রনির বাম চোখটি একটি দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে গেছে। একমাত্র ডান চোখটিই তাঁর এখন সকল কাজের ভরসা। একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার বলে দিয়েছেন, রনির বাম চোখটি আর ঠিক হবে না। সংসারে একমাত্র বিধবা মা। দেনার বোঝা নিয়েই তাঁর পিতা মোজাফ্ফর হোসেন দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা যান।
রনির মা যতোবার তাঁকে একটি চাকরি বা কাজের কথা বলেছে, ঠিক প্রায় ততোবারই সে আত্মহত্যার বিভিন্ন রকম চেষ্টা চালিয়েছে। এভাবে সে লেখাপড়াও ছেড়ে দেয়। কিছু একটা জোর করলেই ফাঁস দিয়ে মৃত্যু অথবা বিষ পানে আত্মহত্যার ভয় দেখায়। কী এর কারণ: খুঁজে পান না রনির মা। রনির পিতার তো এমন প্রবণতা ছিলো না কোনোদিনও!
রঞ্জনা নামের একটি মেয়েকে পছন্দ করতো রনি। এতে রঞ্জনারও আপত্তি ছিল না। কিন্তু রনির বাম চোখটি দুর্ঘটনায় নষ্ট হলে অন্য কোথাও বিয়ে হওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো আপত্তি করেনি মেয়েটি। সেই থেকেই বাড়ির কাছের মরা গোমতি নদীর মৃত্যুকূপসম এক ঝোপের কাছেই দিনের অনেকটা সময় কাটায় রনি।
কয়েকদিন পর ঈদ-উল-ফিতর। বাজারে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। প্রচন্ড গরমে অস্থির মানুষ। এরই মধ্যে জীবন থেকে রঞ্জনাকে হারানোর বিষয়টি রনিকে রীতিমতো পাগল বানিয়েই ছেড়েছে।
রনির এক সময়ের বন্ধু মাহমুদ প্রায়ই আখাউড়ায় যায়। কুলাউড়ার গল্প বলে। বর্ণনা দেয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার মোহনপুর বাজারের। কিন্তু রনিকে কিছুই যেন আকর্ষণ করে না। সারাদিন সে মরা গোমতির উত্তর এলাকায় ঘুরে। এমনকি যেদিন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ছিলো, সেদিনও রনির মা তাকে ওখান থেকেই বাড়িতে ডেকে আনে।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, আত্রাই কিংবা ব্রহ্মপুত্র... কতো নদীর নাম শুনেছে রনি। অথচ সে সারাদিন কাটায় মরা গোমতির আশপাশের জলা এলাকায়। বিল-জলাশয় বা কোনো হাওড় এলাকা না হয়েও মরা গোমতির বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি জুড়ে এক ধরনের মায়াবী পরিবেশ বিরাজ করে।
রনিদের গ্রামের নাম মোহনপুর। বন্ধু মাহমুদের মুখে পশ্চিম ত্রিপুরার মোহনপুর বাজারের গল্প শুনেও এই মোহনপুরের সঙ্গে ওই মোহনপুরের কোনো তুলনা করতে পারে না।
