রচনা-2001
সাহাপাড়া, চকবাজার, কুমিল্লা।
=============
চিত্রকর্ম: জসীম অসীম।
==============
বন বা বৃক্ষ থেকে কি পাখিদের তাড়ানো যায়? কেউ তাড়িয়ে দিলেও সেই পাখি উড়ে গিয়ে অন্য বৃক্ষে বসে। গুলিবিদ্ধ পাখিও শেষ পর্যন্ত এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতেই চায়।
পাখি শিকারী কাউসারও তেমনই এক গুলিবিদ্ধ পাখি। শত শত গুলি তার বুকে বিঁধে আছে। তাই এখন শত শত পাখি এই পাখি শিকারী কাউসারের মুখে থুতু ছিটিয়ে দেয়। অবশ্য থুতু ছিটিয়ে দিলেও তার তাতে কিছুই যায় আসে না।
চারদিকে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ নেই। পাখির মতো উড়ার স্বাধীনতা নেই। এমন জনপদ কি কল্পনা করা যায়, যেখানে মানুষের সন্তান উড়ার স্বাধীনতা পাবে না?
কার হুকুমে পাখিকে গুলি করে কাউসার? কেন সে হাঁটতে হাঁটতে বনে গিয়ে ওঠে? কেন তার কাছে হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় মনকে তার সুস্থ রাখতে পাখি শিকারের তেমন বিকল্প নেই? কেন?
কাউসার ভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই খুব গরীব । এমন গরীব দেশের মানুষ যদি পাখি না খায়, তো আর পাখি খাবে কে?
পাখি শিকার করতে করতে একসময় কাউসার পাখি বিশেষজ্ঞও হয়ে ওঠে। এমনকি হয়ে উঠে এক উচুঁ শ্রেণির পাখি শিকারীও। প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় উড়ন্ত কোনো পাখিকেও গুলি করে ফেলে দিতে পারে সে। কেন সে এভাবে পারে? কিংবা কিভাবে পারে?
রাত হলেই নিষিদ্ধ পানীয়ের গ্লাসে গভীর করে চুমুক দেয় কাউসার। রাগে তার তখন চোখ জোড়া লাল হয়ে যায়। কাউসার ভাবে, কেন মানুষের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে পাসপোর্ট-ভিসা লাগে অথচ পাখিদের এসব লাগে না? পাখিরা মানুষের অধিক স্বাধীনতা ভোগ করবে কেন? তাই রাগে পাখিদের ঝাঁকে গুলির পর গুলি করে সে। গুলি পড়ে অনেক পাখির চোখও ঠিক বের হয়ে যায়।
ফলে কাউসারের প্রতি পাখিদের ক্ষোভও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কিন্তু তার সেদিকে চোখ যায় না। মারতে মারতে পাখিদের ঠিক বাসা পর্যন্তও চড়াও হয়। অথচ পাখিরা এ জন্য তেমন কোনো প্রতিরোধই করতে পারেনা। তাদের তেমন কোনো সংগঠন-সমিতিও নেই যে, তারা প্রতিবাদ প্রতিরোধ করবে।
কাউসারের বুকে যেন শত গুলি বিদ্ধ হয়ে আছে। ছেলেবেলায় সে ঈদের জামাকাপড় পছন্দ করতো পাখির পালকের মতোই রঙিন। আর তখন নিজেও পাখির মতোই উড়তে ভালোবাসতে। তখন তার খুব লোভ হতো পৃথিবীর সমস্ত পাখিদের ছুঁয়ে দেখার। আর এখন?
কাউসারের হৃদয় এখন কষ্টের গুলিতে সেলাই হয়ে যাওয়া এক হৃদয়। তাই যেন সে তার কষ্টকে কমাতে চায় পাখিকে গুলি করে। এমনকি বন্দুক নষ্ট হয়ে গেলেও সে পাখি হত্যা ছাড়ে না। পাখি হত্যাকারী হয়েও সে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। এমনকি যেন সে পাখি হত্যার জন্যই পৃথিবীতে আবারও বেঁচে থাকে।
একটি প্রেমিক পাখি প্রেমিকার সঙ্গে শরীর বিনিময়ের সময় চোখে পড়ে যায় কাউসারের । গুলি করে কাউসার। প্রেমিকা পাখিটি বিশ্বাস করতে পারেনি তার প্রেমিকাটি গুলিবিদ্ধ হয়ে ততোক্ষণে মরে গেছে...কিছুক্ষণ আগেও যার সঙ্গে দৈহিক মিলনে আবদ্ধ হয়েছে সে।
প্রেমিকা পাখিটি নাস্তিক প্রাণ নিয়ে যেই পালাতে যাবে, সেইমাত্রই তাকেও গুলি করে কাউসার। গুলি লেগে মাথা ফাটে যায় প্রেমিক পাখিটিরও। প্রথমে গুরুতর আহত হয়। তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শরীর থেকে তার গাছের বুকে ছোপ ছোপ রক্ত লাগে থাকে। মুহুর্তেই এলাকাটা পাখিশূন্য হয়ে পড়ে। এমনকি সীমান্তের সেই অঞ্চলের অধিকাংশ পাখি তার ভয়ে বাংলাদেশ অংশ থেকে ভারতের দিকে পালিয়ে বাচেঁ: অনেকটা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের মতোই।
অথচ এই কাউসারই আবার বলে, আমি কেবল পাখি মারিই না, পাখি লালনপালনও করি। যেমন কবুতর। কিন্তু যারা মাছ কাটার বটি দিয়ে মানুষ কেটে ফেলে, সে মানুষ কতোটা মানুষ?
