ভীনবাসী ডায়েরী
।। এক।।
রাত ৩টা, ১২ই মে ২০০৭, জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ঢাকা। প্রায় শ’দুয়েক মানুষের লম্বা ইমিগ্রেশন সারিতে দাঁড়িয়ে। এয়ারপোর্টের বিশালাকার কাঁচের ওপারে আমার গর্ভধারিণী, উৎকন্ঠা ও জীবনে প্রথমবারের জন্য নিজ সন্তানের বিচ্ছেদে ভারাক্রান্ত, আর আমি সেই লম্বা সারির নানাবিধ লোকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে নিতে চাইছি, ঠিক তিনদিন আগে আমার-ই মতো আর কেউ দশ পয়সা দামের বিড়ির অর্থেক খেয়ে বাকি অর্ধেক পকেটে ঢুকিয়ে রেখে এই সারিতে এসে দাঁড়িয়েছে কিনা? অনেক খুঁজে খুঁজে না পেয়ে যখন একটু পেছন ফিরেছি, ঠিক তখনই গোলাম মাওলা নামের আমার সহযাত্রীটি আমার কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে, ক্ষীণ স্বরে, ‘ভাই, আমি তো কুনোদিন পেলেনে চড়িনি, কিচ্ছু জানিন্যা, আপনে আমাক দেহা দেহা লিয়ে যায়েন’! উনার কথাগুলো শেষ হবার সাথে সাথেই কী যেন মনে পড়ে গেল, এবং ঘাঁড় ঘুরিয়ে কাঁচের ওপারে কিছুক্ষণ আগে ছেড়ে আসা জননীর কান্না ভেজা মুখটা খুঁজে পেতে চাইলাম, কিন্তু পেলাম না! ভয়ানক এক কষ্ট আমাকে গ্রাস করতে শুর করলে আমি পুনরায় সেই লম্বা সারির লোকজনের মুখগুলো দেখতে থাকলাম, আর মনে মনে নিজেকে বললাম, ‘আরে তুমি তো বাঙাল, তোমার পকেটে না সবুজ রংয়ের পাসপোর্ট?‘
ঘন্টা দু’য়েক লাইনে, এক ঘন্টা বোর্ডিং পাস এবং আরও একঘন্টা চেয়ারে ঘুম-আধঘুমে কাটিয়ে সকাল ৬টায় গালফ এয়ারলাইন্সের পেটের ভেতরে ঢুকে দেখি, মাওলা ভাই, আমিসহ আরও শ’খানেক বাঙালী যে যার সিট দখল করার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে, যেনবা প্লেন নয়, বিয়ে বাড়ি, এই চাড়ে না বসতে পারলে আর খানা ফুরিয়ে গেলে? তাছাড়া শংকা এও, প্লেনে তো চড়েছি, কিন্তু সিট না পেলে, ট্রেন-বাসের মতো এতটা পথ যদি সত্যি সত্যিই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিয়ে যায়? আর এত লোক, সিটে কি কুলাবে? হঠাৎ দেখি আমিও হুড়োহুড়ি করছি, যা কিনা আসলে হুড়োহুড়ির মধ্যে পড়ে যাওয়া। পরে কেন জানি মনে হল, ভয় কি আমারও ছিল না মনে? সত্যিই কি আমি নিজেও