এবারের শীতের শুরুতে মোহনপুরের মরা গোমতির জলা এলাকায় হঠাৎই নামতে থাকে পরীযায়ী পাখির দল। জলাবদ্ধ এ এলাকায় এতো পাখি এর আগে কেউ কখনো দেখেনি। মানুষের ব্যস্ততার কোলাহলকে ছাপিয়ে অতিথি পাখির কিচিরমিচিরই বাতাসে আর আকাশে উড়ে বেড়ায়। মরা গোমতিই মানুষের মাঝে এতোটা মুগ্ধতা ছড়ায়, পাশেই বহমান স্রোতবাহী গোমতিও সেখানে যেন ম্লান। বিকেলে আশ্বিনের কুয়াশায় উড়ে স্বর্গীয় সব পাখি।
এইসব পাখিদের সংস্পর্শে যখনই রনির দিনগুলো সুখেই কাটছিলো, তখনই তার চাচাতো বোন রুশনারা তাকে একটি দুঃসংবাদ দিলো। ২০ বছরের যুবতী রঞ্জনা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়ার জের ধরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তারপর হাসপাতালে নেয়া হলেও ৭ দিন পর মারা যায় রঞ্জনা খাতুন।
রুশনারা যেদিন রনিকে এই দুঃসংবাদটি দেয়, সেদিন রাতেই রনি দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে যাবে ভেবেছিলো। আর যাওয়া হয়নি। চোখের জলে বিজয়া দশমীতে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে মরা গোমতির জলেই বিদায় জানিয়েছেন ভক্তরা। রনির এবার পূজা দেখা আর হলো না। তাঁর দেবী রঞ্জনা খাতুন জলে নয়, অগ্নি আরোহণে বিদায় নিয়ে গেছে। তাই রনির সারাটা বুক তপ্ত হয়ে রয়েছে। তপ্ত বুক শীতল করতে জলই অতি জরুরী। তাই যেন তাঁর মরা গোমতির জলদেবীর কাছাকাছি এমন সময় যাপন।
প্রতিমা বিসর্জন হলো। থেমে গেলো ঢাক-ঢোল আর কাঁসর-ঘন্টা বাজানো। মন খুবই খারাপ হলো রনির। তার বন্ধু মাহমুদও আখাউড়া হয়ে ইন্ডিয়ায় গেছে কয়েকদিন হলো। পূজার রেশ সম্পূর্ণ শেষ হলেই মোহনপুরে ফিরবে আবার।
রনির মা সারাটা দিন রনির জন্য কাঁদেন। বলেন, মরা গোমতির আশপাশটা ভালো জায়গা নয়। এখানে অনেক ভূত-প্রেতের ছায়া। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদররা স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম যতো লোককে মেরেছে, তাদের অধিকাংশকেই মেরে এখানে ফেলেছে।
এক রাতে তখন পূর্ণিমা ছিলো, তোর বাপ মোজাফ্ফর হোসেন বাজার থেকে ফেরার সময় ওখানে এক লাশখেকো জন্তুর গোঙানি শুনে দৌড়ে প্রাণে বেঁচেছে। আমি বিশ্বাস করি ওইসব ভূতেরা মরা গোমতির আশপাশটায় এখনও বিচরণ করে।
মায়ের কাছে এসব গল্প শুনেও ভয় আসে না রনির মনে। বরং এ মরা গোমতিকে জানবার কৌতূহল আরও তীব্রতর হয়। ঠিক এই সময়ে মরা গোমতির আশপাশটায় শত শত পাখি নামে। পাখির হাজারো কিচিরমিচিরে আকাশে বাতাসে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি বাজতে থাকে অথবা চৌরাসিয়ার বাঁশি এখান থেকেই সুর আহরণ করে। পুরো আকাশ, আকাশের সাদা মেঘ স্থির হয়ে মোহনপুরের মরা গোমতির জলাশয় এলাকায় স্বর্গীয় নানা বর্ণিল পাখির গান শুনতে থাকে। পরীযায়ী পাখির ডানায় ডানায় বাজতে থাকে তবলার তিনতালের বোল অথবা পাখিরা তাদের পাখা দিয়ে পাখোয়াজ বাজাতে থাকে। এসব দেখে রনি এতোদিনে সম্পূর্ণরূপেই পাগল হয়ে যায়। পাখির পাগল।
