ইসলামের অন্যতম বহুল বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে নারীর পর্দা, যদিও নারী পুরুষ উভয়ের জন্য পর্দা করা ফরজ তবুও নারীর পর্দা নিয়ে তথাকথিত সুশীল সমাজে সমালোচনার ঝড় উঠে এবং পর্দা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকার জন্য অনেক মুসলিম ভাই-বোনেরাও অজ্ঞতাবশত নাফরমানি কথা বলে কঠিন গুনাহের অংশীদার হন।
"وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍۢ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَـٰلًۭا مُّبِينًۭا ٣٦
আর আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য সে বিষয়ে তাদের কোনো (ভিন্ন সিদ্ধান্তের) ইখতিয়ার সংগত নয়। আর যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হলো।"(সুরা আহযাব:৩৬)
সাধারণ অর্থে পর্দা এমন কিছুকে বুঝায় যা দুটি বস্তুর মাঝে অন্তরাল সৃষ্টি করে অর্থাৎ পর্দার এক পাশ থেকে অন্যপাশে বিদ্যমান কোন কিছু দৃষ্টিগোচরে আসে না। ঘরে আমরা দরজা জানালায় যে পর্দা ব্যবহার করি তা মূলত রোদের আলো আড়াল করার জন্য এবং ঘরের ভিতরে লোকজনের দৃষ্টির অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য দেয়া হয়। যে কাপড়ের মাধ্যমে সহজেই আলো ও দৃষ্টি চলাচল করে তেমন কাপড় কেউই পর্দা হিসেবে ব্যবহার করে না। একই ভাবে মশা মাছি জীবাণুর আক্রমণ ঠেকাতে খাবারের জিনিসও ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়, আবার অর্থ সম্পদ, মূল্যবান গহনা, দলিলপত্র কেউ শোকেসে সাজিয়ে রাখে না বরং লোকচক্ষুর আড়ালে যত্নসহকারে গুছিয়ে রাখে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে তিন ফুট দুরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা ইত্যাদি নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল যেগুলো সংক্রমণ আর সুস্থতার মাঝে এক রকম পর্দা স্বরূপ। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে পর্দা হচ্ছে শৈশব থেকে কবরস্থ পর্যন্ত এমন এক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যা মুমিনদের সব ধরনের অশ্লীলতা থেকে মুক্ত রাখে এবং পারিবারিক সামাজিক ও নৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে।
আল কোরআানে পর্দার আহকাম
নর-নারীর সাবালকত্ব অর্জন করার সাথে সাথেই পর্দা মেনে চলা ফরজ হয়ে যায়। শৈশব থেকেই পরিবারের ভিতর পর্দাচর্চা শুরু করতে হয়। কিন্তু পর্দা বলতে কেবল পোশাকের আবরণ বুঝায় না কতিপয় শিষ্টাচারও পর্দার অন্তর্ভুক্ত।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَدْخُلُوا۟ بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّىٰ تَسْتَأْنِسُوا۟ وَتُسَلِّمُوا۟ عَلَىٰٓ أَهْلِهَا ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌۭ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ ٢٧
হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না, অনুমতি প্রার্থনা এবং গৃহবাসীদেরকে সালাম দেয়া ব্যতীত। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যাতে তোমরা উপদেশ লাভ কর। (সুরা নুর:২৭)
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لِيَسْتَـْٔذِنكُمُ ٱلَّذِينَ مَلَكَتْ أَيْمَـٰنُكُمْ وَٱلَّذِينَ لَمْ يَبْلُغُوا۟ ٱلْحُلُمَ مِنكُمْ ثَلَـٰثَ مَرَّٰتٍۢ ۚ مِّن قَبْلِ صَلَوٰةِ ٱلْفَجْرِ وَحِينَ تَضَعُونَ ثِيَابَكُم مِّنَ ٱلظَّهِيرَةِ وَمِنۢ بَعْدِ صَلَوٰةِ ٱلْعِشَآءِ ۚ ثَلَـٰثُ عَوْرَٰتٍۢ لَّكُمْ ۚ لَيْسَ عَلَيْكُمْ وَلَا عَلَيْهِمْ جُنَاحٌۢ بَعْدَهُنَّ ۚ طَوَّٰفُونَ عَلَيْكُم بَعْضُكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍۢ ۚ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمُ ٱلْـَٔايَـٰتِ ۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌۭ ٥٨
হে মুমিনগণ! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়নি তারা যেন তোমাদের কক্ষে প্রবেশ করতে তিন সময় অনুমতি গ্রহণ করে, ফজরের সালাতের আগে, দুপুরে যখন তোমরা তোমাদের পোষাক খুলে রাখ তখন এবং ‘ইশার সালাতের পর; এ তিন সময় তোমাদের গোপনীয়তার সময়। এ তিন সময় ছাড়া (অন্য সময় বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলে) তোমাদের এবং তাদের কোনো দোষ নেই । তোমাদের এককে অন্যের কাছে তো যেতেই হয়। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন। আর আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সুরা নুর :৫৮)
