ইংল্যান্ডের শীতের রাত অনেক লম্বা হয়। দিন বলতে কিছুই নেই। শীতকাল যেন আঁধার করা রঙহীন নরক বাস । শরতের হলুদ স্বর্গ থেকে শীতের কালো নরকে প্রবেশ করতেই বিষণ্ণ হয়ে আসে মন। প্রকৃতির সব রঙ গ্রাস করে ফেলে কুচক্রী কালো অন্ধকার। সেই ২০০৭ কি ৮ এর কথা, অন্ধকার ভোরে কাজের উদ্দেশ্যে বের হই আর ফিরে আসি সন্ধ্যা নামারও কিছু পরে । তিন চার মাস তাই এরকম আঁধারময় থাকে জীবন। কল সেন্টারে কাজ করতাম তখন । ডিফল্ট কাস্টমারদের কাছ থেকে পয়সা আদায়ের উদ্দেশ্য ফোন দেয়া এবং সহজ শর্তে পয়সা আদায় করাই ছিলো প্রধান কাজ।কত যে গাল মন্দ শুনতে হতো ফোনে পয়সা আদায়ের তাগাদা দেয়ার ফলে।গালমন্দ শুনতে শুনতে চামড়া মোটা হয়ে গিয়েছিলো।কাজটি ছিলোও ভীষণ কষ্টের।নানান কষ্ট , বিপত্তি আর শূন্যতার নামই প্রবাস জীবন।
কাজ শেষে ভীষণ ক্লান্তি নিয়ে একদিন বাড়ি ফিরছি, লাম্বা ট্রাম জার্নি, তাই চোখের উপর বই মেলে পড়তে পড়তে জার্নি সময় পার করছি।ঐ দিন আমার কাজ ছিল দুপুর ১টা থেকে রাত নটা পর্যন্ত। উইমবল্ডন থেকে ট্রামে এল্মারস এন্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । জার্নি যত লম্বা হয় আমার আনন্দও তত বাড়ে , কারন বইটি লম্বা সময় ধরে পড়তে পারবো, কোন প্রকার বাঁধা ছাড়া ।তো যাচ্ছি বই পড়তে পড়তে।৪৫ মিনিট পর ওয়েস্ট ক্রয়েডন এসে ট্রাম চেঞ্জ করলাম, হাতের বইটি চোখের নিচেই মেলা ছিল। ৭ কি ৮ নাম্বার স্টেশনে এসে দেখি আমি ভুল ট্রামে উঠে পড়েছি। নামার চেষ্টা করতে না করতেই ট্রামের দরজা লেগে গেলো এবং ট্রাম ছুটে চলছে বেকেনহাম জংশনের উদ্দেশ্যে। পরের স্টপে নেমে পড়লাম, এবং ফিরতি ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।ফিরতি ট্রাম আসতে আধা ঘণ্টা লাগবে। ততক্ষণ আমাকে এখানেই বসে থাকতে হবে। আরও একজন লোক নেমেছিল ঐ স্টেশনে । সরু একটি রাস্তার মত দেখা যাচ্ছে জংগলের ভিতর দিয়ে।সেই লোকটি সেটা ধরে কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়েব হয়ে গেলো। আমি একা ঐ শুনশান ষ্টেশনে। স্টেশনের ল্যাম্পস্টের আলোতে বেশিক্ষণ বই পড়তে গেলে চোখ ব্যথা করে, বেশ ক্ষীণ আলো।তাই বই পড়া বন্ধ।
এলোপাথারি শীতল বাতাস বইছে আর সেই বাতাসে পাতাদের উড়াউড়ির করুন সিম্ফনি শীতকালকে আরও আলাদা করে তোলে, যেন শীতকালীন শীতল সংগীত হচ্ছে।পাতাদের কড়কড়ে হাইডেফিনেশন শব্দ কানের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে মাথায় গিয়ে লাগছে। প্রায় দশ মিনিট পর আকাশের মেঘগুলো সরে যেতেই বেশ বড় একটি চাঁদ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।ভাবছি প্রকৃতি কেমন করে সহ্য করে এই অপার শূন্যতা, তার তো কেউ নেই। প্রকৃতির এই মহা শূন্যতার কাছে নিজের শূন্যতাকে ভীষণ ক্ষুদ্র মনে হয়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে গুণ গুণ করে গান গাচ্ছি, "I see the moon and moon sees me, god bless the moon and god bless me."