তারপর তাঁর সেই পাগলামী পাখি শিকারে রূপান্তরিত হয়। মোজাফ্ফর হোসেনের একমাত্র ছেলে রবিউল হোসেন রনি ভাবে বক বা অন্যান্য অনেক পাখি ধরতে পারলেই তো খাওয়া অথবা পাশের ফুলতলা বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করা যায়। কিছুদিন আগেও ফুলতলা বাজারে এক মধ্যবয়সী লোককে কয়েক জোড়া বক পাখি বিক্রি করতে দেখেছে সে। কিন্তু তখনও মাথায় আসেনি তাঁর যে লোকটাকে জিজ্ঞাসা করে সে এই পাখিগুলোকে কোথা থেকে কোন পন্থায় ধরেছে। মোহাম্মদ ফয়াজ আলীর মুদি দোকানের সামনেই বসেছিলো লোকটি। এই লোক কি এখনও পাখি বিক্রি করতে ফুলতলা বাজারে আসে? খোঁজ নিতে হবে।
এদিকে ফুলতলা বাজারের ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে যাওয়ায় বাজারের সকল গ্রাহক বা দোকানদার বিদ্যুৎহীন অবস্থায় পড়েছে নানা বিপাকে। গত দেড় সপ্তাহ ধরে ট্রান্সফরমারটি বিকল। গত বছরও বজ্রপাতে এই বাজারের ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছিলো। এরই মধ্যে একদিন রনি ফুলতলা বাজারের মোহাম্মদ ফয়াজ আলীর মুদি দোকানের সামনে বসে পাখি বিক্রি করা সেই লোকের খোঁজ করলো। সবাই তাকে যা তা উত্তর দিলো। অবশেষে রনি গোমতি নদীর খেয়াঘাটে গিয়ে বসলো। তার মনে হলো পাখি বিক্রেতা সেই লোকটি যেন রজনীগঞ্জ এলাকা থেকে খেয়া পার হয়ে এসেছে। ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করেও কোনো নৌকাতেই সেই লোকের খোঁজ পেলো না রনি। তবে এই অপেক্ষা একেবারে বৃথাও যায়নি তাঁর। হঠাৎ দেখলো খেয়ানৌকা থেকে স্বামীর হাত ধরে উঠে আসছে সুষমা। তার স্কুল জীবনের সেরা বান্ধবী। ক্লাসের সেরা সুন্দরীও বটে। কিন্তু নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই সুষমার বিয়ে হয়ে যায়। তারপর কতো বছর আর সুষমার সঙ্গে রনির দেখা নেই। সুষমা চিৎকার করে রনির বাম চোখটি কিভাবে নষ্ট হলো, তা জানতে চায়। রনি সেই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে বললো, এক চোখ গেছে, তো কী হয়েছে! আরেক চোখ তো আছে। একেবারে অন্ধ তো আর হয়ে যাইনি। দুই চোখও তো নষ্ট হতে পারতো। রঞ্জনা যে আগুনে আত্মহুতি দিলো। এই খবরেও আকাশ থেকে পড়লো যেন সুষমা। রঞ্জনার বিয়ের খবর জেনেছিলাম। মরে গেছে?
