আলোকচিত্র: জসীম অসীম: 1996
আল্লার গজব পড়বো। গজব পড়বো। এতো বেঈমানী আল্লায় সহ্য করবো না। কোনোদিনই না।’
ফুলকি বেগম। গফুরের বউ। বিকেলের শুরু থেকেই তাঁর এমন বকাঝকা-রান্নাবান্না এবং কান্নাকাটি। তিনটাই একই সঙ্গে করতে থাকে সে।
গফুরের একমাত্র মেয়ে মিতু। অনেক কিছু দিয়েই তাঁকে দূরের এক পরিবারে বিয়ে দিয়েছে। আশা ছিল মেয়ে সুখী হবে। ভাতের কষ্ট পাবে না। কিন্তু মিতুর স্বামী এখন নতুন মোটর সাইকেল চায়। যদিও তাঁদের বিয়ের সময় তা দেয়ার কোনো কথাই ছিল না। এখন দিতে না পারার জন্য তাঁর মেয়েকে নিয়মিতই খারাপ কথা শুনতে হয়। নানা রকমের খারাপ খারাপ কথা। মেয়ের স্বামীর গ্রাম ‘পরবাস’ থেকে এক ভিখারিনী মহিলা এসে বলে গেছে গতকাল কী এক কারণে মিতুকে নাকি ওরা খুব মেরেছেও।
পাশের বাড়ির কবিরাজের ছেলের সঙ্গে কিশোরকাল থেকেই মিতুর ভাব-প্রণয় ছিল। কিন্তু কবিরাজের ছেলের না ছিল বিদ্যা, না জোতজমি। তাই তাঁর সঙ্গে মিতুর বিয়েটা হোক, এ কাজে ফুলকি বেগম নিজেই রাজি ছিল না। মিতুর বাবা গফুরের রাজি-অরাজি দিয়ে অবশ্য কিছুই যায় আসে না। কারণ গফুর বোকা। কিন্তু এই বোকা গফুরের মেয়েটিই যেমন চালাক, তেমনি সুন্দরী। এমন একটি মেয়ে কী না কবিরাজের ঘরে গিয়ে খাওয়ার কষ্ট পাবে? এমনটি ফুলকি বেগম মেনে নিতে পারেনি।
গফুরের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল না হলেও জমিজমা যা আছে, তা দিয়ে খোরাকী চলে যায়। তাই বলে ‘পরবাস’ গ্রামের ভূঁইয়াদের সঙ্গে আত্মীয়তা করার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। কিন্তু মিতুর রূপ ভূঁইয়াদেরও পরাজিত করে।
প্রথম প্রথম গফুরের বউ ভাবতো, তার বুঝি বা ভাগ্যই খুলে গেছে। অন্ততপক্ষে মেয়ের ভাগ্য তো খুললোই। তাতে আর সন্দেহ কী? কিন্তু না। দু‘দেড় বছরের মাথায় এসে এখন তাঁরা দু’স্বামী-স্ত্রী মেয়ের চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছে। আর আজ মেয়ের খবর শোনার পর থেকেই ফুলকি বেগম তাঁর মেয়ের জন্য কেবলই কাঁদতে থাকে। মনে তার আর কোনোই শান্তি নেই আজ। একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে এমনিতেই ভীষণ রকম কষ্টে থাকে তাঁরা। তার ওপর এমন বাড়তি জ্বালা-যন্ত্রণা। প্রায়ই নিজের মেয়ের জন্য বুক চিনচিন করে। এই কি ছিল মেয়ের কপালে?
