Grave of the Fireflies (1988) - Isao Takahata
আমার ধারণা ছিল, ওয়্যার জেনর এ সবচেয়ে ভাল মুভি বানিয়েছে কোরিয়ানরা, কেন না ব্রাদারহুড অব ওয়্যার (২০০৪), ওয়েলকাম টু ডংমাগুল (২০০৫), জয়েন্ট সিকিউরিটি এরিয়া (২০০০), দ্য ফ্রন্ট লাইন (২০১১), এ লিটল পন্ড (২০০৯), মাই ওয়ে (২০১১) কিংবা ৭১: ইন টু দ্য ফায়ার (২০১০)-এই সব অসাধারণ সিনেমাগুলো গতানুগতিক ধারার যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা নির্মাণের প্রেক্ষাপটকে বদলে দিয়ে এমন এক দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, মযেভাবে অন্তত আগে দেখেনি। বিশেষ করে ‘ওয়েলকাম টু ডংমাগুল’ সিনেমাটি বহুদিন পর্যন্ত যুদ্ধ-বিরোধী স্লোগানের স্বপক্ষে এমন এক উদাহরণ হয়ে থাকবে যে, মানুষ অনায়াসেই সুন্দরতম মানবিক অবস্থান থেকে যুদ্ধকে দেখার বা অনুধাবণ করার প্রয়াস পাবে। ফলে এই জেনরের সিনেমারগুলোর জন্য কোরিয়ানদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও দুর্বলতা দুটোই ছিল সীমাহীন, কিন্তু, সব কিছুকেই যেন নিমিষে ফিকে করে দিলেন ইছাও টাকাহাতা তার অনবদ্য এই এ্যানিমেশন সিনেমাটি দিয়ে, এবং নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, ওয়্যার জেনর এ ‘গ্রেভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইজ’ (জাপানী নাম ‘হোতারু নো হাকা’) এখন অব্দি বিশ্ব-সিনেমার সবচেয়ে সুন্দর ও শক্তিশালী সিনেমাগুলোর অন্যতম।
এই সিনেমাটি দেখার আগ পর্যন্ত কোরিয়ান যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল, কারণ তারা গতানুগতিক যুদ্ধ বিভীষিকা থেকে আমাদের টেনে-হিচড়ে বের করে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল চিরকাম্য মানবিকতার সামনে, যেখানে যুদ্ধ তার স্বরুপে উপস্থাপিত হলেও, মানব হৃদয়ে এর প্রতিক্রিয়া ও অনুভব ছিল ভিন্ন এবং মহোত্তর, যা সত্যিকার অর্থেই আমাদের জন্য জরুরী ছিল, আর এই অতীব জরুরী কাজটি সুচারুভাবেই সম্পন্ন করেছেন কোরিয়ান পরিচালকরা। কিন্তু, এই সিনেমাটি দেখার পর আমি বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম, এবং পরবর্তী কয়েকদিন, এমন কী এখন পর্যন্ত যখনই সিনেমাটির কথা স্মরণ হয়, একদিকে যেমন বিমূঢ় ও কষ্ট বোধ করি, তেমনি মনে প্রাণে ঘৃণা করি যুদ্ধ নামক বিভীষিকাময় বাস্তবতাকে, আর মানুষের প্রাণে দারুণ এই ব্যাপারটির উসকে দেবার প্রবণতাই সিনেমাটিকে এমন এক শিখরে পৌঁছে দিয়েছে যে, এর জন্য যে কোনো প্রশংসাই কম পড়ে। অসংখ্য ধন্যবাদ পরিচালক তাকাহাতা আপনাকে, এমন একটি অনবদ্য সিনেমা আমাদের উপহার দেবার জন্য, বিশেষ করে আমাদের শিশুদের জন্য আপনার এই সিনেমা বহুযুগ ধরে আদর্শ পাঠ হয়ে শিক্ষাদান করবে মানবিকতার, এবং যুদ্ধের বিপরীতে নিজেদের মানসিক অবস্থান সুদৃঢ় করার শক্তি যোগাবে।