সুষমার চোখে জল এলো। সুষমার প্রিয় বান্ধবী ছিলো রঞ্জনা। এদিকে খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে এতো ইতিবৃত্ত নিয়ে আলাপে বড়ই বিরক্ত হলো সুষমার স্বামী জয়দেব চক্রবর্তী। অবশেষে সুষমাকে যেতেই হয়। জয়দেব শহরে যাচ্ছে কিছু কেনাকাটা করতে ও একটি মোটর সাইকেল দেখতে। কিছুদিনের মধ্যেই একটি মোটর সাইকেল কেনার পরিকল্পনা আছে জয়দেবের। কেনাকাটা শেষে জয়দেব আজ আর নিজের বাড়ি ফিরবে না। সুষমাদের বাড়িতে ফিরে আসবে।
একদা সবুজ কাঁচা ধানের আঘাত লেগে রনির বাম চোখটি ক্ষতবিক্ষত হলে ফুলতলা বাজারের হারুন ডাক্তারকে দেখানো হয়। আসলে হারুন ডাক্তার ডাক্তার নন। বাজারে তার এলোপ্যাথিক ওষুধের দোকান রয়েছে। তবু এলাকার লোক তাকে ডাক্তারই সম্বোধন করে।
রনির চোখ মারাত্মক ফুলে গেলে হারুন ডাক্তার যেসব ওষুধ দেয়, তা সেবন করেও চোখের যন্ত্রণা থামানো যায় না। অনেকে বললো বাজারের কদমতলায় মনমোহনের হোমিও চিকিৎসা নিতে। হারুন ডাক্তার বললেন, একই সমস্যা নিয়ে দুই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ ঝুঁকির্পূণ। এরই মধ্যে রনির চোখে রক্ত ও পুঁজ জমতে থাকে। ছেলের চোখের এমন দুর্দশা দেখে রনির মা কার পরামর্শে যেন ওই চোখে এক হারবাল তেল প্রয়োগ করে। এতে জীবাণু আক্রান্ত চোখটি তো ভালো হলোই না, বরং চিরতরেই এই চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। সবশেষে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার বাবুও বলে দিয়েছেন, রনির বাম চোখটি আর কোনোদিনও ঠিক হবে না। তারপর থেকে রনির মায়ের আর দুঃখের শেষ থাকে না।
এরই মধ্যে মরা গোমতির জলাশয় এলাকায় অসংখ্য কানিবকও নামে। ওরা সারাদিন ঠোঁট চালিয়ে ছোট মাছ ধরে। কোনো পাখি গোসল করে স্বচ্ছ নীল জলে। কিছু পাখি সাঁতরায় মরা গোমতির শান্ত প্রশান্ত জলে। ঝোপঝাড়ের মাথায় বসা সাদা বকের সারি। কাঁকড়াও খায় কিছু পাখি।
মরা গোমতির উত্তর দিকটায় উঁচু কোনো গাছ নেই। শুধুই ধানি জমি। বিস্তীর্ণ ধানি জমির ওপর দিয়ে সাদা বকের ওড়াওড়ি মনোমুগ্ধকর। রনিদের এই এলাকায় বিস্ময়কর কিছু পাখিও এসেছে এবার, যা সে আগে কখনোই দেখেনি। ওসবের নামও জানে না সে। তবে এক সঙ্গে এতো বকের দেখা পাওয়া যেন অসম্ভব কোনো ঘটনা। মরা গোমতির উত্তরদিকের বিস্তীর্ণ ধানি জমির দিকেই ওদের ওড়াওড়ি। কিন্তু ওখানে উঁচু কোনো গাছই নেই, যেখানে উড়ন্ত বকেরা একটু আয়েশে বসতে পারে।
এরই মধ্যে ফুলতলা বাজারে সেই মধ্য বয়সী লোককে আবারও খুঁজে পায় রনি। মোহাম্মদ ফয়াজ আলীর মুদি দোকানের সামনে আবারও বক নিয়ে আসে। তিন জোড়া সাদা বক। কিছুক্ষণের মধ্যেই বকগুলো বিক্রি হয়ে যায়। বাজারের একটি রেস্টুরেন্ট মালিক নিয়ে যায় দুই জোড়া বক এবং এক জোড়া বক নিয়ে যায় বাতের ব্যথার এক রোগী। বকের মাংস খেলে বাতের ব্যথার উপশম হয়, এমন কথা এলাকায় প্রচলিত রয়েছে।