অনেকে কবুতর প্রিয় কাউসারকে নিয়ে বলে, যে লোকটা আদর করে কবুতর লালনপালন করে, সে লোকটা কেন এমন পাখি হত্যার হোলি খেলায় প্রায়ই মেতে ওঠে ? কেন?
একদিন কাউসারকে তার বউ বলে, তুমি পাখি মারো কেন? কাউসার বলে, অনেকটা শিকারের শখে। আমি বনে যাই বণিকের বেশে নয়, শিকারের শখেই। বউ বলে, তুমি তারপরও জুলুমবাজ শিকারী। তোমার প্রতিটি গুলির সঙ্গে সঙ্গে শস্য শ্যামলা বাংলা কেঁপে ওঠে ।
কাউসার বলে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে কি বাংলা দেশটা কাঁপেনি?
: কেপেঁছে। কিন্তু পাখিরা তো আর পাকিস্তানী আর্মি বা রাজাকার নয় । তাদের কেন মারো তুমি?
-বুঝলাম পাখিরা রাজাকার নয়। ধরে নিলাম ওরা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তির প্রতীক। কিন্তু ওদের হত্যা করলে এ কালের মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে বাধা দেয় না কেন? কাউসার তার পাখি খুনের বিষয়ে এমনই ব্যাখ্যা দেয়।
রাত হলে কাউসারের বউ ভালো করে ঘুমাতেও পর্যন্ত পারেনা। চোখ একটু বন্ধ করলেই দেখে পাখির ছিন্ন ভিন্ন মাথা। লুটিয়ে পড়া আহত বিভিন্ন পাখি। এসব চিত্র তার মন সাংঘাতিক খারাপ করে দেয়। এমনকি বারবার ঘুমও ভেঙ্গে যায়।
কাউসারের বাসায় আড্ডা হয়। মনে রাখার মতো আড্ডা। আড্ডায় তার পুরনো বন্ধুরা প্রায়ই বলে, কি-রে কাউসার-পাখি মারিস কিভাবে ? ছেলেবেলায় সোনালী কাগজে কতো পাখি তুই বানাতি। মনে পড়েনা তোর? আকাশে দল বেঁধে উড়া পাখি দেখলে পাখিদের পেছনে পেছনে দৌঁড়ে অনেক দূর চলে যেতি ? মনে আছে তোর?
কাউসার বলে, খুব মনে আছে। তবে তা ছেলেবেলার কথা। এখন তো আমি আর সেই ছোট্ট ছেলেটিও নেই। দুই ছেলের বাবা। বাস্তবতা ভিন্ন। ছেলেবেলার সেসব আনন্দ এখন আমার জীবন থেকে কোথায় যেন চিরতরে হারিয়ে গেছে।
: ঠিক। তা না হলে এমন পাষাণ হওয়া কাউসারের পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিলো না। কাউসারের বন্ধুরাও কেউ কেউ আজকাল এমন কথা বলে।
কাউসার বলে, ছেলেবেলায় ছিলাম আমি খুবই আবেগপ্রবণ। রক্তে তখন ছিলো পাখি পোষার কাল। আর এখন রক্ত শরীরে কেবল পাখি শিকারের। এ বয়সে রক্তে আমার শিকারই বিদ্যমান। আমার বাবাও মস্ত এক শিকারী ছিলেন। অথচ ৭১-এ নিজেই শত্রুর কাছে শিকার হয়ে গেলেন।
মাথা গোঁজার ঠাঁই যেখানে কাউসার করেছে, সেখানে ফুল পাখির ঘ্রাণও রয়েছে। ইচ্ছে করলেই সেখানে চড়ুইভাতি করা যায়। নির্দিষ্ট কোনো দিন নেই, ক্ষণ নেই, সব সময়ই তার বাসায় নানা লোকের আনাগোনা। প্রাণে ভরপুর। তবে তার মনে কেন রক্তাক্ত পাখি দেখার এতো সাধ?