এমনকি আল্লাহ তায়ালা এমন কথাবার্তা বলা বা কোন প্রকার মন্দ ধারণা করা থেকে মুমিনদের নিষেধ করেছেন যার দরুণ তৃতীয় ব্যক্তি সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয় এবং মর্যাদাহানি ঘটে। অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতি এড়ানোর জন্য কোন কথা শোনামাত্র প্রচার করাও ইসলামে নিষেধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
۞لَا یُحِبُّ اللّٰہُ الۡجَہۡرَ بِالسُّوۡٓءِ مِنَ الۡقَوۡلِ اِلَّا مَنۡ ظُلِمَ ؕ وَکَانَ اللّٰہُ سَمِیۡعًا عَلِیۡمًا
প্রকাশ্যে (কারও) দোষ চর্চাকে আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে কারও প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে আলাদা কথা। আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন। (সুরা আন নিসা - ১৪৮)
إِذْ تَلَقَّوْنَهُۥ بِأَلْسِنَتِكُمْ وَتَقُولُونَ بِأَفْوَاهِكُم مَّا لَيْسَ لَكُم بِهِۦ عِلْمٌۭ وَتَحْسَبُونَهُۥ هَيِّنًۭا وَهُوَ عِندَ ٱللَّهِ عَظِيمٌۭ
যখন এটা তোমরা তোমাদের মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং তোমরা তোমাদের মুখ দিয়ে এমন কথা বলছিলে, যাতে তোমাদের কোন জ্ঞান ছিল না; আর তোমরা এটাকে খুবই তুচ্ছ মনে করছিলে, অথচ এটা আল্লাহর নিকট খুবই গুরুতর। (সুরা নুর:১৫)
পবিত্র কোরআনে সাবালেক মুমিন পুরুষ ও নারীদের দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণে রাখার কঠোর নির্দেশ এসেছে যাতে করে মানুষের পক্ষে চরিত্র সংরক্ষণ করা সহজ হয়, এমন কোন কিছুতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাবে না যার ফলশ্রুতিতে চরিত্র সংরক্ষণ কঠিন হয়ে যায় এবং আরেকজনের গোপনীয়তা বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয় কিংবা সম্মান নষ্ট হয়।
قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا۟ مِنْ أَبْصَـٰرِهِمْ وَيَحْفَظُوا۟ فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرٌۢ بِمَا يَصْنَعُونَ ٣٠
মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। (সুরা নূর:৩০)
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَـٰتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَـٰرِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ۖ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ ءَابَآئِهِنَّ أَوْ ءَابَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَآئِهِنَّ أَوْ أَبْنَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَٰنِهِنَّ أَوْ بَنِىٓ إِخْوَٰنِهِنَّ أَوْ بَنِىٓ أَخَوَٰتِهِنَّ أَوْ نِسَآئِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَـٰنُهُنَّ أَوِ ٱلتَّـٰبِعِينَ غَيْرِ أُو۟لِى ٱلْإِرْبَةِ مِنَ ٱلرِّجَالِ أَوِ ٱلطِّفْلِ ٱلَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا۟ عَلَىٰ عَوْرَٰتِ ٱلنِّسَآءِ ۖ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ ۚ وَتُوبُوٓا۟ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ٣١
আর মুমিন নারীদেরকে বলে দাও তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে আর তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে, আর তাদের শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ না করতে যা এমনিতেই প্রকাশিত হয় তা ব্যতীত। তাদের ঘাড় ও বুক যেন মাথার কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভাই-এর ছেলে, বোনের ছেলে, নিজেদের মহিলাগণ, স্বীয় মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনামুক্ত পুরুষ আর নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া অন্যের কাছে নিজেদের শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজেদের গোপন শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সুরা নুর:৩১)
