখা অনেক জঘণ্য নোংরা জিনিস আমরা হজম করে ফেলছি অনায়াসে। আমার কথায় কোন কাজ হলো না। ওটাই শেষ, এরপর আব্বা আর কখনো লাল শাক কিনেননি। আমার খুব প্রিয় একটি খাবার নিষিদ্ধ হলো আমাদের কিচেনে।
সাত্তার মামা তখন কাপ থেকে চা ঢালছেন পিরিচে। উনি কাপে সরাসরি মুখে দিয়ে চা খেতে পারেন না, ঠোঁট পুড়ে যায়, জিহ্বা পুড়ে যায়। আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম - 'মামা, তুমি তো জানো - আব্বা লাল শাক কিনে না'।
- আরে গাধা, লাল শাক আর ফ্ল্যাট কি এক জিনিস হলো?
- এক না, কিন্তু চিপায় পড়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করছে কম দামে, এখন ঐ ফ্ল্যাট কেনা ঠিক হবে? পরে সমস্যা হবে না?
- ফ্ল্যাট কিনবি নগদে, দলিল পত্র সব ঠিক থাকবে। সমস্যার কী আছে এখানে?
চায়ে চিনি দিয়ে শব্দ করে চামচ নাড়তে নাড়তে আম্মা তখন ডায়নিং টেবিলে এসে বসে। মামার দিকে তাকিয়ে বলে - 'শোন, তোর দুলাভাইয়ের এতো টাকা নাই। আর কোথাকার কোন এমপি লুটের টাকায় বাড়ী করছে, ঐটা কেন কিনতে যাবো?'
মামা তার পুরনো লজিকে ফিরে যায় - 'আপা তুমি দামের কথা ভাববে না? এতো সস্তায় পাবে কখনো?'
আম্মা আর মামার কথা চালাচালির এক পর্যায়ে আব্বা বাজার থেকে ফিরে এলেন ঘামে ভেজা দরদরে শরীর নিয়ে। ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে লেবুর শরবতে চুমুক দিয়ে সাত্তার মামার সাথে আলাপ জমে উঠে তার। বাজার - দেশ - রাজনীতি। সাত্তার মামার প্ল্যান ছিল এটা-ওটা কথার ছলে ফ্ল্যাটের ব্যাপারে টোপ ফেলবেন। অথচ আব্বা তখন কেয়ারটেকার সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ - 'কেউ ভাবতে পারছিলো - এইসব পালের গোদা জেলের ভাত খাবে?'
মামা সামনে বসে হাত কচলায় - 'ভেবে দেখেন দুলাভাই, চার মাস হরতাল নাই। এমন সময় বাংলাদেশে গেছে কখনো? হাসিনা খালেদা শেষ করলো দেশটারে----'।
এসব কথায় কথায় সময় কেটে যায়। আমি তখন আমার রূমে ডেইলী স্টার ম্যাগাজিনের 'রাইট টু মিতা' পড়ছি।
দুপুরে আলাপ জমলো না।
জুম্মার আজান দিলে আব্বা গোসলে গেলেন। মামাও আব্বার সাথে চোখে সুরমা মেখে মসজিদে গেলো।
মসজিদে আসা-যাওয়ার পথে আব্বার সাথে মামার কী কথা হলো জানি না। দুপুরে খাবার টেবিলে মামা দেখলাম খুব গম্ভীর। শেষে আচারের বয়াম থেকে দু'চামচ জলপাই টুকরা মুখে দিয়ে খানিকটা অস্পষ্ট উচ্চারণে বললেন - 'দুলাভাই, ভেবে দেখেন। আমিও ওদিকটায় খোঁজ খবর রাখি।'
আব্বা হ্যাঁ - না কিছু বললেন না। আম্মা প্রসংগ ঘুরিয়ে আমার প্লেটে আরেক টুকরা মাছ তুলে দিয়ে বললেন - 'তোর খাওয়া দিন দিন কমে যাচ্ছে'।
জিটিভি-তে পুরা মাস জুড়ে রাজকাপুর স্পেশাল দেখাচ্ছে। আজ দেখাবে 'আওয়ারা'। আব্বা-আম্মা পুরোনো দিনের সিনেমার ভক্ত। দুজনে বেশ আয়েশ করে 'আওয়ারা' দেখতে বসেছে। মামা দুয়েকবার ওদিকে চক্কর মেরেও পাত্তা পেলো না। শুক্রবার বিকেলে আমি বাংলাদেশ বেতার ঢাকা'র গ চ্যানেলে ওয়ার্ল্ড মিউজিক শুনি। শান্তা এ প্রোগ্রামের ফ্যান। প্রায়ই আমাকে ডেডিকেট করে সং রিকোয়েস্ট করে। এলটন জন আর জর্জ মাইকেলের গান তার বেশী পছন্দ। ওয়ার্ল্ড মিউজিকে মোহম্মদপুরের তন্ময় রেগুলার লিসেনার। তন্ময়ের চয়েসগুলো আমার সাথে মিলে। ভালো ভালো গান। আমি গান শুনছি - এমন সময় সাত্তার মামা এলেন আমার রূমে - 'কী করো ভাগ্নে?'
