বলতে গেলে, যেসব ছবি দেখার পর মনে হয় তা দর্শকদের জানানো দরকার, এবং ছবিটি অবশ্যই দেখা উচিত, সেসব নিয়ে না লিখে থাকতে পারি না। যদিও প্রেমের ছবি নিয়ে আমি কখনোই লিখিনি, কিন্তু ২০০৪-এ মুক্তি পাওয়া ১১৭ মিনিটের এই অসাধারণ প্রেমের ছবিটি দেখার পর না লিখে শান্তি পাচ্ছিলাম না। ছবিটি এরই মধ্যে কয়েকবার দেখা হয়েছে যদিও, তারপরও আবার দেখতে ইচ্ছে করছে, বিশেষ করে যাকে কেন্দ্র করে ছবিটির কাহিনী, তাকে এতটাই সাবলীল আর পারফেক্ট মনে হয়েছে যে, আর কেউ-ই হয়ত এই চরিত্রটি এত সুন্দর ফুটিয়ে তুলতে পারত না। ছবি নয়, বাস্তব একটি জীবন স্বচক্ষে দেখার পর প্রাণ যখন ভিজে এলো, তখন অনেকদিন পর আবার আমাকে লিখতে বসতে হল, এবং বলতে দ্বিধা নেই, ওয়াংকার ওয়াই-এর ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’-এর পর এটিই আমার সবচেয়ে প্রিয় রোমান্টিক মুভি।
খুব বেশি চরিত্র নেই ছবিটিতে বা ঘটনা পরিক্রমা। বলতে গেলে দুটোমাত্র চরিত্রকে কেন্দ্র করে, কয়েকটি ঘটনার মধ্যে দিয়েই ছবিটি এগিয়েছে। পরিচালক ‘জন এইচ. লি’-র প্রশংসা করতে গেলে হয়ত অহেতুক সময় নষ্ট হবে, কেন না যারা এই ছবিটি দেখবেন, তারা নিজেরাই বুঝে যাবেন, এত সাধারণ একটি প্রেমের কাহিনীকে কীভাবে অসাধারণভাবে সেলুলয়েডে ধারণ করা যায়। বিশেষত নায়ক-নায়িকার চরিত্রে ‘ও-সাং জাং’ ও ‘ইয়ে-জিন সন’-কে নির্বাচনের মাধ্যমেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, চরিত্রের গভীরতা ও তাকে যথাযথ ফুটিয়ে তোলার জন্য সঠিক অভিনেতা-অভিনেত্রীর নির্বাচন-ই একজন পরিচালকের প্রকৃত দক্ষতার পরিচয় বহন করে।
আমার মত এমন অসংখ্য দর্শক সারা পৃথিবী জুড়ে রয়েছেন, যারা ছবিটিকে তাদের প্রথম পছন্দের তালিকায় রেখে দিয়েছেন প্রথমবার দেখেই, আর তাদের বেশিরভাগই কান্নায় একাত্বতা বোধ করেছেন ছবিটির কাহিনী, সাবলীল অভিনয়, প্রেমময় মুহূর্তগুলোর আবেগ, দুঃখ-কষ্ট, সবকিছুর সাথেই। ছবির কাহিনী তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। সু-জিন নামের ২৮ বছরের এক যুবতী, এ্যালঝাইমার রোগে আক্রান্ত, যে ক্রমশঃ তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলছে, তেমন একজনকে কেন্দ্র করে। সে হঠাৎ তার বাবার অধীনস্থ চেল-সু নামের এক কার্পেন্টারের প্রেমে পড়ে। যেদিন প্রথম তাদের দেখা হয়, সেদিন-ই সে তার পুরোনো প্রেমিক দ্বারা প্রতারিত হয়, যার সাথে সে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। এরপর খুব নাটকীয়ভাবে চেল-সুর সাথে তার দেখা হয় একটি সুপার মার্কেটের দরজায়। মূলতঃ, এখান থেকেই ছবিটি দর্শকদের প্রতি মুহূর্তে আকৃষ্ট করতে শুরু করে। সেই নাটকীয় দেখার মুহূর্ত থেকে শুরু করে, পরবর্তীতে তাদের প্রেম, বিয়ে, সংসার, স্বপ্ন, দৈনন্দিন বেঁচে-থাকা, এবং সর্বোপরি সাংসারিক জীবনে স্বামী হিসেবে চেল-সুর যে কোনো অবস্থায় সু-জিনকে আগলে রাখা, এসবের মধ্যে দিয়ে ছবির শেষ অব্দি চলে আসলেও, একটিবারের জন্যও মনে হয় না বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে, বরং জীবনের রূঢ় বাস্তবতা ও অসহায়তার মাঝেও পরিচালক আমাদের যে প্রেমের সাথে বার বার পরিচিয় ঘটিয়ে দিয়েছেন, হয়ত মানুষমাত্রই তা কামনা করে, আর এখানেই ছবিটির মূলশক্তি নিহত, যাকে পরিচালক পরম যতœ ও দক্ষতা সহকারে বুনেছেন পরতে পরতে ।
ছবিটির বিশেষ কিছু দিক যা আমাকে দারুণ আকর্ষণ করেছে, তা হলো, এর পরিমিত সংলাপ, যার সাথে জীবন বোধ ও দর্শনের সমন্বয় রয়েছে। এছাড়া এডিটিং ও মিউজিক আমাকে মুগ্ধ করেছে, বিশেষ করে শিন ইয়োনার গাওয়া ‘লা পালোমা’ গানটি শোনার পর থেকেই কানে বাজছে। সব মিলিয়ে খুব সাধারণ কাহিনীর উপর ভিত্তি করে বানানো এই ছবিটিকে মাস্টাপিস বলা যেতে পারে। ছবিটি শুধু প্রেম নিয়েই থেমে থাকেনি, বরং একজন মানুষ যে কিনা শারীরীক নয়, মানসিকভাবে মৃত্যবরণ করতে চলেছে, তাকে ঘিরে পরিবার-পরিজনের অবস্থান, এবং প্রেম-ভালবাসা দিয়ে পুনারায় তাকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনা, এর চেয়ে বড় দিক আর কী হতে পারে, যা তুলে ধরা হয়েছে নিপুনভাবে।
পরিশেষে আমি সবাইকেই বলব ছবিটি দেখতে, কেন না প্রতিটি দর্শক প্রাণেই হয়ত ছবিটি চিরন্তন সেই গভীর প্রেম-বোধ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম, যার জন্য আমরা সবকিছু করতে প্রস্তুত, আর তেমন প্রেম-ই কেবল পারে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে, এবং চরম বাস্তবতার মাঝেও আমাদের বেঁচে থাকা সুন্দর ও ঈর্ষনীয় করে তুলতে। ধন্যবাদ পরিচালক জন লি-কে, এমন একটি অসাধারণ প্রেমের ছবি আমাদের উপহার দেবার জন্য।
অরণ্য
২৫.১১.১১
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ৯:৫৪