সূর্য ডুবে যাবে আর কতোক্ষণ পরেই। অথচ ফুলকি বেগমের দিনের অনেক কাজই বাকি পড়ে থাকে। রাগে আগুন হয়ে সে কাজগুলো শেষ করতে থাকে। রান্নাঘরের একপাশে কিছু শুকনো ধান রাখা ছিল। ফুলকি বেগম সেখান থেকে প্রায়ই মুরগীকে ধান খেতে দেয়। আজ তাঁর নিজের পোষা মুরগীটার কথাও মনে পড়ছে না তেমন। একসময় বাচ্চাসহ মুরগীটা নিজেই এসে খাবারের জন্য নানা গন্ডগোল বাঁধায়। বারবার ওই মুরগীটার কটকট শব্দে সে অস্থির হয়ে ওঠে। আর ওই মুরগীর কচি কচি বাচ্চাগুলোর কিচকিচ শব্দে ফুলকি বেগমের মাথা আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে। তাই সে চিৎকার করে মাছ কাটার বটিটাকে সন্তানসম মুরগীর দিকে জোরে ছুঁড়ে মারে।
বটিটা মুরগীর কিংবা তার বাচ্চাদের গায়ে পড়ে না ঠিকই। তবে ফুলকি বেগমের মন যে আজ ভালো নেই, তা মুরগীটা ততক্ষণে একটি মুরগী হয়েও ঠিক বুঝতে পারে। তাই সে তার বাচ্চাদের নিয়ে মাঝ উঠানের দিকে চলে যায়।
ফুলকি বেগমের ছনে আবৃত রান্নাঘরের চালে বসে ডাকছিলো বুড়ো কাকটি। অন্য সময় হলে ফুলকি বেগম বাসিভাত দিয়ে দিতো। এখন সে দিকে নজরই নেই তাঁর। কাকটাও খাবার পাওয়ার আশায় ছনের চালে বেড়ে ওঠা মিষ্টি কুমড়ার পাতার ফাঁকে ফাঁকে অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করে। কিন্তু কোনোভাবেই সে ফুলকি বেগমের নজরে আসতে পারে না।
মেয়ের কষ্টে ফুলকি বেগমের চোখের জল আর বুকের লেলিহান শিখা আজ শেষ হতেই চায় না। রান্নাঘর থেকে খাবার ঘরে একবার আসে, আবারও রান্নাঘরে যায়। রান্নাবান্নার এটা সেটা এ-ঘর সে-ঘর করে। ফাঁকে একবার তাঁ কচুপাতা রঙের শাড়ির মধ্যে কোদালের ভাঙ্গা হাতলটি জড়িয়ে যায়। ফুলকি বেগম তখন কোদালটি হাতে নিয়ে এটিকে প্রায় দশ গজ দূরে ছুঁড়ে ফেলে। তারপর রসুনের খোঁজে পাটের শিকেয় তোলা মাটির একটি হাঁড়ি নামাতে যায়। হাত থেকে খসে মাটিতে পড়ে হাঁড়িটি একেবারেই আট নয় টুকরো হয়।
অথচ আজই হাট থেকে বড় একটি মাছ এনেছে গফুর। বোয়াল মাছ। মেয়েকে ফেলে বড় কোনো মাছও খেতে পারে না তাঁরা। তারপরও আজ এনেছে গফুর। হয়তো তাঁর বোয়াল মাছ খেতে মন চেয়েছে।
সূর্য ডুবে ডুবে সময়ও শেষ। তবু ফুলকি বেগমের মাছ কাটা শেষ হয়নি এখনো। মাছ কাটা বটিটাকে যে কিছুক্ষণ আগে পোষা মুরগীটার দিকে ছুঁড়ে মেরেছে, সেটা এখনো কুড়িয়ে আনেনি সে। তাঁর মনটা আজ পড়ে রয়েছে মেয়ে মিতুর কাছেই। তাই ঠিক নেই মাছ কাটার বটিতে সে নিজেই যে কখন না কাটা পড়ে যায়।