এ ছাড়াও ধন্যবাদ জানাই সিনেমার কাহিনীকার আকিউকী নোসাকাকেও, যার লিখিত ‘গ্রেভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইস’ নামক আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস হতে মুভিটির কাহিনী নেয়া হয়েছে। হয়ত এখানেই সিনেমাটির সবচেয়ে নিগুঢ় ও করুণতম বাস্তবতা লুকিয়ে, যেখানে কাহিনীকার নিজেই ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বেঁচে যাওয়া একমাত্র মানুষ,আর তার ছোট বোনটিও মারা যায় সিনেমার সিতসকোর মতই, অনাহারে।আকিউকী আজীবন আত্ম দহনে পুড়েছেন এই নির্মমতম বাস্তবতার কারণে, কেন না যুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় সময়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রাপ্ত খাবার সবসময় নিজেই প্রথমে খেতেন,পরে দিতেন বোনকে। ব্যাপারটি তাকে আজীবন তাড়া করে ফিরেছে অভিশাপের মতো, এবং নিজের আত্মগ্লানি থেকে মুক্তির জন্যই হয়ত উপন্যাসটি লিখেছিলেন, আর যখন সেই করুণতম কাহিনীকে চলচ্চিত্রে রূপদান করলেন, তখন স্বভাবতই তিনি নিজেকে জীবিত দেখতে চাননি, আর আমরা তারই অবস্থান থেকে দেখলাম এমন এক করুণ ও নির্মম যুদ্ধ বাস্তবতাকে, যা আমাদের একদিকে স্তব্ধ ও বিমূঢ় করে দিল যেমন, তেমনি দারুণ অপরাধ বোধ নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল নিজের সামনে। আহা, হৃদয়ের এত গভীরে আর কোন সিনেমা এমন সুতীব্র মানবিক প্রতিক্রিয়ার ঝড় তুলতে সক্ষম হয়েছে, পূর্বে।
বস্তুত, এমন সিনেমা আমাদের তথা মানব সমাজের জন্য অনেক বেশি সংখ্যায় জরুরী ছিল, যখন আমরা পৃথিবীকে যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে ঠেলে দিয়ে বাসের অযোগ্য করে তোলার মরিয়া প্রয়াসে লিপ্ত, তখন এই সিনেমাটি মানুষেরই সৃষ্ট কুৎসিততম অবস্থার মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এমন এক চির-মানবিক সংগীত গাইতে থাকে, যা কানে পৌঁছানো মাত্র যত কঠিন হৃদয়ের মানুষই হোক না কেন, বিগলিত হতে বাধ্য, আর তাই বিশ্বজুড়ে সিনেমাটির শত শত রিভিউকারীর মতো আমিও বলতে বাধ্য হচ্ছি, ‘এটা সেই সেরা ও উৎকৃষ্টতম সিনেমাগুলোর একটি, যা আপনি দ্বিতীয়বার দেখতে চাইবেন না, অথচ এটা আপনাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে আজীবন, আর যতক্ষণ আপনি এর সামনে বসে থাকবেন মাঝে-মধ্যেই অশ্রু সংবরণ করার জন্য নিজের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হবে,অথচ আপনি পরাজিত হতে বাধ্য হবেন, শেষ পর্যন্ত’। মূলতঃ, সিনেমাটি দেখার পর আমার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল, তা বাংলাদেশের প্রাইমারী ও হাইস্কুল লেভেলের সমস্ত বাচ্চাদের দেখানোর, কারণ, এই ধরনের সিনেমা শিশু প্রাণে যে গভীর প্রতিক্রিয়া তৈরী করতে সক্ষম, তা আমাদের তথা মানব সভ্যতার জন্য খুব জরুরী।
সিনেমার কাহিনীতে চৌদ্দ বছর বয়সি ‘সেইতা’ ও চার বছর বয়সি ‘সেতসকো’ নামের দুই ভাই-বোনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নির্মমতায় বেঁচে থাকার আপ্রাণ লড়াই ও করুণ পরিণতি দেখানো হয়েছে। খুব বেশি চরিত্রের সমাবেশ নেই সিনেমাটিতে, সব মিলিয়ে ৪/৫টি চরিত্র, যারা অল্প সময়ের জন্য সামনে এলেও, পুরো সিনেমা জুড়ে কেবল দুই ভাই-বোনের অসাধারণ মানবীয় সম্পর্কের যাবতীয় ও বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সংগ্রাম দেখানো হয়েছে, যেখানে একদিকে অসামান্য সব দৃশ্যাবলী আপনাকে মুগ্ধ করবে যেমন, অপরদিকে করুণতম বাস্তবতা করবে বিমূঢ়, সেই সাথে প্রাণহীন চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা অসাধারণ মানবিক আবেদন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারিত্রিক ডিটেলস, যা খুব সুচারুভাবে তুলে আনা হয়েছে সিনেমাটিতে, সে জন্য তাকাহাতার