উল্লেখিত দুটি আয়াতে মুমিন নারী পুরুষ উভয়কেই দৃষ্টি সংযত করার ও লজ্জাস্থান হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে আরো কিছু নির্দেশনা রয়েছে। সেগুলো অনুধাবনের জন্য আয়াতে উল্লেখিত কতিপয় শব্দ সম্পর্কে একটু ভালোমত জানা প্রয়োজন।
زينة
যিনাত:- শোভা, সৌন্দর্য, রূপ, সাজসজ্জা, অলংকার ইত্যাদি।
خمار
খিমার:- ঘোমটা, ওড়না, মাথায় জড়ানোর কাপড়, অর্থাৎ খিমার এক প্রকার ওড়না যা মাথা, ঘাড় ও কাঁধ ঢেকে রাখে।
جيب
জাইব:- পকেট, জামার সামনের ফোকর, বক্ষদেশ বা বগল।
আয়াতটির ১ম অংশে বলা হয়েছে দৃষ্টি সংবরণের কথা, ২য় অংশে লজ্জাস্থান হেফাজতের কথা, ৩য় অংশে বলা হয়েছে নারীরা যেন নিজেদের যিনাত প্রকাশ না করে যা অনিচ্ছায় প্রকাশ পেয়ে যায় তা ভিন্ন কথা, ৪র্থ অংশে বলা হয়েছে তারা যেন নিজেদের পরিধানকৃত খিমার দ্বারা বক্ষদেশ আবৃত করে রাখে, ৫ম অংশে তাদের তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে যাদের সামনে যিনাত প্রকাশ করার অনুমতি আছে, ৬ষ্ঠ অংশে লুকায়িত যিনাতের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আয়াতের শেষে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই আল্লাহর নিকট তওবা (ফিরে আসা/ প্রত্যাবর্তন করা) করতে বলা হয়েছে যেন তারা সফলতা অর্জন করতে পারে।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা: বর্ণনা করেন, এই আয়াত নাযিল হলে মুহাজির মহিলারা তাদের চাদরের এক পার্শ্ব ছিড়ে তা দিয়ে ঘোমটা দিয়ে নিল। (আবু দাউদ :৪১০২)
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ قُل لِّأَزْوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ ٱلْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَـٰبِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰٓ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورًۭا رَّحِيمًۭا ٥٩
হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বল, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবে*র কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা আহযাব:৫৯)
* জিলবাব হচ্ছে এমন পোশাক যা পুরো শরীরকে আচ্ছাদিত করে।
জিলবাবের আকার-আকৃতি সম্পর্কে ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ এই চাদর খিমারের উপরে পরিধান করা হয়। [ইবনে কাসীর] অর্থাৎ সুরা নুরে উল্লেখিত খিমার গৃহ অবস্থানরত অবস্থায় এবং বাইরে গমনাগমনের জন্য সেই খিমারের উপর অতিরিক্ত জিলবাব পরিধান করা অপরিহার্য। যেমনটি আমাদের সমাজের পর্দাশীল নারীরা বোরকা স্বরুপ ব্যবহার করে থাকেন।
উম্মুল মুমিনীন উম্ম সালামাহ্ বর্ণনা করেন, যখন এই আয়াত নাযিল হয়েছে, আনসার মহিলারা এমনভাবে বের হল যেন তাদের মাথার উপর কাপড়ের তৈরী কাকের সমারোহ। ( এখানে জিলবাব হিসেবে কালো কাপড় ব্যবহারের একটি ঈঙ্গিত পাওয়া যায়) ( আবু দাউদ :৪১০৩)
وَٱلۡقَوَٰعِدُ مِنَ ٱلنِّسَآءِ ٱلَّٰتِي لَا يَرۡجُونَ نِكَاحٗا فَلَيۡسَ عَلَيۡهِنَّ جُنَاحٌ أَن يَضَعۡنَ ثِيَابَهُنَّ غَيۡرَ مُتَبَرِّجَٰتِۢ بِزِينَةٖۖ وَأَن يَسۡتَعۡفِفۡنَ خَيۡرٞ لَّهُنَّۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ٦٠﴾ [النور: ٦٠]
“আর এমন বৃদ্ধ নারীগণ যারা বিবাহের আশা রাখে না, তাদের জন্য দোষ নেই যদি তারা তাদের শোভা প্রদর্শন না করে তাদের (বাহ্যিক অতিরিক্ত চাদর উড়না) বস্ত্র খুলে রাখে, তবে সংযমী হয়ে বিরত থাকলে তা তাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬০]
সুরা আহযাব ও সুরা নুরের কতিপয় আয়াত সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, নারীর সৌন্দর্য কেবল গৃহের অভ্যন্তরের জন্য যা সকলের সামনে প্রদর্শন করার জন্য নয়। কেবলমাত্র উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের নিকট তা প্রকাশ করার অনুমতি আছে। এতদ্ব্যতিত নিজের সাজসজ্জা সৌন্দর্য অন্যের নিকট প্রকাশ করা কোন ঈমানদার নারীর বৈশিষ্ট্য নয়। মূলত বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে দেখা যায়, পতিতাবৃত্তিতে যে সব নারী জড়িত তারাই সবসময় নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শন করার মাধ্যমে খদ্দের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। যদিও নারী পুরুষ উভয়ের জন্য পর্দার নিয়ম একইরকম তদুপরি নারীদের ক্ষেত্রে তাদের সৌন্দর্য আড়াল করার জন্য বিশেষ করে আদেশ করা হয়েছে। কারণ -
زُیِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّہَوٰتِ مِنَ النِّسَآءِ وَالۡبَنِیۡنَ وَالۡقَنَاطِیۡرِ الۡمُقَنۡطَرَۃِ مِنَ الذَّہَبِ وَالۡفِضَّۃِ وَالۡخَیۡلِ الۡمُسَوَّمَۃِ وَالۡاَنۡعَامِ وَالۡحَرۡثِ ؕ ذٰلِکَ مَتَاعُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَاللّٰہُ عِنۡدَہٗ حُسۡنُ الۡمَاٰبِ
মানুষের জন্য ওই সকল বস্তুর আসক্তিকে মনোরম করা হয়েছে, যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক অর্থাৎ নারী, সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রুপা, চিহ্নিত অশ্বরাজি, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামার। এসব ইহ-জীবনের ভোগ-সামগ্রী। (কিন্তু) স্থায়ী পরিণামের সৌন্দর্য কেবল আল্লাহরই কাছে। (আলে ইমরান-১৪)
উল্লেখিত আয়াতে মানুষের আসক্তির বিষয়গুলো খুব স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলোর মাঝে প্রথমেই নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ সৃষ্টিগতভাবেই নারীর প্রতি আকর্ষণ বা আগ্রহকে মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোন বিবাহ অনুষ্ঠানে মানুষের আগ্রহের বিষয় থাকে বিয়ের কনে দেখতে কেমন এবং কনের আগ্রহ থাকে নিজের সৌন্দর্যের বিষয়ে, যে বিষয়গুলো বরের ক্ষেত্রে তেমন পরিলক্ষিত হয় না। নারীকে যেমন সৌন্দর্য্যমণ্ডিত করা হয়েছে তেমনি যে কোন কিছুর সৌন্দর্য্য ধরে রাখা এবং তা বর্ধনের ক্ষুধাও নারীর মাঝে কমবেশি বিদ্যমান, নিজের ব্যক্তিগত সৌন্দর্যচর্চার কথা বলাই বাহুল্য। আর পুরুষজাতির মাঝে আছে সৌন্দর্য্য দর্শনের আগ্রহ ও তার প্রশংসা বা মূল্যায়ন করার প্রতিভা। যার দরুণ তারা এক প্রাম্ত থেকে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বিশ্বের আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। আর এই পৃথিবী ও নরনারী সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং বলেছেন, যা কিছু সুশোভিত করা হয়েছে তার মধ্যে নারীই সর্বাধিক সুন্দর সৃষ্টি এবং তার প্রতি আসক্তিও সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। আর যা কিছু মূল্যবান এবং একই সাথে লোকের আকর্ষণও বিদ্যমান তা মানুষ লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখে।
পর্দা বিষয়ক হাদিস
# সন্তান দশ বছর হলে তাদের পৃথক বিছানার ব্যবস্থা করতে হবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস সংখ্যা ৪৯৫)
# দরজার ডান অথবা বাম দিকে সরে দাঁড়াও। কেননা চোখের দৃষ্টির কারণেই অনুমতি নেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।[সুনানে আবু দাউদ :৫১৭৪]
# কোন পুরুষ যেন কোন মহিলার সাথে একাকী না হয় এবং মহিলা যেন মাহরাম পুরুষ ছাড়া একাকিনী সফর না করে।’’ (মিশকাত মাশাবিহ২৫১৩)
# তোমরা সেই মহিলাদের নিকট গমন করো না যাদের স্বামীরা অনুপস্থিত আছে। কারণ, শয়তান তোমাদের রক্তশিরায় প্রবাহিত হয়। (সহীহ তিরমিজি ১১৭২)
# প্রত্যেক চক্ষুই ব্যভিচারী। আর রমণী যদি সুগন্ধি ব্যবহার করে কোন মজলিসের পাশ দিয়ে যায় তাহলে সে এক ব্যভিচারিণী। (জামে তিরমিযী,,২৭৮৬নং)
# হাম্উ হচ্ছে মৃত্যু। ( হাম্উ হচ্ছে স্বামীর ভাই ও স্বামীর অনুরূপ আত্মীয় )। (সহীহ মুসলিম ২১৭২)
# কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম মানুষ হবে ওই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সঙ্গে মিলিত হয়, অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা প্রচার করে দেয়। (সহিহ মুসলিম : ১৪৩৭)
# যে সকল নারী পোশাক পড়েও বিবস্ত্র , অপরকে আকৃষ্ট করে ও নিজেও আকৃষ্ট হয়; মাথা উটের হেলানো কুঁজের ন্যায়, এরা জান্নাতে যাবে না এবং জান্নাতের খুশবুও পাবে না। (মুসলিম : ২১২৮)
# রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সব পুরুষের উপর লানত করেছেন, যারা নারীদের পোশাক পড়ে আর সেই সব নারীর উপরও লানত করেছেন, যারা পুরুষের পোশাক পড়ে । (রিয়াদুস সালেহীন :১৬৩২)
# আমার সকল উম্মাতকে মাফ করা হবে, তবে প্রকাশকারী ব্যতীত। আর নিশ্চয় এ বড়ই অন্যায় যে, কোন লোক রাতের বেলা অপরাধ করল যা আল্লাহ ঢেকে রাখলেন। কিন্তু সে সকাল হলে বলে বেড়াতে লাগল, হে অমুক! আমি আজ রাতে এই এই কাজ করেছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত কাটাল যে, আল্লাহ তার কর্ম ঢেকে রেখেছিলেন, আর সে ভোরে উঠে তার উপর আল্লাহর দেয়া আবরণ খুলে ফেলল।