আমাদের সামনে কঠিন সময় আসছে। কতটা কঠিন আমরা হয়তো ভাবতেও পারছি না। এখন করোনার কারনে মানুষ দিশেহারা। কদিন পরে একমুঠো খাবারের জন্য দিশেহারা হয়ে যাবে। পেটের ক্ষুধায় বেড়ে যাবে নানান অপরাধ। যাদের টাকা আছে তারা হয়তো ভাবছেন কিনে খেতে পারবেন। কিন্তু একবার ভাবুন তো, টাকা আছে কিন্তু খাবারের যোগান নেই। টাকা তো আর চিবিয়ে খাওয়া যাবে না। খাবারই যদি না থাকে তবে টাকা দিয়ে কী হবে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য যা করা দরকার তা হলো আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর এই সক্ষমতা বাড়াতে পারে আমাদের দেশের সবচেয়ে অবহেলীত, নিগৃহীত, অসহায় কৃষক ভাইরা। কৃষকের দিকেই চেয়ে থাকতে হবে সকলের। অন্য সকল অর্থনৈতিক সেক্টরকে আমি তুচ্ছ জ্ঞান করছি না। সবই দরকার আছে। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার পেটের ক্ষুধা নিবারণ করা। ক্ষুধার জ্বালা কত ভয়ংকর হতে পারে এখনকার প্রজন্ম হয়তো অতটা বুঝবে না। কিন্তু আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের কাছে যদি একটু শুনতে চাই তবেই জানতে পারবো কী ভয়ংকর ছিলো সেই দিনগুলি। জলাশয়ের কচু ঘেচু আমরা এখনও খাই, কিন্তু সেটা একটু বিলাশিতার অংশ। এক দিনের বেশি দুদিন পাতে দিলে সবাই নাক সিটকাবে। অথচ একসময় ক্ষুধার জ্বালা মিটাতে লতা-পাতা, কচু-ঘেচু তুলে এনে শুধু সিদ্ধ করে পরিবারের মুখে তুলে দিয়েছিলো। চোখের সামনে সন্তান, পরিবারের ক্ষুধার জ্বালা দেখে সহ্য করতে না পেরে অনেকেই আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছিলো। সামনে যেন তেমন সময়ের মুখোমুখি হতে না হয় সেদিকেই এখন সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। নজর দিতে হবে যেন কৃষকের প্রতি দেয়া সমর্থনটা আবার চুরি হয়ে না যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, করোনার কারণে অনাহারে মরতে পারে ৩ কোটি মানুষ। হুঁশিয়ারি একদম অমূলক নয়। করোনা মহামারিতে থমকে যাওয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সম্প্রতি গণমাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) প্রধান ডেভিড বেসলে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জাতিসংঘ তহবিল গঠন না করলে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। দরিদ্রদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করা না গেলে বিশ্বে অন্তত তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে। বিভিন্ন দেশের সরকারের আর্থিক সহায়তায় বিশ্বে অন্তত ১০ কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয় বিশ্ব খাদ্য সংস্থা। করোনা ভাইরাসের কারণে সারাবিশ্বের অর্থনীতি থমকে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ বিশ্ব খাদ্য সংস্থাকে অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে। এতে বিপর্যয় আরও বেড়ে যাবে। এমন হলে, তিন মাসের বেশি সময় ধরে দিনে অন্তত তিন লাখ গরিব মানুষের মৃত্যু হবে। জীবন বাঁচাতে হলে তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে কভিড-১৯ এর সংক্রমণে যত মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হবে ক্ষুধায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় গৃহীত পরিকল্পনার সঙ্গে অর্থনীতির বিষয়টি বিবেচনা করার আহ্বান জানান বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) প্রধান ডেভিড বেসলে।
আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি খাতের ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এটা খুবই আশার কথা। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এটা খুব বেশি নয়। আরো বেশি প্রনোদনা বা কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি প্রয়োজন হতে পারে। সেই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ও প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রনোদনার এই টাকা কৃষকের মাঝে বিতরণ করার জন্য সুদ হার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের কারণে কৃষি খাতের ক্ষতি মোকাবিলায় চলতি মূলধন সরবরাহের উদ্দেশ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছে। ৬ মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৮ মাস মেয়াদি এ ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৪ শতাংশ। করোনার কারণে দেশের কৃষি খাত দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই খাতে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে দেশের কৃষি খাত সার্বিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। স্কিমের আওতায় পুনঃঅর্থায়ন গ্রহণে ইচ্ছুক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একটি অংশগ্রহণমূলক চুক্তি স্বাক্ষর করবে। সেই চুক্তির মাধ্যমে এই স্কিমের আওতায় পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রাহকদের অনুকূলে ঋণ বিতরণ পূর্বক মাসিক ভিত্তিতে পুনঃঅর্থায়নের জন্য আবেদন করা যাবে। ব্যাংকগুলোর কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ও সব ক্ষমতার ভিত্তিতে কৃষিঋণ বিভাগ থেকে ব্যাংকগুলোর অনুকূলে তহবিল বরাদ্দ করা হবে। তবে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ বিতরণের পর বরাদ্দকৃত তহবিল থেকে পর্যায়ক্রমে তহবিলের