বক বিক্রেতা লোকটির নাম মনসুর আলী। মনসুর আলীকে মরা গোমতির পাশে এসে বক ধরার আমন্ত্রণ জানায় রনি। হাতে পায়ে ধরে। কিন্তু মনসুর আলী রাজি হয় না নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় আসতে অথবা এমনও হতে পারে যে মনসুর আলীর এলাকাতেই অসংখ্য বক রয়েছে।
রনির পরিবারের খোঁজ নেয় মনসুর আলী। তারপর বলে, আমাকে তোমার মরা গোমতি এলাকায় নিয়ে গিয়ে বক ধরার কৌশল শেখার দরকার নেই। তুমিই বরং একদিন আমার সঙ্গে গিয়ে সব শিখে এসো। তবে কখনো পুলিশের হাতে ধরা খেলেও আমার নামটি বলো না। পুলিশ একবার শিবপুর বাজারে আমাকে পাকড়াও করেছিলো। সেই থেকেই বড় হুশিয়ার আমি।
টানা তিনদিন মনসুর আলীর সঙ্গে সময় কাটায় রনি। পাহাড়ি এলাকায় নদীপথে দীর্ঘভ্রমণ করে। নলবনে যে মনসুর আলী লুকিয়ে যেতে পারে, সেই মনসুর আলীকে ফুলতলা বাজারে অনুভব করা যায় না। মনসুর আলীর পুরো জীবনই কেটেছে বিভিন্ন গাছের ডালপালা ও লতাপাতার ছায়ায়। এমনকি অনেক সুমিষ্ট পাখির গলা বা ডাকও নকল করতে পারে। সুর শুনেই মনসুর আলী পাখির অবস্থান বলতে পারে।
মনসুর আলীর প্রশিক্ষণ লাভের পর রনি মরা গোমতির উত্তর দিকটায় টানা তিনদিন ধরে সাদা বক ধরার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। তবু তাঁর প্রতিদিনের রুটিনই এখন বক ধরতে যাওয়া। একবার ধরা শিখে গেলে তাকে আর কে পায়? এতো বক এখানে, কখনোই শেষ হবে না। মনসুর আলী একদিনে সর্বোচ্চ ১৫টি বকও নাকি ধরেছিলো। অথচ রনি একটি বকও ধরতে পারছে না। তবু তাঁর চেষ্টার বিরাম নেই। বিস্তীর্ণ ধানি জমিতে চিকন বাঁশের খুঁটি দিয়ে কৌশল করে পাতা দিয়ে ঘন সবুজ গাছের মতো করে একটি ঘর বানায় রনি। দূর থেকে একে ঘর মনে হয় না একটুও। গাছই মনে হয়। পাঁচ হাত উচ্চতার এ ঘরের ভিতরে লুকিয়ে রনি বকের মতোই শব্দ করে ডাকে। কিন্তু বকেরা কেন যে সাড়া দেয় না। উড়ে এসে কেউ বসে না তার নকল বৃক্ষে। হতাশ হয়ে যখন রনি তার গড়া নকল বৃক্ষের ভিতর শুয়ে থাকে, ঠিক তখনই ঘটলো আচানক ঘটনা। দুই দুইটি সাদা বক এসে বসলো পাতায় গড়া তার বৃক্ষের মাথায়। দম বন্ধ করে রনি খপ করে ভিতর থেকে একটি বকের পা ধরে ফেলতেই অন্য বকটি উড়ে যায়। রনি তার হাতের মুঠোর বকটিকে টেনে নিচে নামিয়ে এনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে।
রনির বক ধরার খবর মুহর্তেই ছড়িয়ে পড়ে মোহনপুর গ্রামে। কাদা-পানিতে মাখামাখি হয়ে রনি বক হাতে ফুলতলা বাজারের দিকে ছোটে। বিকেল সবেমাত্র হয়েছে। এখনই ক্রেতার সমাগম থাকবে বাজারে। কিন্তু পথ থেকেই চাম্পাপুরের আমীন আহম্মেদ রনিকে ফিরিয়ে দেন। বকের দাম ১০০ টাকার একটি নোট দিয়ে বলেন, তুই আরও বক ধরে আমাদের দিয়ে দিস। আগামী দিন তোকে আরও ১০০ টাকা এডভান্স দেবো। আমার মা বাতের ব্যথায় সারারাত ক্যা ক্যা করে। কিছুদিন বকের মাংস খাওয়ায়ে দেখি কোনো কাজ হয় কী না।