(রিয়াদুস সালেহীন ২৪১)
# যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে ঢেকে রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে ঢেকে রাখে। (সুনানে ইবনে মাজাহ ২৫৪৪)
# দাইয়ুসের জন্য জান্নাত হারাম, যে নিজ পরিবারের নারীদের নোংরামি সমর্থন / অনুমোদন করে। (মিশকাত আল মাসাবিহ :৩৬৫৫)
অন্যান্য ধর্মে নারীর পর্দা:
বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলোতে নারীদের পোশাকের ব্যাপার রক্ষণশীল নীতি রয়েছে। খোলামেলা ও আঁটসাঁট পোশাক নারীদের জন্য অনুমোদিত নয়।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে আছে, "হে নারী! নিচে দেখো, উপরে দেখিওনা, দুই পা একত্র করে রাখো, তোমার কনুই আদি যেন কেহ না দেখে, নারী হয়েও তুমি পূজিতা হবে।" (ঋগ্বেদ :৮/৩৩/১৯)
খ্রীষ্ট ধর্মগ্রণ্থে আছে, "সেই প্রকারে নারীগণও সলজ্জ ও সুবুদ্ধিভাবে পরিপাটি বেশে আপনাদিগকে ভূষিত করুক; বেণীবদ্ধ কেশপাশে ও স্বর্ণ বা মুক্তা বা বহুমূল্য পরিচ্ছদ দ্বারা নয়।" (পবিত্র বাইবেল, ১তীমথিয় ২:৯)
ওল্ড টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে 'আর রেবেকা যখন ইসহাককে দেখিলেন, তখন উট হতে নেমে দাসকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের সাথে দেখা করতে যে আসতেছেন, ঐ পুরুষ কে? দাস বললো, উনি আমার কর্তা। তখন রেবেকা ঘোমটা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলেন।' [আদি পুস্তক ২৪:৬৪, ৬৫ পদ]
হালাচা (ইহুদি আইন) অনুসারে, মহিলাদের অবশ্যই বিয়ের পর চুল ঢেকে রাখতে হবে, তা টুপি, পরচুলা বা স্কার্ফ দিয়েই হোক না কেন। চুল উন্মুক্ত করা অশালীনতা হিসাবে বিবেচিত হয়।
লম্বা স্কার্ট, সাধারণত হাঁটুর নিচে, এবং লম্বা হাতা একটি ধ্রুবক। উজ্জ্বল বা আকর্ষণীয় রঙের ব্যবহারও সীমাবদ্ধ, কারণ এটি বিবেচনা করা হয় যে তারা অযথা মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। (bn.cultura 10.com)
আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসেও নারীকে আপাদমস্তক বস্ত্রাবৃত দেখা যায়। বিবাহের কনের ঘোমটা নাক অবধি টেনে রাখতো। লোকচক্ষুর আড়াল করে পালকিতে করে বিদায় হত। কেবল পোশাক নয়, চলনবলন, আচার-আচরণেও লজ্জাশীলতা বিদ্যমান ছিলো। বাড়িতে বহিরাগত পুরুষের আগমনে মহিলারা অন্দরমহলে চলে যেত। বাসা বাড়ির পুরুষেরা বাড়িতে প্রবেশের সময় গলায় খাঁকারি দিয়ে আসতো যাতে ভিতরে নারীরা সতর্ক হয়ে যায়। সম্ভ্রান্ত মহিলারা কাপড়ে ঘেরা ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করতো। অপরিচিত পুরুষের সাথে কথা বলা তো দুরের কথা, তাদের সামনে নিজেদের কণ্ঠকেও নিচু রাখতো।
নারীদেহের পর্দার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা
শরীয়তে নারীর পর্দার বিষয়গুলো ভালোভাবে উপলব্ধি করলে বুঝা যায়, নারী সবসময় তার দেহকে লোকচক্ষু থেকে আড়ালে রাখবে, মাথার চুল ও বক্ষদেশ ভালোমত আবৃত করে রাখবে, মাহরাম পুরুষ, ক্রীতদাসী ও নাবালক শিশু ব্যতিত নিজের সাজসজ্জা উম্মুক্ত করবে না, এমনকি নিজস্ব মহিলাদের ছাড়া যে কোন মহিলার সামনেও নিজেকে প্রদর্শন করবে না। বাসার বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই অতিরিক্ত বড় চাদর মুড়ি দিতে হবে, এবং সুগন্ধিযুক্ত প্রসাধনী বর্জন করতে হবে, এমন কোন কিছু পরিধান করা যাবে না যার শব্দে অন্য পুরুষের মনোযোগ বিঘ্ন ঘটে। আধুনিক আদর্শের শিক্ষিত যুক্তিবাদী সমাজ কোন কিছুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছাড়া মানতে চায় না, তাই নিচে নারীর পর্দা করার উপকারিতা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হলো :
