১. অদ্ভুত মোহ মায়ার জগৎ এটা। সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে জেনেও বারবার আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টায় রত থাকি। শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে কেউ আর বেশি ক্ষণ পাশে থাকবে না। একা অন্ধকার ছোট্ট একটা বায়ুরুদ্ধ মাটির ঘরে রেখে আসে। হয়তো মাঝেসাঝে কেউ যেয়ে ঘরটার পাশে ঘুরে আসে কিন্তু ঘরের ভিতরের মানুষটার কি কোন খোঁজ করে? সময়ের কালক্রমে দেহটা মাটির মাঝে বিলীন হয়ে যায়, পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায় ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর বুকে বেড়ানো একটা দেহের অস্তিত্ব। একটা সময় নামটাও যেন স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যায়। কিন্তু আত্মার জগতের কি ব্যাখ্যা আছে? নশ্বর আর অবিনশ্বর দুটি বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত মানুষ। নশ্বর অংশ টুকু ক্ষণস্থায়ী জমিনে বিলীন হয়ে যায় আর অবিনশ্বর অংশ চলে যায় তার আপন ঠিকানায়।
২. প্রকৃতি মানুষের সবচেয়ে বড় পাঠশালা। আর এই প্রকৃতির মাঝে মানুষ নামক প্রাণীগুলো বড়ই বিচিত্র। এই প্রজাতির সাথে যত মেলামেশা করা হয়, ততই নিজের ভিতরের সরলতা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। পক্ষান্তরে প্রকৃতির মাঝে অন্য সৃষ্টিগুলোর যত বেশি নিকটে যাওয়া যায়, মন ও মস্তিষ্ক যেন তত বেশি উদার আর প্রশস্ত হয়। স্বার্থপর এই পৃথিবীতে স্বার্থ ত্যাগী মানুষ খুব কমই দেখা যায়। বাধ্য হয়ে সহ্য করা আর হাসিমুখে নিজের ইচ্ছে বিসর্জন দেয়া তো আর এক জিনিস নয়। তারপরও দুর্বল চিত্ত সময় অসময়ে বিষন্ন হয়ে ওঠে।
৩.জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন মানুষের কাছে নিজেকে জলপাই মনে হয়। জলপাই থেকে যখন তেল প্রস্তুত করা হয় তখন প্রচুর চাপ প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু জলপাই তো কিছু বলতে পারে না। এই তেলে তেমন ঘ্রাণও থাকে না যে লোকে বুঝতে পারবে এটা জলপাইয়ের তেল কিন্তু এ তেলের গুণাগুণ অনেক বেশি। জলপাই তার পরিচয় ব্যতিরেকেই অপরের উপকার করে যায়। জলপাই আর মানুষের মধ্যে তফাৎ হচ্ছে মানুষ তার যন্ত্রণাটা প্রকাশ করতে পারে।
৪.একটা মানুষ যখন কারো কাছ কিছু ধার নেয়, অর্থ কিংবা পণ্য, সে শুধু ওই জিনিসটাই ধার নেয় না। বরং কাঙ্ক্ষিত বস্তুর সাথে সে পাওনাদারের ভরসাটুকুও ধার নেয়। হয়তো সে বস্তুগত ধার শোধ দিতে পারলেও সে ভরসাটুকু আর ফেরত দিতে পারে না। আবার এমনও হয়, বস্তুগত শোধ তো ততটুকুই দেয়, যতটুকু নিয়েছিলে কিন্তু ভরসা কয়েকগুন বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে ফেরত দেয়।
৫.মানুষ কতটা অদ্ভুত। আমরা লোকের যে ব্যবহারটা অপছন্দ করি, সেটাই নিজেরা আবার করে বসি। যে আঘাতটা আমরা পাই, সেটাই আবার অন্যকে দেই। নিজেরা ক্ষমার প্রত্যাশা করি কিন্তু অপরের বেলায় কার্পণ্য করি। নিজেরা প্রতিদান কামনা করি কিন্তু অপরকে স্বার্থান্বেষী বলি। এই গোলার্ধের মানুষগুলোর চিন্তা ভাবনাও গোল গোল, সরল সোজা নয়। আবার একদিক দিয়ে সোজাসাপ্টা আচরণ, যা শিখি তাই করি। কি করতে হবে না তা শিখা অনেকটা স্রোতের প্রতিকূলে চলার মত। অনুকরণ করে শিখা অনেক সহজ এবং এটা অতি সহজে মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারে। পক্ষান্তরে কোন কিছু দেখে তা না করতে শিখা খুবই কঠিন। বারবার মস্তিষ্ককে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় তা না করার শিক্ষাটা। একটা বিপরীতমুখী অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। তারপর একটা সময় অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়।
৬.মানুষ বড়ই স্বার্থপর, সে নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে এবং সবার মাঝে নিজের প্রতিবিম্বই খুঁজে বেড়ায়, বাহ্যিক কিংবা অভ্যন্তরীণ। তাদের সাথেই চলাফেরা করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে যাদের মাঝে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। চলনে, বলনে, পোশাকে, স্বভাবে, পছন্দে, অপছন্দে, বয়সে, মননে কোন একটা বিষয়ে যার সাথে মিল খুঁজে পায় তার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
৭.সময়ের কালক্রমে হারিয়ে যাবো চিরতরে। আর এ সুন্দর নিষ্ঠুর পৃথিবীর বুকে দেখা হবে না। কথাও হবে না। মাঝেমাঝে আমার স্মৃতিগুলো উঁকি দিবে এর ওর হৃদয়ে। হয়তো আমার স্মৃতিচারণে আমায় নিয়ে দু এক কথা হবে। ধীরে ধীরে খুব কম আমার কথা স্মরণ হবে। তখন আর তেমন একটা কথা তুলবে না, স্মরণ হওয়া মাত্রই শেষ। সে হয়তো জীবন ভাগ করে নেওয়ার জন্য অন্য কাউকে বেছে নেবে। সন্তানরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে খুব মনে করবে আর বাকী সময়টা নিজেদের জীবন গুছানোয় ব্যস্ত থাকবে। বার্ধক্যের সময় ভাইবোন আর বন্ধু বান্ধবরা প্রায়ই মনে করবে। বার্ধক্যের এ সময়টা খুব কঠিন আর একাকী। তখন শৈশবের কাটানো স্মৃতিগুলোই যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রজন্মের পালাবদলে আর কোন স্মৃতিচারণ নেই, হারিয়ে যাবে লক্ষ কোটি বার ডাকা নামটিও।