হুড়োহুড়ি করিনি? এতসব ভাবনা ভাববার অবকাশ না দিয়েই পরবর্তী ১০ মিনিটের মধ্যেই প্লেন নামক বিশাল পাখিটি বিকট আওয়াজ করে আমাদের নিয়ে উড়ে এল আকাশে। আকাশের স্বপ্ন কে না দেখে, কিন্তু, সেখানে রোদও যে খুব কাছাকাছি চলে আসে সেটা হয়ত অনেকেই ভুলে যায়! ভুলে যায় এও, যে কোনো উচ্চতার জন্য চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হয় সবাইকেই।
বিমানবালাদের নিয়ে কোনোদিনই আমার কোনো কৌতুহল ছিল না, কারণ, পনের বছর বয়সে নিজের পছন্দের প্যান্টখানা পুড়িয়ে, তাড়াহুড়োয় জীবনে প্রথমবার বাংলাদেশ বিমানে চড়ে ব্রণের কারুকার্যময় যে বিমানবালার মুখ আমি দেখেছিলাম, তাতে আমি এখনও বিশ্বাস করি সেলিমের মা-ই ভাল, শৈশব তো শৈশব, এই ভরা যৌবনেও আমি অনায়াসে তার প্রেমে পড়তে পারি। পারি এখনও তার পান খাওয়া ঠোঁট দুটোর কথা মনে করে শিহরিত হতে, কিংবা লজ্জায় লাল হয়ে উঠতে তার হঠাৎ বলে ফেলা, ‘কী রে মরদ, আমার ভাতার হবি‘-শব্দগুলোর স্মরণে।
নিরীহ মানুষদের আমি ভালবাসি, এবং একটা সময় পর প্রচন্ড রকমের ভয় পাই। আমার সঙ্গীটি, গোলাম মাওলা, তাকে ভয় পাবার মতো কারণ তখনও ঘটেনি, বরং সে সাথে ছিল বলেই আমি হয়ত রোদের কাছাকাছি এসেছি, নিজের সবুজ, নিজের আপন থেকে দুরে, বহুদুরে সরে যাচ্ছি, এইসব বোধ কাজ করছিল না, ফলে বিমানবালারা কানাকানির যন্ত্র দিয়ে গেলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজেরটা নিলাম, আর আমার দেখাদেখি মাওলা ভাইও নিতে গেলে বেশ শান্ত স্বরেই বললাম, ‘হারায় গেলে কিন্তু ত্রিশ ডলার মাওলা ভাই‘! কথাগুলো শুনে উনি ঠিক কী বুঝল জানি না, শুধু আমার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে যখন পুনরায় কানাকানির যন্ত্রটির দিকে তাকাল, তখন আমি নিজের যন্ত্রটি কানে লাগাতে লাগাতে মাথা নিচু রেখেই ডলারের বাংলা করে বললাম, ‘দু’হাজার‘। হ্যাঁ, বাংলা আমিও বুঝি সেও বোঝে, বাংলাদেশের ষোল-সতের কোটি মানুষও বোঝে, কিন্তু আমরা কেউ-ই বুঝি না আমাদের পাসপোর্টের রং সবুজ, আর সেটা দিনের দিন এত সবুজ হয়ে যাচ্ছে যে, বুক পকেটে নিয়ে যেখানে-সেখানে বেরুনো যায় না, লোকে দেখে ফেলে, লজ্জা লাগে বা দেয়!