- এইতো মামা, গান শুনি। এসো।
- ভালোই। বাবা-মা হিন্দি সিনেমা দেখে, ছেলে ইংরেজী গান শুনে। বাংলার দাম নাই।
আমার হাসি পায় - 'মামা, আমার টেবিলে 'মেড ইন বাংলাদেশ' সিনেমার সিডি আছে, তুমি দেখতে পারো।'
- নাহ! সিনেমা দেখার টাইম নাই। বিকেলে তোর জরুরী কাজ আছে?
- তেমন কোন কাজ নেই, কেন?
- তাহলে চল, অ্যাপার্টমেন্টটা দেখে আসি।
- আব্বা রাজী আছে?
- পুরা রাজী না, তবে প্রসেসে আছে। একটু টাইম লাগবে।
বিকেল বেলা আমি আর মামা অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে বের হয়ে গেলাম। ট্যাক্সি নিয়ে মহাখালী পার হয়ে কাকলী মোড় দিয়ে ঢুকে বনানী কবরস্থানের পাশ দিয়ে চললাম। ঝকমকে গ্রে কালারের একটি বাড়ীর সামনে এসে ট্যাক্সি থামলো। বাড়ীর সামনে ছায়া শীতল পরিবেশ। বড় বড় কাঁঠাল গাছ আছে কয়েকটা। আমি যখন মাথা উঁচু করে ক'তলা বিল্ডিং দেখার চেষ্টা করছি মামা তখন গেটে দারোয়ানের সাথে কী কী কথা সেরে নিলো। খানিক পরে আমরা দো'তলার একটি ঘরে গিয়ে বসলাম। মধ্য তিরিশের এক যুবক এগিয়ে এলো। মামা তার সাথে হাসিমুখে হাত মেলালো। জানা গেলো - যুবকটি এমপি সাহেবের শালা। এমপি সাহেবের এরকম তিরিশ-চল্লিশটির মতো ফ্ল্যাট আছে। জরুরী অবস্থায় জরুরীভাবে বিক্রি করা হচ্ছে। আমার পড়ালেখা, আব্বার ব্যবসা নানা বিষয়ে আলাপে আলাপে চা-চানাচুর দেয়া হলো। পরে লিফটে করে আমরা গেলাম সাত তলার একটি অ্যাপার্টমেন্টে। দুই হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। বিশাল ড্রয়িং-ডায়নিং, মাস্টারবেড, চাইল্ড বেড, সার্ভেন্ট কোয়ার্টার, গেস্টরূম, তিন দিকে লাগোয়া ব্যালকনি। একদিক থেকে লেকের মতো কিছু একটা দেখা যায়। দখিন বারান্দা দিয়ে শিরশির বাতাস আসছে। মামা আমাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে - 'বুঝলে, মীরপুর ভুলে যাও। অনেক তো হলো, আর কতো ঐ চিপাগল্লির জীবনে!'
আমি মাথা নাড়ি।
মামা বলে যায় - 'আপা দেখলে অবশ্যই রাজী হবে, দুলাভাইকে নিয়ে একটু সমস্যা।'
আমি তখন এদিক ওদিক দেখি।
মামা থেমে নেই - 'ভাড়া বাসায় আর ক'দিন থাকবি? ক'দিন পর তুই বিয়ে করলে বাড়তি রূমের দরকার হবে না?'