চন্দ্রের আগমনে জায়গাটিতে বেশ ভুতুড়ে ভুতুড়ে ভাব এসে পরেছিল। পাতলা পাতলা মেঘ মাঝে মাঝে চাঁদকে আড়াল করে উড়ে যাচ্ছে। একদম পারফেক্ট spooky moon ,যেমনটি ভুতের সিনেমায় থাকে। আমি এমনিতে বেশ সাহসী, ভুত প্রেতের ভয় নেই।আর ভুত প্রেতে বিশ্বাসও নেই । তো গান চলছে গুণগুণীয়ে, একটু এপাশ ওপাশ ঘুরতেই দেখি সারিবাঁধা সাদা সাদা কি যেন দেখা যাচ্ছে। ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি tombstone অর্থাৎ সমাধিপ্রস্তর । স্টেশনের পিছনেই বড় একটি কবরস্থান। আমি ১০ মিনিট ধরে টেরই পাইনি। আরও কুড়ি মিনিট পরে ট্রাম আসবে। কবরস্থান থেকে চোখ সরিয়ে আবার গান গাচ্ছি। হঠাতই টের পাচ্ছি যে ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত আমার শরীরে প্রবেশ করে আমাকে কঠিন বরফের মূর্তি বানিয়ে ফেলেছে। ১০টা বেজে ২০ মিনিটে হাসবেন্ডের ফোন এলো। জ্যাকেটের পকেট থেকে ফোন বের করতে পারছিলাম না। ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর ফোনটি বের করে হাতে নিতে না নিতেই আবার ফোন। ফোনটা রিসিভ করতে পারছিলাম না জমে যাওয়া আঙুল দিয়ে। এক পর্যায়ে ফোনটা নিচে পরে গিয়ে স্ক্রিন ফেটে গেলো।তারপর আর ফোন করতে পারছিলাম না।এরপর দেখি সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ট্রাম আর আসে না।কনট্রোলরুমে কথা বলার জন্য একটি স্পিকার রয়েছে প্রতিটি ট্রাম স্টেশনে। সেখানে গিয়ে কথা বললাম যে কখন আসবে ট্রাম , তারা জানালো আরও দশ মিনিট লাগবে, কি যেন একটু সমস্যা হয়েছে । দশ মিনিট আর যায় না। দশ মিনিট যেন দশ ঘণ্টার চেয়েও বেশী দীর্ঘ মনে হচ্ছিল।
এরপর ১০টা বেজে ৪০ মিনিটে ট্রাম আসলো। ট্রামে উঠে নিজেকে এমন ভারি ভারি লাগছে যেন দশ কেজি ওজন বেড়ে গেছে। শ্বাস প্রশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।বাসায় এসে গরম গরম গোসল নিলাম। বেশ হালকা লাগছে। গভীর একটি ঘুম হলো সেই রাতে।
পরের দিন সকালে উঠে আবার নিজেকে ভারি লাগছে। শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। ঐ দিন কাজে আর যাওয়া হলো না। এভাবে বেশ কিছু দিন চলল। ডাক্তার দেখানো হলো, কিন্তু কিছুই সমস্যা নেই।
আস্তে আস্তে একটি ব্যপার টের পেলাম যে যখনই গোসলে যাই তখনই বেশ ভালো থাকি। তাই একদিন অনেকক্ষণ ধরে বাথটাবে পানি জমিয়ে বসে ছিলাম। কে যেন কানের কাছে ফিশ ফিশ করে বলে উঠলো, আর কতক্ষণ গোসল করবে? আমিও আনমনে উত্তর দিলাম, এই তো এখনই উঠে যাবো। বলেই হক চকিয়ে এদিক অদিক তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। প্রশ্ন করলাম,
- কে , কে কথা বলে?
কোন উত্তর নেই। তারপর আমি আরও কিছুক্ষণ বথাটাবে বসে ছিলাম। তারপর কে যেন আবার বলছে,
- আমার খুব ঠাণ্ডা লাগছে।
কোথাও কেউ নেই। শুধু থর থর করে কাঁপুনির শব্দ পাচ্ছি। আবার বলে উঠলো,
- তুমি বেশিক্ষণ পানিতে থাকলে আমি মরে যাবো, আমি তোমার উপকারই করবো, আমাকে বাঁচাও।
নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম স্বপ্নের ভিতর আছি কিনা, কিন্তু না , আমি জেগেই আছি। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
- কি উপকার করবে শুনি?
সে বলল,
- আমি যতদিন তোমার সাথে থাকবো , তোমার সুদিন থাকবে বেশী।
কথাটি বিশ্বাস হলো না , তবে ভেতর থেকে একটু আশ্বাস পেলাম, আর সুদিনের আশায় কেমন যেন একটি লোভে পরে গেলাম।মনে মনে ভাবছিলাম স্প্লিট পারসোনালিটি রোগে ভুগছি না তো! বিশ্বাস হচ্ছিলো না তারপরও মনে হচ্ছিলো সেদিন ঐ ষ্টেশন থেকে হয়তো এক অচেনা ভুতের অস্তিত্ব বহন করে এনেছি যে আমাকে উপকার করতে চায় । বিনিময়ে উষ্ণ আরামদায়ক একটি পরিবেশ চায়, শীতের কাঁপুনি থেকে বাঁচতে চায়। আমি যখনই গোসলে যাই সে তখনই আমার শরীর থেকে বের হয়ে দূরে সরে থাকে । আর শরীরের তাপ বেশিক্ষণ না পেলেই সে থর থর করে কাঁপে। কিন্তু আমি তো তাকে আমার শরীরে জায়গা দিয়ে আমাকে অসুস্থ বানিয়ে রাখতে চাই না। তাই সেই ভুতকে আমার অতি প্রিয় একটি বেলজারে রেখে ফেইরি লাইটের আলোয় উষ্ণ করে রেখেছি।সে সেখানে দিব্যি থাকে। ঘরের কেউ জানে না সেই বেলজার ভুতের খবর।বেলজার ভুতের কড়া নির্দেশ কেউ যেন না জানে ওর খবর, তাহলেই সব যাদু শেষ হয়ে যাবে।
জীবন আমার সুদিন আর সুবাতাসে পরিপূর্ণ এখন।মানসিক রোগে ভুগছি কিনা তাও জানি না। আর জানার প্রয়োজনই বা কি, বেশ তো কেটে যাচ্ছে দিন। বেলজার ভূত বলেছিলো সে বেশী দিন এক জায়গায় থাকে না, কিন্তু আমার সাথে আছে বেশ অনেক বছর।দিয়েছে অনেক, নিয়েছে খুবই অল্প । মাঝে মাঝেই ভয় হয় কবে যেন বেলজার ভূত চির বিদায় নেয় -
ছবিঃ গুগোল ইমেজ
** ছোট একটি অভিজ্ঞতাকে গল্পে রঙ দিলাম
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৫:৪৮