রক্তাক্ত পাখি দেখে কি সুখ পাও কাউসার ? শিকার থেকে ফিরে আসলেই কাউসারের বউ তাকে এ কথা প্রায় দিনই বলে।
‘না। সুখ পাই না। কেবল দেখি, পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায় কী না। কিংবা নিলেও আবার সসম্মানে ছেড়ে দেয় কী না।
:আইনভঙ্গের জন্য কেন তোমাকে পুলিশ ধরে না? কাউসারের বউ বলে।
: আমি তো আর পুলিশের থানার ভেতর গিয়ে গুলি করি না। হয়তো তাই। পুশিশ বাদ দাও, বন্দুকওয়ালা এই শিকারীর বিরুদ্ধে কোনো গণরোষও নেই। বুঝলে বউ, গণমানুষও এখানে ভীষণ পলায়নবাদী । যেমন পলায়ন বাদী অনেক অনেক পাখি । যাদেরকে পেছনের বন দিয়ে উড়ে পালাতে দেখলে গুলি করে ফেলে দেই আমি।
ঠিক কবে থেকে পাখি হত্যা করে কাউসার? যেদিন থেকে মীরাও পাখিকে ভালোবাসে। কাউসার চায় না মীরার মতো বিশ্বাসভঙ্গ করা মানুষও পাখিকে ভালোবাসুক। যেন সেই অধিকার মীরার নেই। এমন ভাবনায় ভাবনায় কাউসার নিজেকে রীতিমত অসুস্থ করে দেয়।
এমনি একদিন খুব ভোরেই পাখি শিকারে বের হলো কাউসার। সীমান্তের কাছের বনাঞ্চলে গিয়েই দূর থেকে মীরার দেখা পেল। পাখি শিকারে আর মাথা ঘামালো না সে। অপেক্ষায় থাকলো মগজে বাস করা মানুষ খুনিটার কালো ছায়ার দেখা পাওয়ার।
ততক্ষণে দুপুরও হয়ে এলো। মীরা ও তার স্বামী গেল খাওয়ার জন্য বনের ভিতরের এক রেষ্টুরেন্টে। কাউসার তখন মনের দুঃখে গোপনে গোপনে কাঁদে। ততক্ষণে কাউসারের কাছে তারই সঙ্গী মতিন উপস্থিত হয়। মতিনের হাতের ব্যাগে তখন তিন/চার রঙের গুলিবিদ্ধ পাখি।
সকালে মতিন মোরগ ডাক দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম থেকে ওঠেছে। এতক্ষণ সে একা একাই পাখি শিকার করেছে। তাই সে খুব ক্লান্তিবোধও করে।
মতিন বলে, আজ আপনার কী হয়েছে কাউসার ভাই? পাখি শিকার যার নখদর্পণে, সে যদি পাখি না মারে, তবে কি মজা আছে? কাউসার বলে, পাখি আর মারিস না মতিন। নিরীহ পাখিকে খুন করে কী লাভ? ওরা সকলেই পাখি। মানুষ তো নয়।
মতিন কাউসারের এ কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারেনা। মনে মনে ভাবে, পাখিরা এখন কি তাহলে জন্মনিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে? কিংবা পাখি হত্যার বিরুদ্ধে গণরোষ কি চাঙ্গা হয়েছে? কেন আজ কাউসার ভাই এমন কথা বলে? তার কি পাখি শিকারের নেশা মরে গেছে? কিন্তু কেন? নাকি এতোদিন পর তার বিবেক জাগ্রত হলো।
মতিনের ভাবনায় বিঘ্ন ঘটিয়ে কাউসার বলে, মতিন শোন, তুই রাস্তায় গিয়ে একটি রিজার্ভ বেবী ট্যাক্সি ঠিক কর। আমি আসছি। আমরা এখনই চলে যাবো।
চলে যাবার কথা শুনে মতিনের খুব মন খারাপ হয়। বলে, কী বলেন কাউসার ভাই? আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
: না, মাথা ঠিকই আছে মতিন। আমি যা বলছি, তাই কর।
তারপর মতিন চলে যায় রাস্তার দিকে। কাউসার বন্দুক হাতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মীরার দিকে। মীরা তখন বেগুনি ফুলের রাজ্যে। উড়ে বেড়াচ্ছে। তাকে লক্ষ্য করেই কাউসার ছুঁড়ে গুলি। অনেকক্ষণ। ঠিক মীরার বুকেই। এক+দুই=তিন...।
মীরার স্বামী দৌঁড়ে পালায়। বনের বাতাসে মীরার রক্তের গন্ধ ওঠে। দূর-দূরান্ত থেকে আগত পাখিরা উড়ে পালাতে থাকে। গুলিতে মীরার দুই চোখও উপড়ে যায়। এতোদিন যে তীব্র যন্ত্রণাটা কাউসারকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল, তা যেন এখন আর নেই তার বুকে। সবুজের বিস্তৃত প্রান্তর পাড়ি দিয়ে রাস্তায় ওঠে কাউসার। বনের কাকেরা শ্লোগানে শ্লোগানে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তার খোঁজে ততক্ষণে বিডিআরও চিরুনী অভিযানে নামে। কাউসার ভেবেছে, এখান থেকে সে পালিয়ে বেঁচে যাবে। পাখি হত্যার অভিশাপের আগুনে কি দগ্ধ হবে না কাউসার? জীবনটা কি এসো ছবি অাঁকি, রঙ করি...দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির ছবি অাঁকারই খেলা! কাউসারের মনে এখন তীব্রতর ভয়। কারণ শিকারীকেও কখনো কখনো শিকারই হতে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৩৫