রান্নাঘরের পাশের পথটা দিয়ে মাটির হাঁড়িওয়ালা দিন শেষে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলো। সন্ধ্যা নিকটে ছিল বলে বিক্রির জন্যেও আর ডাকাডাকি করছিলো না। হাঁড়িওয়ালাকে চোখে পড়ে ফুলকি বেগমের। ধানও ছিল হাঁড়ি-সানকি রাখার মতো বাছাই করা ধান। দরকারও ছিল আরও কয়েকটি মাটির হাঁড়ি-পাতিলের। কিন্তু হাঁড়িওয়ালাকে আজ আর কোনো ডাকাডাকিই করলো না ফুলকি বেগম।
বৈশাখের সন্ধ্যায় অন্ধকার ধীরে ধীরে ফুলকি বেগমের বাড়িতেও নেমে আসে। পোষা মুরগীটা তার বাচ্চাদের নিয়ে আবার রান্নাঘরে আসে। ভেবেছিলো গৃহকর্ত্রীর মেজাজ-মর্জি সন্ধ্যার মতো এখন একটু নরম হয়ে গেছে। না। এবারও ফুলকি বেগম মুরগীটাকে দেখে চিৎকার করে ওঠে। ‘‘জানাজার ঐ মুরগীটাও আমার মাথা খাইবো। মাইনষে তো পাগল বানাইয়াই ছাড়ছে, আর এই জানাজার মুরগীডাও দেহি জান না নিয়া যাইবো না। আজরাইল। সব আজরাইল। আমার চাইরপাশে যা যা আছে, সব আজরাইল।’’
মুরগীকে এবার আর বটি দেখাতে হয় না। মুরগী তার বাচ্চা নিয়ে এমনিতেই দৌড় দেয়। মুরগীর সঙ্গে থাকা তার লাল-কালো-সাদা রঙের তুলোর মতো নরম নরম বাচ্চাগুলো বুঝতে পারেনা কেন এমন অবেলায় তাদের মা বাড়ির বিপরীত দিকে দৌড়ায়। ফুলকি বেগম তারপরও থামেনা। লাঠি একটি ডান হাতে নিয়ে মাঝ উঠোন পর্যন্ত মুরগীর টেছন পেছন দৌড় দেয়। তারপর আবার রান্না ঘরে ফিরে আসে ফুলকি বেগম।
তখনও দূরের মাঠ থেকে ছেলেদের ফুটবল খেলার হৈ-হুল্লোড় বাতাসে ভেসে আসে। ঠিক এমন সময়ই হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া আসে। সেই দমকা বাতাসে উঠোনে ছড়ানো পিঁপড়ায় কাটা খুলে দেয়া ছাতাটা ঠিক রান্নাঘরের দরজায় উড়ে আসে। ফুলকি বেগম গর্জনের স্বরে বলে, ‘‘তুফানের নমুনা নাকি? গজব তো সব একবারে নামে।’’ অনেকক্ষণ পর আবার ফুলকি বেগম মাটির চুলার সামনে বসে। ভাতের হাঁড়িতে ‘পট পট’ শব্দ নিয়ে চাল সিদ্ধ হতে থাকে। পরনের শাড়িটা বাম হাঁটুর একটু উপরে তুলে বাম হাতেই হাঁটু চুলকায়। অন্য হাতে ভাতের চাল নাড়তে থাকে। পোষা বিড়ালটা বিভিন্ন জায়গায় হাঁটাহাঁটি করে রান্নাঘরে আসে। দরজার পাশে কাঁচা বোয়াল মাছের গন্ধ পেয়ে ভাবে, রাতের খাবারটা আজ মাশাল্লাহ ভালোই হবে। কিন্তু হঠাৎই আবার ফুলকি বেগমের পায়ের আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘরের সীমানা ছেড়ে পালিয়ে যায় বিড়ালটি।
ফুলকি বেগমের সারা বাড়িতে আর একটিও শিশু নেই। তাঁর বছর তিনেকের একটি ছেলে সন্তান ডায়রিয়ার মারা গেছে। আট নয় মাস আগে। সেই সন্তানটি তাঁদের মারা যাওয়ার পর সমস্ত বাড়িতেই এখন এক শ্মশানের শূন্যতা বিরাজ করে।
