সে বার পরীক্ষায় ‘ফেল’ করার পর নান্টুর সৎ মা তাকে ‘অযাত্রা’ পদবীতে ‘অলংকৃত’ করে। যে কাজই করতে যায় নান্টু, তার সৎ মা বলে উঠে, আর কাজ শেষ হবে না। কারণ নান্টু গিয়েছে।
মায়ের কথায় প্রচন্ড দুঃখ পায় নান্টু। কিন্তু প্রতিবাদ করে না। কোনো কাজ না করলে সৎ মা বলে, ভূতে ধরেছে। আর কাজ করতে গেলে বলে, সব শেষ করতে বসেছে।
নান্টুর আপন মা মরেছে তাকে দু’বছরের প্রান্তে রেখেই। সংসারে এখন সৎ মা। সৎ মা তার দুঃখ কোনোভাবেই বুঝে না। এক গাভীর বাছুরের প্রতি অন্য গাভীর মায়া আর কতটুকু?
বৈশাখের শুরুতে তার আপন মামার বাড়ী যায় নান্টু। সেখানে প্রায় এক সপ্তাহ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এরই মাঝে একদিন নান্টু তার এক মামাতো ভাইকে নিয়ে মামার আম বাগানে প্রবেশ করে। মামাতো ভাইকে ঝুড়ি দিয়ে মাটিতে বসিয়ে গাছে চড়ে নান্টু। অনেক আম পাড়ার পর, সে গাছের একটি ডালে মৌচাক দেখতে পায়। তখন সে তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নামতে গিয়ে ওই গাছেরই একটি মরা ডালে পা চাপাতেই ধড়াস্ করে মাটিতে পড়ে তার ডান পা ভেঙ্গে ফেলে। এ খবর নান্টুর সৎ মা শুনেই বলল, ‘অযাত্রা’ টা গাছে উঠেছিলো কিসের জন্যে?
প্রায় দু’ মাস পর অনেক চিকিৎসায় নান্টুর পা ভালো হলো। চিকিৎসার খরচ তার মামাই বহন করেছিলো। তার বাবাও খরচ দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার মামার অনুরোধে তা আর দিতে পারেননি। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর একদিন দুপুরে নান্টু তার এক যুবক মামাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথে প্রচন্ড রোদ থেকে মুক্তি পেতে নান্টু ও তার মামাতো ভাই পথের পাশের এক বটগাছের নিচে বসে পড়ে। নিজের বাড়িতে ফেরার পর সৎ মা তাকে কি বলবে, বসে বসে দু’জনে তা নিয়ে আলাপ করতে থাকে। নান্টু বলে আচ্ছা ভাই, মা যদি আবার আমাকে ‘অযাত্রা’ বলে গাল দেয়, তবে আমি কি করবো? নান্টুর মামাতো ভাই বলে, “আরে ভাই, তুই আর কি করবি। মালিকের ধমক খেয়েও কর্মচারী যেমন চুপ থাকে, ঠিক তেমনি থাকবি”
নান্টু বলে, কেন?
কেন মানে? চুপ না থেকে কিছু কি করতে পারবি?
অনেকক্ষণ চুপ থেকে নান্টুও বলে ঠিক বলেছেন বড় ভাই। কী আর করবো। সয়ে তো যেতেই হবে। কয়লা হয়ে যখন জন্ম নিয়েছি, জ্বলতে তো হবেই আমাকে।
বটগাছের নিচে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর উভয়ে আবার হাঁটা ধরে। হাঁটতে হাঁটতে যখন বাড়ির কাছে পৌঁছে, তখন নান্টুর বাবা তাদের উভয়কেই দেখে। বাবা নান্টুকে টান দিয়ে বুকের সাথে মেশায়। এর আগেও তার বাবা মামার বাড়িতে গিয়ে নান্টুকে অনেকবার দেখে এসেছে। অথচ নান্টুর সৎ মা তাকে দেখেই বলে উঠে, ‘অযাত্রা’এসেছিস? আম গাছে উঠেছিলি কেন? তোর মামাদের দেশে কি কোনো কাজের লোক নেই নাকি? তা না ই যদি থাকে, তো বিদেশ থেকে আমদানি করলেই তো পারে। নান্টুর বাবা নান্টুর মাকে এ নিয়ে আর কিছুই বলে না। এসব নিয়ে নান্টুও মুখ খোলে না কখনো। তার মামাতো ভাই মুখ খুলতে চেষ্টা করেও সাহস খুঁজে পায় না।
বিকেলে নান্টু তার মামাতো ভাইকে নিয়ে ফসলের মাঠে যায়। ধানের ক্ষেতে পোকার আক্রমণের সংবাদ নিয়ে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসে। তার মুখে পোকার খবর শুনে তার সৎ মা বলে ‘অযাত্রা’ কি আর যাত্রার খবর আনবে? নান্টু তখনও চুপ করেই থাকে। নান্টুর বাবাও প্রতিবাদ করে না। বউকে কেন যে ভদ্রলোক ভয় করেই চলেন। আর এসব দেখে নান্টুর খুব রাগও হয়। এদিকে পরদিন নান্টুর মামাতো ভাইও তার নিজ বাড়িতে চলে যান। নান্টু গোপনে গোপনে কাঁদতে থাকে মামাতো ভাইয়ের জন্য। গত দু’মাস ধরে তার এ মামাতো ভাইটিই তার সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন।
তারও দু’দিন পর নান্টু তাদের ঘরের উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারই লাগানো কুমড়ো গাছটিকে দেখে। যত্নের অভাবে গাছটি কেমন লাল হয়ে গেছে। কুমড়োও দিচ্ছে না। এসব দেখে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায় নান্টু। মাকে বলে, মা গাছটি যে কোনো কুমড়োই দিচ্ছে না এখনো, কী করা যায়? নান্টুর সৎ মা তখন বলে, অযাত্রার লাগানো গাছ তো, তাই।
নান্টু তার সৎ মাকে আর এ বিষয়ে কিছুই বলে না। বাড়ি থেকে একেবারেই বের হয়ে যায়। সেই যে যায়, আর তার কখনো কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। এমনকি তার আপন মামার বাড়িতেও না।
নোট: স্কুলের খাতা থেকে এ গল্পটি প্রথম ২০০০ খ্রিস্টাব্দে কপি করে দিয়েছিল আমার সাবেক স্ত্রী ফারজানা কবির ঈশিতা। পরে ১০১৬ সালে আমার স্ত্রী সাদিয়া অসীম পলি ওই একই গল্প কম্পোজ করে দেয়। লেখায় কোনো রদবদল করা হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৬