১০০ টাকার নোট হাতে নিয়ে রনির আর আনন্দের সীমা থাকে না। গুরু মনসুর আলীর শেখানো বকের ডাকটি ডাকতে ডাকতে মরা গোমতির উত্তরের বিস্তীর্ণ ধানি জমির দিকে চলে যায়। এতো পাখি রয়েছে এখানে, একটু বুদ্ধি খাটাতে পারলে রনির রুটি-রুজিরই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নিজের গড়া পাতার ঘন নকল বৃক্ষের ভিতরে ঢুকে অবিকল বকের মতো শব্দ করে ডাকে রনি। তার মাথার উপর দিয়ে বক উড়ে যাওয়ার শব্দ পায়। কিন্তু বক আর বসে না। নলবন-ঝোপঝাড় থেকে আরও ডাল-লতাপাতা কেটে এনে নকল বৃক্ষের চারপাশ আরও ঘন করে দেয়। ওপরের ফাঁকা অংশে যেখানে এসে বসবে বকেরা, সেইখানেও আরও পাতা ও ডালপালা ছড়িয়ে দেয়। দূর থেকে এটিকে ঝোপ বা লতাপাতা ছড়ানো গাছই মনে হয়। এরই ভিতর বসে বসে রনি বকের শব্দ করে ডাকে।
দিনে দিনে রনি একজন পাখি শিকারী হয়ে যায়। ঠিক পাখি শিকারী নয়, বক শিকারী। ফুলতলা বাজারে যায়। মোহাম্মদ ফয়াজ আলীর মুদি দোকানের সামনে বসে বক বিক্রি করে। কিন্তু বক বিক্রেতা মনসুর আলীর আর দেখা নেই। পুলিশের কথা বলেছিলো মনসুর আলী। তবে কি কোনো বিপদ হলো তার? রনির বুকে ভয় জমে ওঠে।
পরদিন ঠিক দুপুর বেলা মরা গোমতির উত্তরদিক থেকে দৌড়ে আসে কৃষক সুমন মোল্লা। মোহনপুর গ্রামবাসীকে ডেকে মরা গোমতির দিকে নিয়ে যায়। গিয়ে দেখে এক বীজতলায় পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করছে রনি। কেউ ভেবেছে সাপে কেটেছে রনিকে। পরে দেখলো ধরার সময় বক পাখি তার ডান চোখে ঠোকর দিয়ে একমাত্র ডান চোখটিই বাতিল করে দিয়েছে। একজনের পরামর্শে তাৎক্ষণিক ডাবের জল দেওয়া হলো সেই চোখে। উপশম হলো না কিছুই। যন্ত্রণায় আরও ভয়াবহভাবে চিৎকার করতে থাকলো রনি। হারানো চোখটি উদ্ধারের আশায় সর্বশেষ তাকে হাসপাতালে নেয়া হলেও কাজ হলো না কিছুই। অন্ধই হয়ে গেলো রনি। ফুলতলা বাজার- মোহনপুর গ্রামসহ গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে গেলো সে খবর। সবাই রনিকে দেখতে এসে সহমর্মিতা প্রকাশ করলো, শুধুমাত্র বক শিকারী মনসুর আলীকে ছাড়া। আর কোনোদিনও মনসুর আলীর খোঁজ পেলো না রনি। এলো না সে আর ফুলতলা বাজারেও। কোনোদিনও আর এলো না। সেই থেকেই ফুলতলা বাজারের মোহাম্মদ ফয়াজ আলীর মুদি দোকানের সামনে বসে হাট-বাজার চলাকালীন সময়ে ভিক্ষা করে রবিউল হোসেন রনি। বক-দন্ডে গত দেড় যুগ সময় তার অন্ধকারেই কেটেছে। বাকিটা জীবনও কবরের অন্ধকারেই কাটাতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৩ রাত ১:১৬