dermatology associates এর গবেষণা মতে, নারীদের তুলনায় পুরুষের চামড়ার পুরুত্ব ২০-২৫% বেশি, গঠন প্রক্রিয়া বেশি মজবুত। পুরুষদের ত্বকে sebum oil এর উৎপাদন মহিলাদের তুলনায় দ্বিগুণ। পুরুষের ত্বকে কোলাজেন এর পরিমানও তুলনামূলক বেশি থাকে। পুরুষের ত্বকের কোলাজেন ধ্রুবকহারে কমে কিন্তু মহিলাদের ত্বকের কোলাজেন মেনোপজের পর দ্রুত হারে কমে। চামড়ার পুরুত্ব ও ত্বকের তৈলাক্ত কম হওয়ায় নারীদেহে কোলাজেন হ্রাসের প্রভাব প্রকট হয়ে থাকে। পুরুষের ত্বকে উচ্চতর কোলাজেন ঘনত্বের মানে হল যে এটি মহিলাদের ত্বকের তুলনায় ধীরে ধীরে বয়স্ক হয়। প্রকৃতপক্ষে, একজন মহিলার ত্বক একই বয়সের একজন পুরুষের চেয়ে প্রায় ১৫ বছর বয়স্ক । যেহেতু মহিলারা পুরুষদের তুলনায় কম সূর্যালোক যায় এবং সাধারণত সানস্ক্রিন ব্যবহার করেন , তাই "১৫ বছর" ত্বকের বয়সের পার্থক্য সহজেই লক্ষ্য করা যায় না। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি একজন মানুষের ত্বকে বছরের বার্ধক্য যোগ করতে পারে এবং ধীরে ধীরে অন্তর্নিহিত বার্ধক্যের বয়স বহুগুণ ছাপিয়ে যায়। যেহেতু নারীদের চামড়া পাতলা তাই সূর্যের আলো অতি সহজে তাদের চামড়া ভেদ করে কোলাজেন নষ্ট করতে পারে যার ফলে ত্বকে বলিরেখা ও বার্ধক্যের ছাপ তরান্বিত হয়।
American Academy of dermatology অনুসারে , মেঘলা দিনেও সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মির ৮০% পর্যন্ত ত্বকে প্রবেশ করতে পারে এবং UV রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ত্বকের ক্যান্সার হতে পারে ।
Huntsman Cancer Institute এর বিশেষজ্ঞরা যতটা সম্ভব সূর্যকে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন। বিশেষ করে সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৪ টার মধ্যে যখন সূর্যের রশ্মি সবচেয়ে শক্তিশালী হয় তখন সূর্যালোকে কম বের হওয়া উচিত। যদি এটি সম্ভব না হয় তাহলে পোশাক দিয়ে ত্বক ঢেকে রাখতে হবে। আসলে, পোশাক হল সূর্য থেকে সুরক্ষার সবচেয়ে কার্যকরী রূপ। সূর্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য এই সাতটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোশাক নির্বাচন করা উচিত :
১. শক্তভাবে বোনা ফাইবার ২. গাঢ় রঙের কাপড়, যেমন কালো বা নীল, খয়েরী, অর্থাৎ দুর থেকে দেখে কালো মনে হয় এমন কালার ৩. সিন্থেটিক ফাইবার ৪. শুকনো ফাইবার ৫. ভালো পোশাক, দীর্ঘ দিনের পুরনো বা বিবর্ণ নয় ৬. পুরো শরীর আবৃত করে এমন পোশাক ৭. UPF রেটিং সংযুক্ত পোশাক, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
এছাড়াও পোশাকের পাশাপাশি সূর্যালোক থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য পাঁচটি পরামর্শ অনুসরণের কথা বলা হয়েছে :
১. মুখ ঢেকে রাখা ২. সূর্যালোক থেকে চােখকে সুরক্ষা দেয়া ৩. ছায়ায় থাকার চেষ্টা করা ৪. দুই ঘণ্টা অন্তর অন্তর সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করা ৫. ট্যানিং বেড ও সানল্যাম্প পরিহার করা।
এ থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, একজন পর্দাশীল নারী তার আপাদমস্তক কালো মোটা কাপড় দিয়ে আবৃত করার ফলে নিজের অজান্তেই প্রকৃতির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষা পাচ্ছে এবং কোন প্রকার রূপচর্চা ব্যতিতই নিজের ত্বকের তারূণ্যকে ধরে রাখতে পারছে।
Fragnance lovers এর একটি নিবন্ধ মোতাবেক, নারীরা সুগন্ধি পরলে পুরুষরা তা লক্ষ্য করে। অনেক পুরুষ এই বিষয়টি উপভোগ করেন যখন মহিলারা হালকা এবং সতেজ সুগন্ধি পরে। সুগন্ধি পরা কোন নারী যখন পুরুষের নিকট দিয়ে যায় তখন সেই ঘ্রাণ পুরুষের মাঝে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যেখানে পারফিউমের ঘ্রাণ দ্বারা অভিভূত হয়ে পুরুষদের মনোযোগ নষ্ট হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় আরও জানা গেছে যে, পারফিউম পুরুষদের নারীদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারে - পুরুষরা সেইসব নারীদেরকে অধিক আকর্ষণীয় বলছেন যারা পারফিউম পরেন !
maison21g নিবন্ধের তথ্য মোতাবেক,