এমন শূন্যতা ছিল না কখনো যখন মিতু ছিল এ বাড়িতে। এখন এ বাড়িতে একটি কুকুর, একটি বিড়াল, একটি মুরগী ও কয়েকটি কাক ছাড়া আর তাদের আপন বলতে কেউ নেই।
ফুলকি বেগমের হিসহিস শব্দের কান্না বাড়ির বাঁশঝাড়ের পাতার খসখস ধ্বনির সঙ্গে এক হয়ে মিশে যায়। তাঁর দুঃখের খবর বাড়ির পোষা কুকুর-বিড়াল-মুরগীর কাছে পৌঁছে গেলেও স্বামী গফুরের কানে এখনো পৌঁছোয়নি। তাই তার মনে অনেক দুঃখ। তবে গফুর মানুষটা মোটেও খারাপ নয়।
দিনরাত খেটে আজকাল ফুলকি বেগমের অবস্থা বড়ই ক্লান্ত। আগে যখন মিতু ঘরে ছিল, তখন প্রায়ই ঘরের জন্য পিঠা পায়েসের আয়োজন করতো। আজকাল ফুলকি বেগম তাঁর স্বামী গফুরের খাওয়া-দাওয়ার নিয়মও রক্ষা করতে পারে না।
মিতুর এখনও পর্যন্ত কোনো সন্তান হয়নি। হলে না হয় জামাইকে খুশি করার বিষয়ে আবারও গভীরভাবে ভেবে দেখতো ফুলকি বেগম। কিন্তু এখন কী করবে? জামাই আবার ঘরজামাইও হতে রাজি নয়। তাতে নাকি তাঁদের বংশের অমর্যাদা হয়। তাহলে কী করবে? নিজেদের যা কিছু আছে, তা বিক্রি করে জামাইকে দিয়ে পথে নেমে যাবে? তা হতেই পারে না। কিন্তু তারপরও তো নিজের মেয়ের জন্য একটা কিছু করতে হবে। কমপক্ষে মিতুর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু করবেটা কী?
ফুলকি বেগম ভাবে, কবিরাজের বড় ছেলে শক্তি’র সঙ্গে মিতুর বিয়েটা হলেই বুঝি বা এর চেয়ে অনেক ভালো হতো। এমন সব যাতনাময় ভাবনায় যখন ফুলকি বেগম গভীরতর আচ্ছন্ন, ঠিক তখনই রান্নাঘরের পেছনে দাঁড়ানো তাঁদের বুড়ো জামগাছটার মগডাল থেকে ‘ধপাস’ করে মাটিতে পড়ে যায় গফুর। ফুলকি বেগম চিৎকার করে দৌড়ে যায় গফুরের কাছে। মাথায় পানি ঢালে।
গফুর ফুলকির ডান হাত ধরে বলে, ‘ফুলি’ কোদালডার আছাড়ের লাইগ্গা জামের ডাইল্লা কাটতে উঠছিলাম। পারলাম না।’ ফুলকি বেগম গফুরের এ আর্তস্বর সহ্য করতে পারে না। বিলাপ করে বলে উঠে, ‘কে কইছে তোমারে জামের ডাইল্লা কাটতে? তুমি আমার কাছে একবারও কইয়া ওঠলা না।’
ফুলকি বেগমের মুখের কথা শেষ না হতেই গফুরের জীবন প্রদীপ দিনের সূর্যের সমান্তরালেই অস্ত যায়। তখন থেকেই দেখা দেয় ফুলকি বেগমের মনে আরেক আগুনের ফুলকি।
রচনা: 16 আশ্বিন 1399
1 অক্টোবর 1992
নোট: এ গল্পটি 1995-2000 সালের মধ্যে কুমিল্লার ‘দৈনিক রূপসী বাংলা’ পত্রিকার সাহিত্যপাতার কোনো এক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ১০:২৫