ভূয়সী প্রশংসা বেরিয়ে আসবে আপনা হতেই। সর্বোপরি এর সুষম গতি, যা দর্শককে আবিষ্ট করে তোলে দ্রুত, ফলে দর্শক আটকে থাকে সম্পূর্ণ সিনেমা জুড়ে, চুম্বকের মতো। এছাড়াও রয়েছে অনেক হৃদয় বিদারী দৃশ্য যা একটু একটু গ্রাস করতে থাকে, ক্রমশঃ; যেমন, সিনেমার শুরুতেই বিমান হতে বোমাবর্ষণের ফলে সমস্ত গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেলে সেইতা ও সেতসকোর মা ও আহত হয় মারাত্মকভাবে, এবং দুই ভাই-বোন মাকে খুঁজতে খুঁজতে যখন স্থানীয় ত্রাণকেন্দ্রে তাকে পায়, তখন তার সারা শরীর ব্যান্ডেজ আবৃত। ব্যাপারটা সেইতা দেখার পর নিজেকে সংবরণ করতে ব্যর্থ হয়, কিন্তু, চার বছর বয়সি বোনকে মায়ের এই দুরাবস্থার কথা জানাতে চায় না, ফলে বোনকে সে মিথ্যা বলে ভুলিয়ে রাখে, অথচ সেতসকো মাকে দেখার জন্য জিদ শুরু করে এবং কান্না করতে করতে বসে পড়ে যখন, তখন বোনকে রেখে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দূরে দিগন্ত বিস্তৃত বিধ্বস্ত গ্রাম সামনে রেখে সেইতার বসে থাকার দৃশ্যটি খুব সহজেই দর্শকের মনে যুদ্ধের করুণতম পরিণতির বিষয়ে সজাগ করে তোলে, এবং ক্রন্দনরত শিশুর আবেগের সাথে বিবশ হয়ে উঠে, আর হয়ত এখান থেকেই যুদ্ধ তার করাল গ্রাস নিয়ে এগুতে থাকে এই দুই শিশুর জীবনে।
পিতা-মাতাহীন দুই শিশু অবশেষে তাদের দূরসস্পর্কের এক খালার কাছে গিয়ে উঠে, যেখানে খালাটি তাদের মায়ের কিমানোর (বিশেষ ধরনের পোশাক) বিনিময়ে চাল কেনার জন্য সেইতাকে রাজী করায়, এবং যতদিন তাদের মায়ের পোশাকের বিনিময়ে চাল আনতে সক্ষম হয়, ততদিন পর্যন্ত দুই-ভাই বোন ভালই থাকে, কিন্তু, পরবর্তীতে তাদের খালাও তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার শুরু করে, এবং এক পর্যায়ে ভাই-বোন ঘর থেকে বেরিয়ে গুহার মতো পরিত্যক্ত একটি জায়গায় গিয়ে উঠে। এরপর থেকেই শুরু হয় তাদের অমানবিক কষ্ট, যেখানে সেইতা মায়ের জমানো অর্থের বিনিময়েও খাদ্য জোগাড় করতে ব্যর্থ হয় এবং দুই-ভাইবোন অনাহারে থাকতে থাকতে একসময় আশেপাশের জলাশয় থেকে মাছ, ব্যাঙ এসব খাওয়া শুরু করে। ক্রমশঃ সিতসকো ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং সেইতা অসুস্থ বোনের জন্য ঔষধ বা খাবার জোগাড় করা তো দূরে থাক, একটি ইক্ষু পর্যন্ত জমি থেকে চুরি করতে গিয়ে ভয়ানক রকমের প্রহারের শিকার হয়। সবভাবে ব্যর্থ সেইতার মৃত বোনের পাশে অসহায়ভাবে শুয়ে থাকার দৃশ্যর সামনে আমরা সত্যিকার অর্থেই কেঁপে উঠি, এবং কোথাও না কোথাও নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠে, যখন আমরা খুব ভালভাবেই যুদ্ধ বিভীষিকা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে সক্ষম হই, সর্বান্তকরণে।
সত্যি বলতে ভিজ্যুয়াল সিনেমা দিয়ে চরিত্রের নানাবিধ খুঁটিনাটি দিক ও মানবীয় আবেদন ঠিকঠাক ফুটিয়ে তোলা এ্যানিমেশন সিনেমার চেয়ে অনেক বেশি সহজ, কিন্তু, এ্যানিমেশন সিনেমার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারগুলো ঠিকঠাক ফুটিয়ে তোলা সত্যিই কষ্টকর, কেন না এখানে পরিচালক নিজেই একাধারে কাহিনীকার, নির্দেশক, অভিনেতা-আর এই সবগুলো দিক তাকে সুচারুভাবে সম্পাদন করতে হয় প্রাণহীন অসংখ্য চিত্রের মাধ্যমে, যারা নিজেরা কিছু করতে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম, আর