মানুষের জানার আগ্রহ সেই আদি কাল থেকেই । অজানাকে আবিষ্কার অথবা অজানার অনুসন্ধান মানুষ সর্বকালেই করেছে । একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ কোয়ান্টাম মেকানিক্স , ডার্ক ম্যাটার , ম্যাজিক থিওরি , এক্সট্রা ডাইমেনশন , মাল্টিভারস ছাড়াও আরো অনেক কিছু বোঝার এবং জানার চেষ্টা করে , মূল্যনিরূপক বোঝার চেষ্টা করে নতুন কোন চিত্রকর্মকে , আমরা একে অপরকে বোঝর এবং জানার চেষ্টা করি , আবার কখনো কখনো সম্পূর্ণ রূপে বুঝেছি অথবা জেনেছি বলে দাবীও করি । কিন্তু আসলেই কি আমরা সম্পূর্ণ রূপে কোন কিছু বুঝতে পারি বা জানতে পারি ? তারপরও এই অজানার পেছনে মানুষ ছুটে চলেছে এর শেষ দেখবে বলে । মনে প্রশ্ন জাগে , এর শেষ কি আদৌ আছে ? হয়তো আছে হয়তো নেই ।
বেশ কিছুদিন ধরে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন আর এর রহস্য মাথায় জেঁকে বসেছে , এ নিয়েই ভাবছি অনেক কিছু । মৃত্যু মানব জীবনের অনিবার্য একটি ঘটনা , এখান থেকে কারো নিস্তার নেই । অনেক অনেক মিথ এবং অনেক যৌক্তিক ও অযৌক্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে মৃত্যুকে ঘিরে , তারপরও মনে অনেক প্রশ্ন জাগে - কি হয় মৃত্যুর পরে ? কেমন হয় মৃত্যুর ঠিক পরবর্তী অভিজ্ঞতাটা ? মৃত্যু হলো সবচেয়ে বড় রহস্য এই সৃষ্টি জগতের । তাইতো , এই অজানা বিষয়টি নিয়ে ভাবনার জায়গা তৈরি হয় মনের ভেতর , আর তখনই মানুষ এর বিভিন্নমুখী ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে যার যার চিন্তা-চেতনা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে । কেউ কেউ বলে মৃত্যু হোল পরিবর্তন - এক জীবন থেকে আরেক জীবনে রূপান্তর , যেমন শুঁয়োপোকার জীবন শেষ হয়ে প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয় । শুঁয়োপোকাটি হয়তো জানেই না সে একসময় প্রজাপতিতে রূপ নেবে , আবার একটু ঘুরিয়ে যদি বলি , প্রজাপতিটির হয়তো মনেই নেই সে একসময় অন্য কিছু ছিল । তবে কি এটাই সত্য যে সব স্মৃতি মুছে দিয়ে আবার নতুন ভাবে নতুন রূপে ব্যাবহার হচ্ছে একই আত্মা বারে বারে , নানান সময় নানান রূপে । এভাবেই বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা রয়েছে ব্যক্তি বিশেষে এবং নানান প্রকার বিশ্বাস অনুযায়ী । আবার কেউ কেউ ভাবে আত্মা বলতে কিছুই নেই , মৃত্যুতেই সমাপ্তি একটি জীবনের অথবা আত্মার । কিন্তু কৌতূহলী মন কোন কিছুতেই যেন তুষ্ট নয় , ছুঁয়ে দেখতে চায় অভিজ্ঞতার আলোকে এবং উপলব্ধি করে কৌতূহলের আগুন নেভাতে চায় ।
এটা সবসময়ই লক্ষণীয় যে বিজ্ঞান একটি সুনির্দিষ্ট অথবা অনেকটাই গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে । মৃত্যুর ব্যপারে বিজ্ঞান বলে জীবনের মতো মৃত্যুও একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যায় , এর কয়েকটি স্তর রয়েছে - প্রথম স্তরকে বলা হয় ক্লিনিকাল ডেথ । এই প্রথম স্তরটি শুরু হয় শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার ঠিক চার থেকে ছয় মিনিট পর । ঐ সময়টাতেও অনেকটা অক্সিজেন জমা থাকে মানুষের মস্তিষ্কে , যার ফলে তখনও মস্তিষ্ক পুরপুরি এর কার্যকারিতা হারায় না অর্থাৎ মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক সিস্টেম ক্লিনিকালি মৃত্যু ঘোষণা করার পরও সচল থাকে । তার মানে মানুষ ঐ সময়গুলোতে উপলব্ধি করতে পারে পারিপার্শ্বিকতা , অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চালিকা শক্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকাশ করার ক্ষমতা হারায় । যদিও ক্ষেত্র বিশেষে এর ভিন্নতা দেখা যায় । অর্থাৎ কেউ কেউ উপলব্ধি করতে পারে আবার কেউ কেউ পারে না । সাধারণত মানুষ ক্লিনিক্যাল মৃত্যু অবস্থা থেকে পুনরায় জীবিত অবস্থায় ফেরত এসে কিছুই মনে রাখতে পারে না , তাদের জীবন থেকে ঐ সময় গুলো চিরতরে হারিয়ে যায় ।
দ্বিতীয় স্তরটি হলো বায়লজিকাল ডেথ - এই স্তরে মানুষের হৃৎপিণ্ডের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় , সমস্ত শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের ক্রিয়া কর্মও সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ হয়ে যায় । তারপর মানুষের দেহকোষ গুলো ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করে এবং চূড়ান্ত ভাবে মানুষকে মৃত হিসেবে ঘোষণা করা হয় । এখন কথা হলো এই ক্লিনিক্যাল এবং বায়োলজিক্যাল মৃত্যু স্তর এর পরবর্তী স্তরটি কি ? আসলেই কি মৃত্যুর পরবর্তী জীবন বলে কিছু আছে ? ধর্মগ্রন্থ গুলোতে এর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে , কিন্তু কৌতূহলী এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা সবসময়ই প্রমাণ চায় । বিজ্ঞান সন্দেহের চোখে তাকাবেই , আর একারনেই আমরা নতুন নতুন আবিষ্কারের উপর ভর করে আধুনিক জীবনের পথে হেঁটে চলেছি ।
মৃত্যুর এই অজানা স্তরটি সম্পর্কে সর্বজন গ্রাহী সুস্পষ্ট কোন সাইন্টিফিক ব্যাখ্যা নেই , যার ফলে ভিন্ন ভিন্ন মতপার্থক্য রয়েছে এবং বিশ্বাস - অবিশ্বাস রয়েছে । বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের " প্রায় মৃত্যু" অভিজ্ঞতাকে গবেষণা করে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছে যে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে । যাদের " প্রায় মৃত্যুর" অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা প্রায়ই একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলে থাকে , যেমন প্রায় সকলেই বলে থাকে যে তারা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া অনুভব করেছে , তারা দেখেছে যে দ্রুতগামী একটি টানেলের ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে অসীম একটি আলোর দিকে , কখনো কখনো তারা দাবী করে যে তারা তাদের মৃত আত্মীয় স্বজনের সাথে ছিল অনেকটা সময় । যদিও কোন কোন বিজ্ঞানী এই অবস্থাকে বলে - এক ধরনের " লুছিড ড্রিম" অথবা মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে এই ধরনের অনুভূতি হতে পারে । তারা কিন্তু সবাই একটা সম্ভাবনার কথা বলেছেন । নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারেননি । তার মানে হলো এই " প্রায় মৃত্যু " অভিজ্ঞতাটা একটা রহস্যের মধ্যেই রয়ে গেলো ।
ওয়ার্ম হোল