সুগন্ধি আমাদের আবেগ এবং মেজাজের উপর একটি অনস্বীকার্য প্রভাব রাখে. এগুলো আমাদেরকে পুরনো স্মৃতিতে নিয়ে যেতে পারে, আমাদের স্নায়ুকে প্রশান্ত করতে পারে, এমনকি পরবর্তী মুহূর্তের জন্য শক্তি যোগাতে পারে। ঘ্রাণ এবং আবেগের মধ্যে সংযোগ জীববিজ্ঞানের মধ্যে গভীরভাবে নিহিত। আমাদের গন্ধের অনুভূতি সরাসরি লিম্বিক সিস্টেমের সাথে যুক্ত, যা মেজাজ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংযোগের কারণেই নির্দিষ্ট ঘ্রাণগুলি স্মৃতি জাগাতে পারে, আবেগকে ট্রিগার করতে পারে এমনকি আমাদের আচরণকেও প্রভাবিত করতে পারে। যখন ঘ্রাণতন্ত্র একটি ঘ্রাণ সনাক্ত করে, তখন এটি লিম্বিক সিস্টেমে সংকেত পাঠায়, যা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা এবং সেই নির্দিষ্ট গন্ধের সাথে সম্পর্কগুলির উপর ভিত্তি করে একটি মানসিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। নিউরোট্রান্সমিটার মস্তিষ্কের রাসায়নিক বার্তাবাহক যা মেজাজ, মেমরি এবং ক্ষুধা সহ বিভিন্ন ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে। কিছু ঘ্রাণ সেরোটোনিন, ডোপামিন এবং এন্ডোরফিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ উদ্দীপিত করতে পারে, যা সুখাবেগ, প্রশান্তি এমনকি উত্তেজনার অনুভূতিও জাগ্রত করে।
ইসলামে নারীদের বাসার বাইরে এবং পরপুরুষদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কোন প্রকার সুগন্ধি ব্যবহারে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। একজন আপাদমস্তক আবৃত নারী সুগন্ধি ব্যবহার করে যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে তা বেপর্দা নারীর ক্ষেত্রেও ক্ষণস্থায়ী হয়। ইসলাম কখনই অনুমোদন করে না, কোন মুমিন নারীর উপস্থিতিতে কোন পরপুরুষের উত্তেজনা জেগে উঠুক কিংবা কোন পরপুরুষের চিত্ত প্রশান্ত হোক। এমনকি তার ব্যবহৃত সুগন্ধির প্রভাবে পরপুরুষের স্মৃতিতে সে আটকে যাবে সে পথও ইসলামে রুদ্ধ করা হয়েছে। মূলত এসব বিধি নিষেধ একজন নারীর নিরাপত্তা ও তার মর্যাদা বজায় রাখার জন্যই। আল্লাহর বিধানে বান্দার সর্বাত্মক মঙ্গল নিহিত তা দৃষ্টিগোচর হোক বা না হোক, বুঝে আসুক বা না আসুক।
পর্দা অমান্য করার কুফল
সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের যে চিত্র আমরা চারপাশে দেখে থাকি তার মূলে রয়েছে পর্দা অমান্য করা। যার ফলস্বরূপ সমাজে মহামারী আকার ধারণ করেছে জেনা, ব্যভিচার, ইভটিজিং, প্রতিহিংসা, ধর্ষণ, পরকিয়া, পারিবারিক সংঘর্ষ, তালাক, ও সকল ধরণের অশ্লীলতা। পরিবার থেকে পর্দা শিক্ষা না দেয়ার কারণে শৈশব শেষ হবার পূর্বেই শিশুরা ইঁচড়েপাকা হয়ে যায়। তিক্ত সত্য এটাই যে, পর্দা অমান্য করার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় নারী সমাজ। নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র নিত্যদিনের সংবাদ। কোমলমতি শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউই রেহাই পাচ্ছে না সহিংস আচরণ হতে। যখন কোন মেয়ে বা নারী ভালো বেশভুষা পরিধান করে রাস্তা দিয়ে হেটে যায় তখন আর সে মায়ের জাতি থাকেনা। কামুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে লোলুপ দৃষ্টির পিপাসা মেটানোই যেন তখন মূখ্য বিষয়। বোকা জাতি এটাও বুঝে না যে, কতিপয় স্লোগানের বুলি আওড়িয়ে (মনের পর্দা আসল পর্দা, my body my choice) তাদের পথে নামিয়ে কামুক পুরুষরাই তাদের পিপাসা মেটাচ্ছে। সম্মানের নামে কোন পর্যায়ের যে অসম্মান করা হচ্ছে তা ভেবে দেখছে না। বিনোদনের নামে অশ্লীল চিত্র দেখা, সৌন্দর্য প্রদর্শনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, বেহায়াপনা ও নিজেদের দাম্পত্য জীবনকে অপরের সাথে তুলনা করার কারণ হচ্ছে দৃষ্টি সংবরণ করতে না পারা। এই দৃষ্টি সংযত না রাখার জন্যই মানুষ খুব সহজেই নির্লজ্জ কাজে জড়িয়ে পড়ে। আর যারা তাদের অশ্লীল চাহিদা পূরন করার জন্য কোন সঙ্গী পায় না, তখন অবৈধ কামনা চরিতার্থ করার জন্য কোলের শিশু থেকে বয়োঃবৃদ্ধা যে কেউ তাদের ধর্ষণের শিকার হয়। ফলস্বরূপ দেখা যায়, অসংখ্য ভ্রূণ হত্যা ও ডাস্টবিনে পলিথিনে মোড়ানো শিশুদেহ (জীবন্ত বা মৃত), কখনো সেই নিষ্পাপ শিশু হয় কুকুরের খাবার। পর্দা না মানার কারণে দিন দিন পরিবার প্রথা ভেঙ্গে যাচ্ছে। লিভ টুগেদারের মত ক্ষনিকের সম্পর্কগুলোর কারণে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে পরিবার ব্যবস্থা। বিবাহ নামক দায়িত্ব গলায় না পড়েই সকল স্বাদ বিনে পয়সায় পাওয়া যাচ্ছে। আর যারা বিবাহিত তাদের দৃষ্টিতে ঘরের রমনীর হাজারো দোষ দৃষ্টিগোচর হয়, সহকর্মী যেন অপরূপা, সর্বগুণে ভুষিত। পর্দা অমান্য করার ফলে মানুষ যত্রতত্র পরকিয়ায় লিপ্ত হচ্ছে, দীর্ঘদিনের পারিবারিক সম্পর্ক ও আত্মীয়তার সম্পর্কে ফাটল ধরছে। এতে করে বৈধ সম্পর্কগুলো দুর্বল হচ্ছে এবং অবৈধ সম্পর্ক আসকারা পাচ্ছে। এমনকি মানুষ নিজেদের অবৈধ কামনাগুলো পূরণ করার জন্য খুন পর্যন্ত করে বসে।
পরিশেষে বলতে চাই,সম্মানিত দ্বীনি বোন আমার, আপনি একজন মুসলিম পরিবারের মেয়ে, মুসলিম পরিচয়েই আপনি জীবন যাপন করছেন। আপনার ধর্ম আপনাকে সর্বোচ্চ সম্মান দান করেছেন। আপনার মৃত দেহটি পর্যন্ত কোন পরপুরুষের দেখার অনুমতি নেই, আপনাকে কবরস্থ করার অধিকারও কেবল আপনার মাহরাম পুরুষদের আছে। এক সেকেন্ডের জন্যও যাতে আপনি কোন কাম দৃষ্টির খোরাক না হন সেই জীবনব্যবস্থা ইসলাম আপনাকে দান করেছেন। আপনি পতিতা নন যে কিনা তার রূপ প্রদর্শন করে খদ্দের জোগাড় করে, আপনি ক্রীতদাসী নন যাকে প্রদর্শন করে বাজারের পণ্যের মত বিক্রি করা যায়, আপনি কোন বিভৎস চেহারার নারী নন যাকে দেখলে লোকে ভয়ে পালাবে, আপনি বয়সের ভারে চামড়া কুঁচকে পড়া কোন বৃদ্ধা নন যাকে দেখলে কারও কাম জাগবে না, আপনি অন্য রমণীর সাথে রূপের প্রতিযোগিতায় নিজেকে সজ্জিত করে প্রদর্শন করবেন না। আপনাকে আল্লাহ সর্বোত্তম গড়নে সৃষ্টি করেছেন যেমনটি তিনি আপনার জন্য পছন্দ করেছেন। পুরুষজাতি নারীজাতির প্রতি দুর্বল, আপনাকে এমনভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে যে তারা আপনার দিকে তাকাবেই। আপনি কখনোই সকলের দৃষ্টি সংযত রাখতে বাধ্য করতে পারবেন না। আপনার রূপে মুগ্ধ হয়ে কেউ হয়তো তার অবদমিত কামনা চরিতার্থ করার জন্য হাতের কাছে যাকে পাবে তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালাবে। নিজের অজান্তেই আপনি কোন বোনের সর্বনাশের কারণ হয়ে গেলেন। যাকে বন্ধু ভেবে হাসিমুখে গল্প করছেন সেই পুরুষ না জানি কত হাজারবার নিজের অজান্তেই আপনাকে ভেবে কল্পনার জগতে ডুব দিয়েছেন। ইসলাম আপনাকে এতটাই সম্মান দিয়েছে যে, চারজন চাক্ষুষ সাক্ষী ব্যতিত কেউ আপনার উপর অশ্লীলতার অপবাদ দিতে পারবে না।
لَوۡلَا جَآءُوۡ عَلَیۡہِ بِاَرۡبَعَۃِ شُہَدَآءَ ۚ فَاِذۡ لَمۡ یَاۡتُوۡا بِالشُّہَدَآءِ فَاُولٰٓئِکَ عِنۡدَ اللّٰہِ ہُمُ الۡکٰذِبُوۡنَ
তারা (অর্থাৎ অপবাদদাতাগণ) এ বিষয়ে কেন চারজন সাক্ষী উপস্থিত করল না? সুতরাং তারা যখন সাক্ষী উপস্থিত করল না, তখন আল্লাহর নিকট তারাই মিথ্যুক।(আন নূর - ১৩)
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَرۡمُوۡنَ الۡمُحۡصَنٰتِ الۡغٰفِلٰتِ الۡمُؤۡمِنٰتِ لُعِنُوۡا فِی الدُّنۡیَا وَالۡاٰخِرَۃِ ۪ وَلَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ۙ
স্মরণ রেখ, যারা চরিত্রবতী, সহজসরল, মুমিন নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত হয়েছে আর তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি।(আন নূর - ২৩)
সম্মানিত দ্বীনি ভাই, আপনার ঘরের নারী আপনার দায়িত্ব, সে হতে পারে আপনার জন্মদানকারী মা, হতে পারে আদুরী বোন, হতে পারে আপনার চিত্তপ্রশান্তকারী ঘরের রমণী, হতে পারে কলিজার টুকরা কন্যা। তাকে মূল্যায়ণ করুন, তাকে নিরাপত্তা দিন, আপনার সম্মান আপনার যত্নের সবচেয়ে বেশি হক্কদার আপনার ঘরের নারীরা। আপনার আমল আখলাক কিছুই কাজে আসবে না যদি আপনি দাইউসের কাতারে দাড়িয়ে যান। তাই নিজের চরিত্র সংরক্ষণ করুন এবং অপরকেও চরিত্র সংরক্ষণে সাহায্য করুন। ভবিষ্যৎ সমস্যা ঠেকাতে পরিবারের ছোট ছেলেমেয়েদের শৈশব থেকেই পর্দাচর্চার অভ্যাস গড়ে তুলুন। আমার আপনার আমাদের সচেতনতার ফলেই গড়ে উঠবে একটি নিরাপদ প্রজন্ম, সুস্থ সমাজ।৷
আল্লাহ আমাদের সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুন। আমীন! ]