তা দিয়ে সার্বিক মানবিক বোধ যথার্থভাবে ফুটিয়ে তোলা শুধু কষ্টকর নয়, বরং বিশেষ চ্যালেঞ্জের, আর এই কাজটি বিস্ময়কর সফলতার সাথে সম্পাদন করেছেন তাকাহাতা তার এই সিনেমাটিতে, এবং আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, এ্যানিমেশন সিনেমার মাধ্যমেও কীভাবে দারুণ মানবীয় আবেগ যথার্থভাবেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব, যা মানুষকে সফলভাবে নাড়া দিতে সক্ষম।
সমস্ত সিনেমা জুড়ে সদ্য মাতৃহীন বোনের প্রতির ভাইয়ের যে অপরিসীম ভালবাসা, মমতা, এবং প্রাণ দিয়ে আগলে রাখার অনন্ত প্রচেষ্টা, এবং যথাযথভাবে তা করতে না পারার কারণে আকুল যে কান্না, তা চিরদিন স্মরণ রাখার মতো, এবং আমাদের নিজেদেরও হয়ত গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে নিজেদের পরিবার-পরিজনদের প্রতি অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিরে তাকাবার। বিশেষ করে বোনকে সময়ে-অসময়ে ভুলিয়ে রাখার জন্য সেইতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে প্রয়াস, আপনি চাইলেও তা ভুলতে পারবেন না, আর এইসব ব্যাপারগুলো এত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, আপনি একেকটি দৃশ্যর জন্য একেকভাবে মুগ্ধ হবেন। যেমন সন্ধ্যাবেলায় দুই ভাই-বোনের জোনাক পোকা ধরার অপূর্ব দৃশ্যাবলী, যেখান সেইতা তার বোনকে জোনাক পোকা ধরে দেয়, আর সিতসকো যখন তা ধরে, অনজ্ঞিতার দরুন তা হাতের মধ্যে চেপ্টে যায়। বড় ভাই ছোট বোনের এই শিশুসুলভ আনাড়িপনাকে মৃদু হাসি দিয়ে উপহাস করে পুনরায় আরেকটি জোনাক পোকা ধরে যখন তার হাতের মধ্যে দেয়, এবং আলোসমেত তা উড়ে যায়, তখন আমরাও আশার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠি, আর অনেক উপর থেকে লং শটে দেখানো অসংখ্য জোনাক পোকার আলোয় আলোকিত সন্ধ্যার শোভা যেন আমাদের বুকের উপর চেপে বসা ভার হতে খানিকটা হলেও মুক্তি দেয়, কেন না সিনেমাটি শুরু থেকেই একটু একটু করে তার সীমাহীন আবেদন নিয়ে হৃদয়ের উপর চেপে বসতে থাকে।
এমন অনেক অনবদ্য দৃশ্যাবলী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বয়েছে সিনেমার পরতে পরতে,যা নিয়ে লিখতে গেলে পাতার পর পাতা ভরে উঠবে, আর চরিত্রগুলোর সার্বিক বিকাশে সম্ভাব্য সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিটেলস অব্দি পরিচালক এড়িয়ে যাননি সচেতনভাবে। সুষম গতিতে এগিয়ে যাওয়া এই সিনেমাটির ধরণ স্বভাবতই বিষাদময়, এবং রংয়ের চমৎকার ব্যবহার ও বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে নেয়া ক্যামেরা শট, বিশেষ করে উপর থেকে নেয়া লং শটগুলো সিনেমার আবহকে অষ্টাদশ শতাব্দীর আঁকা বিখ্যাত সব ল্যান্ডসক্যাপের মতো করে তুলেছে, যা গতানুগতিক দ্বিমাত্রিক এ্যানিমেশন সিমোগুলোতে সচরাচর ব্যবহার করা হয় না, আর এইসব দৃশ্যাবলী দর্শককে আরও দূর অব্দি বিস্তারিত দেখার ও ভাববার সুযোগ তৈরী করে দেয়, আর এমন সব অনবদ্য দৃশ্যর সাথে বাজতে থাকা স্লো মিউজিক, আহা, মনে হয় কাহিনী আর সংগীত যেন মিলেমিশে একাকার। বিশেষ করে, একদম শেষে এসে মৃত সিতসকোর নানারূপ শিশুসুলভ আচরণ টুকরো টুকরোভাবে স্মৃতিচারণের সময় ইটালিয়ান অপেরা গায়িকা এ্যামেলিটা গ্যালি-কার্চির ত্রিশ দশকে গাওয়া ‘হোম, সুইট হোম’ গানটি আপনাকে নিঃসন্দেহে নতুনতর মুগ্ধতায় পর্যবসিত করবে।