এবার আমি কিছুটা লজ্জা পাই।
মামা টের পেয়ে বলেন - ' কী বলিস, ভুল বললাম নাকি? মেয়েটার নাম যেন কি? শান্তা নাকি কান্তা!'
আমি মুখ লাল করে বলি - 'এসব তো অনেক দূরের কথা মামা।'
- 'দূরের হবে কেন? বিয়ে তো একদিন করবিই। পারলে একদিন শান্তাকেও ফ্ল্যাটটা দেখিয়ে নিয়ে যাস। তারও তো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে!'
রাতে বাসায় ফিরলে আব্বার সাথে এ ব্যাপারে কথা হয় না। ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বো এমন সময় আম্মা এসে চুপিসারে জিজ্ঞেস করে - 'বাসা কেমন দেখলি? আশেপাশের পরিবেশ কেমন? দাম কমানো যায় না?'
আম্মার কথার জবাব দিতে দিতে আমার চোখ দুটো বুঁজে আসে।
ক'বছর পার হলো জানি না। আমি শান্তাকে বিয়ে করেছি। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট টুকটাক শো-পিসে ভর্তি। ঠান্ডা বাতাস আসছে জানালা দিয়ে, সময়টা হয়তো বিকেল হবে। আমি শুয়ে আছি। শান্তার মনে ছেলে মানুষী জেগেছে। সে আজ হলিক্রস কলেজের ইউনিফর্ম পরবে, তারপর আমরা অনেক আগের দিনে ফিরে যাবো, ব্যালকনিতে বসে টুকটাক খুনসুটি করবো দুজনে। এমন সময় কলিংবেল বাজে। আমি আড়মোড়া ভেঙে গিয়ে দরজা খুলি। আমাকে ধাক্কা দিয়ে তিনজন যুবক আমাদের রূমে ঢুকে যায়। অস্ত্র হাতে একজন গিয়ে শান্তাকে ধরে নিয়ে আসে, যুবকটিকে আমি চিনি। এমপি সাহেবের শালা, যার বাসায় চা-চানাচুর খেয়ে ফ্ল্যাট কেনার আলাপ হয়েছিল। আরেকজন আমার মাথায় ছুরি ঠেকিয়ে বলে - 'আপনার বৌরে আমরা নিয়ে গেলাম'। আমি প্রতিবাদ করি - 'কেন? কেন ওকে নিয়ে যাবেন? টাকা পয়সা যা পারেন নিয়ে যান, ওকে না, প্লিজ!' আমার কথা শুনে এমপি সাহেবের শালা হো:হো: করে হাসে - 'শাকের দামে চামেচামে ফ্ল্যাট কিনবা, আমাগো দূর্দিনে কাঁচকলা দেখাইবা, আর আমরা চুপ থাকুম? দিন কী আর সমান যায়?'
আমি এবার আব্বা-আম্মাকে ডাকি - 'আব্বা-আম্মা, আপনারা আসেন। শান্তাকে ওরা নিয়ে গেলো'। আমার গলার শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছে। কেউ শুনছে কী-না জানি না। আব্বা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে পত্রিকা পড়ছে। আম্মাকে দেখছি ডায়নিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। আম্মা আমার দিকে মুচকি হেসে বলে - 'বাবা আয় খেতে আয়, তোর আব্বা আজ অনেকদিন পর বাজার থেকে লাল শাক এনেছে'। আমি শান্তার হাত ধরে রেখেছি। লোকগুলো আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে ক্রমাগত।
মুকুলের ধাক্কায় আমার ঘুম ভাঙে - 'ভাইয়া, আব্বা তোমাকে ডাকছে। কালকে কোথায় ফ্ল্যাট দেখে এলে, ঐ ব্যাপারে কথা বলবে'।
___________
(
ছাপা হয়েছিল - 'হাজারদুয়ারী' মে সংখ্যায়।
এইসব ছাইপাশ আসলেই গল্প হয় কিনা তা নিয়ে আমি জানি না। এ লেখাটি উৎসর্গ করলাম সুহৃদ হাসান মোরশেদকে, খুব ইচ্ছে রাখি তাঁর লেখা গল্পের মতো অন্তত: একটি গল্প লিখবো আমার পরজন্মে। এ জনমে যেটা সম্ভব হবে না, আমি নিশ্চিত।
)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০০৭ সকাল ৭:৪৮