বেচারা ওটা কানে দিত কি দিত না জানি না, তবে আমাকে জিজ্ঞেস করা ছোট্ট একটা প্রশ্নের উত্তরে আমার হ্যাঁ পেয়ে, যন্ত্রটা হাতের মধ্যে এমনভাবে মুঠো করে ধরে বসে থাকল যে, উনি হারিয়ে গেলেও, ঐ দু‘হাজার মূল্যমানের যন্ত্রটি এই জীবনে উনার কাছ থেকে কিছুতেই হারাবে না, আর আমি ওসব লক্ষ্য না করে ততক্ষণে কানের উপরে যন্ত্রটা লাগিয়ে পছন্দের গান খুঁজে নিয়ে চোখ বুজে ফেলেছি। হয়ত মাওলা ভাই আমাকে মনে মনে গালি দিচ্ছিল, কিংবা ভাবছিল, কতই না পাষাণ টাইপের লোক আমি, যার উপর ভরসা করে সেই ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে সাথে সাথে আসা, সেই কিনা প্লেনে উঠেই সাথ ছেড়ে দিল, আর আমি মনে মনে বললাম, এ তো সবে শুরু ভায়া, সামনে আরও দিন আসছে, তখন কে কাকে চেনে আর কে যে কাকে চেনে না, সেটা বুঝে ওঠাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে, সুতরাং এখন থেকেই শুরু হয়ে যাক।
প্রায় পাঁচ ঘন্টার ভ্রমণে বেচারা আমার সাথে তেমন কোন কথাই বলেনি, শুধু ঘন্টা দেড়েক পর বিমান বালারা খাদ্যসামগ্রী নিয়ে উনার কাছে এসে কী লাগবে বা লাগবে না জিজ্ঞেস করতেই দেখি উনি একহাতে তখনও মাইক্রোফোন মুঠো করে ধরে রেখেছেন আর আরেক হাতে না না করে চলেছেন! হয়ত ভাবনা এই, এমনিতেই সেই প্রথমে না চাইতেই দু‘হাজারের এক আপদ ধরিয়ে দিয়ে গেছে, না জানি এর পরেরগুলো আরও কয় হাজার। আমি একটু হাসলাম এবং নিজের খাদ্যবস্তুগুলো বুঝে নিতে গিয়ে ভাবলাম, না, বেচারা সারাটা পথ না খেয়ে থাকবে, তাই বিমানবালাকে ডেকে উনার জন্যও একটা বার্গার দিতে বলে উনার কানের কাছে মুখ নিয়ে নীচু স্বরে বললাম, ‘ঠিক আছে আপনি খেয়ে নিন, এটার দাম আমিই দেব‘। উনি আমার মুখের দিকে বেশ কৃতজ্ঞ চিত্তেই তাকালেন, এবং আমি তাতে কিছুমাত্র আপ্লুত না হয়ে নিজের বার্গারে স্বচ্ছন্দে বারোটা দাঁত বসিয়ে দিলাম। বার্গারে দাঁত বসিয়ে দিয়েই দেখি বিমানবালা মাওলা ভাইয়ের বার্গার নিয়ে হাজির, যার বুকের দিকে চোখ পড়তেই মনে পড়ে গেল ‘জ্যামন জ্যামন‘ সিনেমার সেই দৃশ্যটির কথা, যেখানে পেনেলোপে ক্রুজ এর স্তন মুখে নিয়ে তার প্রেমিক খেলতে থাকলে সে তাকে আবেগ ভরে জিজ্ঞেস করছিল, যে তার কি ভাল লাগে স্তন মুখে নিতে? সেটার স্বাদ কেমন? সেদ্ধ আলুর মতো, নাকি হ্যাম বার্গারের মতো? আর প্রেমিক প্রতিউত্তরে স্তন মুখে নিয়েই জড়ানো স্বরে বলে চলেছিল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেদ্ধ আলুর মতো, হ্যাম বার্গারের মতো!
না, আমার সেই বোধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, অল্পক্ষণেই বিমানবালার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মাওলা ভাইয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে উনার কানে কানে বললাম, ‘কী দেখছিলেন অমন হা করে, নিজে মরবেন, শালা আমাকেও মারবেন দেখছি, কত হাজার ডলার জানেন‘? বেচারা একটু থতমত খেয়ে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হেসে দিল, এবং আমি নিজেও উনার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে তিনদিন আগে পকেটে রাখা আধখাওয়া বিড়িটাকে চাইলাম ভুলে যেতে, ভুলে যেতে চাইলাম আরও অনেক কিছুই, অথচ সবকিছুই কি আর চাইলেই ভোলা যায়, নাড়ী যেখানে পোতা সেখানের অমোঘ টান এক জীবনে কি কোনো ভনিতা দিয়েই চাপা দিতে পেরেছে মানুষ?
ক্রমশঃ..........
অরণ্য
দুবাই, মধ্যপ্রাচ্য