প্রায় একশত বছর ধরে হলিউড এ্যানিমেশন সিনেমা বিশ্ব-শিশুদের বিনোদনের বিশেষ একটা চাহিদা পূরণ করে আসছে, এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ওয়াল্ট ডিজনী যেন পৃথিবীর শিশুদের খানিকটা অধিক বাঁচিয়ে দিলেন,মানুষের সৃষ্ট কদর্যতার মাঝে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় নির্মল ও সুন্দরতম বিনোদন উপহার দিয়ে, আর এই প্রয়াসে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে এলেন হায়াও মায়াজাকি ও স্টুডিও ঘিবলি, এবং আমাদের তথা আমাদের শিশুদের দারুণভাবে শিখিয়ে দিলেন, কীভাবে মানবতা, প্রকৃতি ও চারপাশের প্রতি উদার হতে হয়, আর হয়ত এখানেই জাপানীজ এ্যানিমেশন সিনেমা হলিউড তথা অন্যান্য যে কোনো দেশের এ্যানিমেশন সিনেমা হতে একধাপ এগিয়ে, যারা অনবদ্য সব এ্যানিমেশন সিনেমা আমাদের শিশুদের উপহার দিয়ে তাদের মানসিকতায় আরও খানিকটা সুন্দর পরিসর তৈরী করে দিলেন, আর এই ধারাতে অনায়াসেই বেশ কিছু জাপানীজ এ্যানিমেশন সিনেমার নাম উঠে আসে, যেমন, প্রিন্সেস মনোনকে (১৯৯৭),মাই নাইবর টটোরো (১৯৮৮), স্পিরিটেড এ্যাওয়ে ২০০১), পুনইয়ো (২০০৮), ফ্রম আপ অন পপি হিল (২০১১), ক্যাসল ইন দ্য স্কাই (১৯৮৬), দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব এ্যারাইতি (২০১০), হাওলস মুভিং ক্যাসল (২০০৪), ন্যুসিকা অব দ্য ভ্যালী অব দ্য ওয়াইন্ড (১৯৮৪), পম পকো (১৯৯৪) ইত্যাদি।
তবে জাপানীজ এ্যানিমেশন সিনেমার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ না করলেই নয়, যেমন, এরা সিনেমাগুলো বিশেষত ছোটদের জন্য বানালেও সিনেমার কাহিনী, নির্দেশনা ও সার্বিক বিকাশ এতটাই সমৃদ্ধ ও পরিশালিত করে তোলে যে, তা শেষ অব্দি কেবল ছোটদের জন্যই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সব বয়সের দর্শকের জন্যই হয়ে উঠে সমান উপভোগ্য ও শিক্ষনীয়, এবং প্রতিটি এ্যানিমেশন সিনেমাতেই থাকে মিউজিকের চমকপ্রদ ব্যবহার, যা কাহিনীকে অধিক বেশি গ্রহযোগ্য করে তোলে। সর্বোপরি তারা এ্যানিমেশন সিনেমাতে কেবল আনন্দ বা উপভোগের উপকরণ যোগ করে না, বরং এর মাধ্যমে এমন এক বার্তা বিশ্বশিশু তথা মানুষের পৌঁছে দেবার চেষ্টা করে, যা মানব মনে গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম, আর এখানেই জাপানীজ এ্যানিমেশন সিনেমা তার বিকাশে সফল ও সার্থক, যার জলজ্যান্ত প্রমাণ হতে পারে বিশ্বজুড়ে জাপানীজ এ্যানিমেশন সিনেমার ছড়িয়ে পড়া এবং খোদ হলিউড কর্তৃক অনেক জাপানীজ এ্যানিমেশন সিনেমার রিমেক বা ইংলিশ ডাবিং করা।
পরিশেষ বলব, এই সিনেমাটি এ্যানিমেশন সিনেমা সম্পর্কে আপনার সমস্ত চিন্তা-ধারা বদলে দেবে, নিঃসন্দেহে, কেন না এ্যানিমেশন সিমোর আদলে এটা মানবীয় সেই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা যার সামনে এভাবে আপনাকে দাঁড় করাতে আর কোনো এ্যানিমেশন সিনেমাই সমর্থ হয়নি। আশা করব, সব পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের নিয়ে সিনেমাটি দেখবেন, কেন না এমন একটি সিনেমা শেষ করার পর যে কোনো মানুষই নিজেকে মানবিক অবস্থানে নতুন করে দেখার প্রয়াস পাবে।
অরণ্য
ঢাকা, বাংলাদেশ
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন