দীর্ঘ যুদ্ধের পরে আফগানিস্থানে তালিবান শাসনের সময় শুরু হয়েছে | আপাতত এই বিজয় শান্তির সুবাতাস আনলেও তার ধারাবাহিকতা ও সুফল নির্ভর করবে তালেবানদের পরবর্তী পদক্ষেপ, তালেবান শাসনবাবস্থা, বিরোধীদের ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর অবস্থান এর উপর | যুদ্ধের ফলে দেশটির আর্থিক অবস্থা বর্তমানে বেশ খারাপ হলেও আগামী দিনে এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম স্বনির্ভর ও ধনী রাষ্ট্র হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে । এর মধ্যে আমেরিকা তার কাছে রক্ষিত রিজার্ভের নয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার আটকে দিয়েছে | যদিও কোভীড মোকাবেলার জন্য আই, এম. এফ জরুরি ভাবে ৪৬০ মিলিয়ন ডলার তহবিল অনুমোদন দিয়েছে তারপরেও জাপান , জার্মানি ,ব্রিটেন সহ অনেক দেশ তাদের সাহায্য বন্ধ করে রাখলে দেশটির সামনের দিনগুলি বেশ কঠিন সময়ের মধ্যে পড়বে | বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর এই দেশটির সরকার পরিচালনার খরচের ৭৫ ভাগই আসে বৈদেশিক সাহায্য থেকে | দেশটির ৪৪ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ কৃষি ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির মাদ্ধমে জীবিকা নির্ভর করে | এই কৃষির মধ্যে অন্যতম হলো পপি চাষ যা হেরোইন , ও আফিম তৈরির কাজে ব্যাবহার হয় | ইতিপূর্বে তালেবান শাসন আমলে এই পপি চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং এবারও সেটাই হবে বলে অনুমান করা যায় | বৈদেশিক সাহায্যের পরিমান কমে যাওয়া ও পপি চাষের উপর নিষেধাজ্ঞা বেকার সমস্যা বৃদ্ধি ও স্বল্পমেয়াদে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে | উল্লেখ করা যেতে পারে যে পাথুরে দেশ হলেও আফগানিস্তানে প্রচুর উন্নত মানের তাজা আঙ্গুর ও কিশমিশ ( শুকনা আঙ্গুর ) উৎপন্ন হয় যা তাদের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এছাড়া নানান রকম সবজি ও শুকনা ফল, বাদাম জাতীয় ফল যেমন কাজু বাদাম, খেজুর, নারকেল , আনারস, আভাকাডো , রপ্তানি করা হয়। এতদিন ভারতীয় ব্যাবসায়ীরা আমেরিকার সহায়তায় এই পণ্য গুলোর কমদামে একচেটিয়া ব্যবসা করলেও এখন তাদের আফগানিস্থান থেকে তাড়িয়ে দেয়ার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা পাকিস্তান , চীন ও অন্যান্য দেশ নিয়ে নেবে। এর মধ্যে ভারতে শুকনা ফলের ও নানা বাদাম জাতীয় ফলের দাম অনেকগুন বেড়ে গেছে।
খনিজ সম্পদে ভরপুর আফগানিস্তান যুগে যুগে বিভিন্নদেশের আক্রমণের শিকার হলেও কোন দেশে ই আজ পর্যন্ত আফগানিস্তানকে দখল ও খনিজ সম্পদ পুরোপুরি ভাবে উত্তোলন করতে সক্ষম হয়নি। আশার বিষয় হলো চীন অন্য দেশের মত যুদ্ধ করে দখল না করে দুইদেশের স্বার্থে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের মাদ্ধমে আফগানিস্তানের উন্নয়নের শরিক হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দীর্ঘ দিন আফগান যুদ্ধে তালেবান বিরোধী অবস্থানে থাকা ও তাদের শত্রুদের সামরিক ও কুট নৈতিক সহায়তা করা ভারত এখন তালেবানদের দ্বারা আফগানিস্তান থেকে অপমানিত ও বিতাড়িত সেই জায়গায় তালেবানদের বিপদের বন্ধু চীন ও পাকিস্থান আগামী দিনে শান্তিপূর্ণ উন্নত আফগানিস্তানের বিনির্মানে সহায়তা করবে নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। এর সাথে তালেবানরা সন্ত্রাসীদের আশ্রয় প্রশ্রয় না দেয়া ,মেয়েদের সমান অধিকার ও শিক্ষার সুযোগ দিয়ে আমেরিকার ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়বে বলেই তাদের পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তানের সাথে চীনের ৭৬ কিলোমিটার বা ৬৪ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত থাকায় সেখানে দুই দেশেরই শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অভিন্ন স্বার্থ আছে । বিগত যুদ্ধে তালেবানদের সহযোগিতা ও