সমপরিমাণ অর্থায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। শস্য ও ফসল খাতে চলমান ঋণপ্রবাহ পর্যাপ্ত থাকার দরুণ এ খাত অপেক্ষা কৃষির চলতি মূলধন ভিত্তিক খাতগুলোতে অধিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ খাতগুলোতে ঋণের প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে চলতি মূলধন ভিত্তিক কৃষির অন্যান্য খাতে (হর্টিকালচার অর্থাৎ মৌসুম ভিত্তিক ফুল ও ফল চাষ, মৎস্য চাষ, পোল্ট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাত) পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে দেশের সার্বিক কৃষিখাত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বিদ্যমান কৃষি ও পল্লি ঋণ নীতিমালায় বর্ণিত বিধিবিধানসমূহ অনুসরণ করে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের আলোকে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে বিবেচনা করবে এবং প্রতিটি ঋণের জন্য পৃথক হিসাব সংরক্ষণ করবে। ব্যাংকগুলো পুনঃঅর্থায়ন গ্রহণের তারিখ হতে অনধিক ১৮ মাসের (১২ মাস + গ্রেস পিরিয়ড ৬ মাস) মধ্যে আসল এবং সুদ (বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ১% সুদ হারে) পরিশোধ করবে। আর ব্যাংকগুলোতে গ্রাহক পর্যায়েও ঋণের সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ঋণ গ্রহণের তারিখ হতে ১৮ মাস (৬ মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ)। এ স্কিমের আওতায় ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক হতে নির্ধারিত ১ শতাংশ সুদ হারে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা পাবে। আর গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হার হবে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ। এই সুদ হার চলমান গ্রাহক এবং নতুন গ্রাহক উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। শস্য ও ফসল খাত ছাড়া কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাতসমূহ (হর্টিকালচার অর্থাৎ মৌসুম ভিত্তিক ফুল ও ফল চাষ, মৎস্য চাষ, পোল্ট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাত)। তবে, কোনও একক খাতে ব্যাংকের অনুকূলে বরাদ্দকৃত ঋণের ৩০ শতাংশের বেশি ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। এছাড়া যেসব উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদিত কৃষিপণ্য ক্রয় করে সরাসরি বিক্রয় করে, তাদেরকেও এ স্কিমের আওতায় ঋণ বিতরণের জন্য বিবেচনা করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোনো উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে ৫ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিতে পারবে না। এছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের জন্য ১০০ কোটি টাকা, বীজের জন্য ১৫০ কোটি টাকা এবং কৃষকদের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা অর্থাৎ ধান কাটা ও মাড়াইয়ে মোট ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারী ছাড়া কোন ফলই আসবে না। আমাদের দেশে ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি বন্ধ না হলে, কর্মকর্তারা মানবিক ও আন্তরিক না হলে সকল প্রনোদনা ভেস্তে যাবে। সবাই যে অমানবিক বা লোভি তা কিন্তু নয়। সেটা হলে এধরনের প্রনোদনা আসতো না। উচ্চ পর্যায়ে এবং মাঠ পর্যায়ে অনেকেই, বলাযায় বেশিরভাগই আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করে। কিন্তু গুটিকয়েক মানুষের অমানবিক আচরন পুরো সিস্টেমকে ভেঙ্গে নষ্ট করে দেয়। আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগেই। পুরোপুরি না হলেও সুদূর অতীত থেকে আমরা এখন অনেক স্বাবলম্বী এটা নিঃসন্দেহে। আধুনিক এ যুগে আমাদের কৃষকরা বৈজ্ঞানীক পদ্ধতি ব্যবহার করতে শিখেছে। অনেক শিক্ষিত যুবক এখন কৃষিতে সম্পৃক্ত। আধুনিক ধ্যান ধারনা ও আবিস্কারের সঠিক ব্যবহার করে তারা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এই সংকটের সময় কৃষকরা যদি সঠিকভাবে সহযোগিতা পায় তাহলে আবার কোমড় খাড়া করে দাড়াতে পারবে। করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক যে ক্ষতি করে ফেলেছে তাতে এখন কেউ কারো কাছে হাতও পাততে পারবে না। সবারই এই এক সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। কে কাকে সহায়তা দিবে। নিজেদের সক্ষমতা থাকলেই কেবল দু’মুঠো খেয়ে বাঁচা যাবে। আর সেই খাবারের যোগানটা দেবে আমাদেরই কৃষক ভাইরা। সরকার যদি একটু সদয় হয় এবং নজর দেয় তবে আমাদের কারো কাছে হাত পাততে দিবে না দেশের কৃষি সৈনিকরা। সারা বিশ্বে এখন উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসলের আবাদে মনযোগী। যে জমিতে আগে একটি ফসল হতো সেখানে এখন একাধিক ফসল উৎপাদন করছে কৃষকরা। তাই কৃষিকেই সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে প্রনোদনা, ভর্তুকী যাই বলি না কেন সেটা দেয়া উচিত। আমরা বেইমানী করতে পারি, কিন্তু আমাদের কৃষকরা বেইমানী করতে পারে না। কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখা এখন তাই সময়ের দাবী। কৃষির জয় হোক, কৃষকের জয় হোক। কৃষি ও কৃষকের জয় হলে একটি মানুষও আমাদের দেশে না খেয়ে মরবে না, এটা শত ভাগ নিশ্চিত। কর্তা ব্যক্তিরা একটু ভেবে দেখবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:৫৮