আসলেই কি আত্মা শরীর থেকে আলাদা হয়ে অন্য কোন জগতে ধাবিত হয় বলেই এরকম অসীম আলো দেখতে পায় মানুষ এই " প্রায় মৃত্যু" অথবা ট্রাঞ্জিশনের সময় ? হতে পারে মানব আত্মা শরীর থেকে আলাদা হয়ে " ওয়ার্ম হোল" দিয়ে যাত্রা শুরু করে অন্য কোন জগতের দিকে ছুটে চলে , হতে পারে তৃতীয় মাত্রা থেকে চতুর্থ মাত্রায় প্রবেশের রাস্তা হিসেবে এই " ওয়ার্ম হোল" ব্যবহৃত হয় । সবই অনুমান , এর একটাও ফিজিক্যালি কোয়ানটিফাই করা সম্ভব না , আবার একে ভুল প্রমাণ করাও সম্ভব হয়নি এখন পর্যন্ত । আমরা মানুষেরা কতটা অসহায় অথবা কতটা ক্ষুদ্র আমাদের ক্ষমতা যে আমারা আমারদের শুরুর কথাই প্রমাণ করতে পারি না এবং আমাদের গন্তব্যসম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট কোন ধারনা নেই ।
শর্ট কাট যাত্রা এক বিশ্ব থেকে অন্য বিশ্বে ওয়ার্ম হোলের মাধ্যমে ।
তবে আত্মা এবং শরীর যে আলাদা কিছু এটা কিছুটা হলেও প্রমাণিত , কারন মানুষ এখন মানুষের চেতনাকে আবার কেউ কেউ বলছে আত্মাকে আপলোড করতে সক্ষম হবে সুপার কাম্পিউটারে , যেটাকে অনেকে দাবী করছে মানুষের অমরত্ব হিসেবে । কতটুকু সম্ভব এটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে । এই চেতনা আপলোডের জন্য প্রয়োজন হবে মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন গুলো এবং এর নেটওয়ার্ক সিস্টেমটা কিভাবে ওয়ার্ক করে এবিষয়ে গভীর জ্ঞানের , কারন মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া কর্ম সম্পর্কে মানুষ এখনো পর্যন্ত সুস্পষ্ট ধারনা অর্জন করতে পারেনি ।
এরিজোনা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর স্টিউয়ারট হেমেরফ মানুষের চেতনাকে কাম্পিউটারে আপলোড করার ব্যপারে যথেষ্ট আগ্রহী এবং এটা সম্ভবপর বলেও মনে করেন । তিনি মনে করেন মানুষের আত্মা চিরন্তন এবং শরীর থেকে আলাদা কিছু যেটা মানুষের মস্তিষ্ক নামক যন্ত্রে প্রাকৃতিক ভাবে আপলোড করা হয়েছে , অতএব এর মেকানিজম বুঝতে পারলে একে কৃত্রিম ভাবেও সুপার কাম্পিউটারে আপলোড করা সম্ভব মানুষের পক্ষে । অপরদিকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর সার রজার পেন্রজ কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন যে মানুষের চেতনা হয়তো রেপ্লিকেট করা সম্ভব কিন্তু আত্মা রেপ্লিকেট শুধুমাত্র প্রাকৃতিক উপায়েই সম্ভব অর্থাৎ তিনি সম্ভবত বলতে চেয়েছেন ওটি শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার দ্বারাই সম্ভব ।যদিও তিনি পরবর্তীতে ডক্টর হেমেরফ এর আইডিয়াতে সম্ভবপর বলেও সম্মতি দিয়েছেন ।
আমি বেক্তিগত ভাবে মনে করি আত্মা চিরন্তন এবং এটি কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা সম্ভব নয় , এটা সম্পূর্ণ ভাবেই সৃষ্টিকর্তার নিজস্ব এলাকা ।
পরবর্তী পর্ব আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স এবং মানুষের অমরত্ব নিয়ে থাকবে ।
কৃতজ্ঞতা ঃ
লাইফ সাইন্স
দা ডেইলি টেলিগ্রাফ
মৃত্যুর পরের জীবন
https://www.youtube.com/watch?v=R5DqX9vDcOM
https://www.youtube.com/watch?v=3WXTX0IUaOg
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০০