সমর্থন এর বিনিময় চীন আফগানিস্তানে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। তালেবানরাও তাদের খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও অবকাঠামো নির্মাণে চীনের সাহায্য নেবে এটা প্রায় নিশ্চিত। এখন চীন পাকিস্তান ব্যাবসার ইকোনোমিক করিডোর যে (CPEC ) নাম পরিচিত সেটির সাথে আফগানিস্তান কে সংযুক্ত করে চীনের আমাদানী রফতানির পথ সুগম করা হবে। আফগানিস্থানে উল্লেখযোগ্য খনিজ সম্পদ গুলোর মধ্যে লোহা, সোনা, তামা, ইউরেনিয়াম (পারমানবিক বোমা বানানোর কাজে ব্যাবহার হয় ), রুবি পাথর, বিরল মাটি ,ক্রোমিয়াম , দস্তা,সালফার,জিপসাম ,কয়লা ,ও লিথিয়ামের মত মহামূল্যবান ধাতব পদার্থ আছে। বিভিন্ন জিওলজিক্যাল সার্ভে থেকে জানা যায়,আফগানিস্থানে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি পরিমাণ মূল্যের খনিজ সম্পদ আছে।আফগানিস্থানে ৩০ মিলিয়ন টন তামার মজুদ আছে যা চীন অনেক আগেই ৩০ বছরের চুক্তি করে রেখেছে। যুদ্ধের কারণে এতদিন এই খনিজ না তুলতে পারলেও এখন চীন সেই তামা উত্তোলন শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। দেশটিতে ১.৬ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল, ১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের বিশাল মজুদ আছ যার আনুমানিক মূল্য ১০৭ বিলিয়ন ডলার। আমেরিকা আফগানিস্তানকে লিথিয়ামের সৌদি আরব নাম রেখেছে , লিথিয়াম এমন একটি ধাতু যা বৈদ্যুতিক গাড়ির যন্ত্রাংশ ,ব্যাটারি তৈরি এবং ল্যাপটপ ,স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বিরল এই ধাতুর মূল্য প্রতিবছর 20 শতাংশ হারে বেড়ে চলেছে। আমেরিকা কে তার প্রয়োজনীয় লিথিয়ামের শতকরা আশি ভাগ আমদানি করতে হয় চীনের কাছ থেকে । চীন এই সুযোগে আফগানিস্তানের এই মূল্যবান ধাতুউত্তোলন ও ব্যবসা করার উদ্যোগ নেবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া আফগানিস্থানের বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তামার খনি থেকে ইতিমধ্যে চীন তামা উত্তোলন করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। তালেবান বিরোধী সরকার ও বিরোধী দলের সমর্থন দিয়ে আসা ভারত গত 20 বছরে তার বিনিয়োগের প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার এবং শত শত মানুষ নিয়ে রাতের অন্ধকারে আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের অতীতের শত্রুতা তালেবানদের মনে থাকায় এখন ভারতের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা বিফলে গেছে। আফগানিস্তানে ভারতের জন্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক একটি বড় পরাজয়। আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহার ও ভারতে সহ বেশ কয়েকটি দেশের আফগানিস্তানের কনস্ট্রাকশন ওবিনিয়োগ এর সুযোগ বন্ধেরফলে পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান ,ইরান ,রাশিয়া ও চীন এই সুযোগে এগিয়ে আসবে এবং আফগানিস্থানে তাদের বিনিয়োগ ব্যবসা , খনিজসম্পদ আহরণ অবকাঠামো নির্মাণে ভূমিকা রাখবে যা দেশটিকে দ্রুত উন্নতির পথে নিয়ে যাবে । বিগত সরকারগুলোর আমলে দুর্নীতির ও তালেবানদের সাথে যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন বিনিয়োগকারী আফগানিস্তান থেকে তাদের বিনিয়োগ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন নাই। সু শাসন , দুর্নীতি প্রতিরোধ ,রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারলে এবং চীনের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারলে আফগানিস্থান অতি সহজেই দ্রুততার সাথে বিশ্বের একটি ধনী দেশে পরিণত হবে। তালেবানরা যদি সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলে দেশটি খুবই দ্রুত চীন-পাকিস্তান রাশিয়া ইরান তুরস্কে সহ পশ্চিমের অনেক উন্নত দেশের সহায়তা নিয়ে উন্নত একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ৮:৫১