১
ছোট্ট মাটির তৈরি রাস্তা চলে গেছে গ্রামের মাঝ বরাবর। রাস্তার দুই দিকে ধানি জমি। ধানের চারা লাগানো থেকে শুরু করে ফশল ঘরে তুলার পূর্ব পর্যন্ত গ্রামের কৃষকেরা দল বেঁধে কাজ করে এই জমিগুলিতে। অগ্রাহায়ন মাসের শেষ এবং পৌষ মাসের শুরুর সময়টা ধান কেটে ঘরে তুলবার সময়। এই সময়ে গ্রামের নওজোয়ান হতে শুরু করে কোন পুরুষ লোকের বিশ্রাম নেবার অবকাশ নেই। কার ঘরে কত বেশি ধান আসল তার প্রতিযোগিতা করবার সময় এই অগ্রাহন মাস। অগ্রাহন শেষ হয়ে গেলে বৈশাখের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে মাঠে কৃষকদের আর কাজ থাকে না। বিস্তীর্ন ফাঁকা মাঠ গরু-বাছুরদের স্বর্গ রাজ্যে পরিনত হয়। অপরাহ্নের পর হতে গোধূলির পূর্ব পর্যন্ত সময়টা ছোট ছেলেমেয়েদের খেলাদুলা,ছুটাছুটি,দৌড়াদৌড়ি আর পারস্পরিক ঝগড়া বিবাদ মাঠের পরিবেশকে অন্যরকম করে রাখে।
এই রকম এক পরিবেশে কুলসুম মাঠে গোল্লাছুট খেলছিল। কুলসুমদের বাড়ি মাঠের উত্তর-পূর্ব কোণে। সে তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর একমাত্র মেয়ে। তার সৎ মায়ের পক্ষের আরো চার ভাই আছেন। চার ভাই আর দুই মায়ের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি লেগেই থাকে। কুলসুমদের খেলা শেষ হবার পূর্বেই তার বাড়ির দিক হতে কান্নাকাটির শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। খেলা শেষ না করেই কুলসুম দৌড় দিল তার বাড়ীর দিকে। সে ভাবছিল হয়ত প্রতিদিনের মত আজও গিয়ে দেখতে পাবে দুইজন মারামারি করছে,কেই একজন হয়ত মারামারি থামাতে গিয়ে বার বার ব্যার্থ হচ্ছে,আবার কিছু লোক হয়ত মারামারি দেখে মজা পাচ্ছে। কিন্তু আজকে সে বাড়ীর উঠানে পা রাখতেই দেখতে পেল কেউ একজন বারান্দায় শুয়ে আছে। আর তাকে ঘিরে সবাই কান্নাকাটি আর বিলাপ করে যাচ্ছে। কুলসুমকে আসতে দেখে গ্রামের বুড়ি তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,কুলসুমের বাবা আর এই দুনিয়াতে নেই। তিনি খোদার কাছে চলে গেছেন।বু ড়ি কুলসুমকে কান্নাকাটি করতে বলে আবার বিলাপ করা শুরু করে দিল।
বাবার মৃত্যের পর কুলসুমের ভাইয়েরা গ্রামের মোড়লকে ধরল তাদের সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়ার জন্য। মোড়ল এবং গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বী গোছের লোক আলাপ আলোচনা করে একটি তারিখ ঠিক করে দিলেন যেন গ্রামের সবাই বৈটকে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কোন ভাই বাড়ির কোন অংশ পাবেন। বৈটকের দিন কুলসুমদের বাড়ীতে বিরাট খাবার দাবার ও চা-নাস্তার ব্যাবস্থা করা হল। গ্রামের মুরব্বীদের আহার করানো হল। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক জমি-জমা বন্টনের জন্য একজন মোল্লাকেও বৈটকে নিয়ে আসা হল। মোল্লা সাহেব বললেন প্রত্যেক ভাই সমান অংশ পাবে। কুলসুম ও তার মায়ের জন্য মোট সম্পত্তির ছয় ভাগের একভাগ বরাদ্ধ থাকবে। কুলসুমদের যেহেতু আপন ভাই নেই, তাই তার ও তার মায়ের ভরন-পোষনের দায়িত্ব তার চার সৎ ভাই বহন করবে। বাড়ির পূর্ব কোণে কিছু জায়গা বাড়তি ছিল। এই জায়গাটুকু কুলসুম ও তার মায়ের জন্য রেখে বাকি অংশটুকু সমান চার ভাগে ভাগ করা হল। প্রথমে ছোট ভাই,তার পর মেজো ভাই এবং সবশেষে সেঝো ভাই যার যার প্রাপ্য অংশ বেছে নিলেন এবং অবশিষ্ট্য এক চতুর্থাংশ বড় ভাইয়ের ভাগে পড়ল। বৈটকের শেষ পর্যায়ে এসে চার ভাইয়ের একে অপরের সাথে কোলাকুলি করলেন এবং তারপর বৈটক শেষ হয়ে গেল। কুলসুম ও তার মা কয়েকদিন এই ভাইয়ের ঘর তার পর অন্যভাইয়ের ঘর, এই রকম করে দিন কাটিয়ে যেতে থাকলো। একদিন কুলসুমের বড় ভাই তার মাকে বললেন, কুলসুম বড় হয়েছে তার বিয়ে শাদীর ব্যবস্থা করা দরকার। কুলসুমের মা বললেন, তুমরা বড় ভায়েরা আছ যা ভাল মনে কর তাই কর। গ্রামের ঘটককে ঢাকা হল এবং কিছুদিনের মধ্যেই কুলসুমের বিয়ে হয়ে গেল।
২
এক ভাইয়ের ঘর হতে অন্য ভাইয়ের ঘর এইরকম করে কুলসুমের মায়ের আরো কিছু দিন চলল। তার পর একদিন মেঝো ভাই বললেন, ঘর বদল করে খেতে মায়ের অনেক কষ্ঠ হয়। তাই একজন যদি দায়িত্ব নেয় তবে মাকে আর কষ্ঠ করে এ ঘর হতে ওঘর করতে হবে না। কোন ভাই নিজ উদ্দ্যেগে মায়ের দায়িত্ব নিতে না চাইলেও লোক লজ্জার ভয়ে বড় ভাই বললেন, আমার ছেলে মেয়েরা যদি খেতে পায় তাহলে মা না খেয়ে থাকবেন না। বড় ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা দাদিকে পেয়ে খুবই আনন্দিত হল। রাতের খাবারের পর দাদির মুখে গল্প শুনতে না পেলে ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের ঘুম আসতে চাইত না। একদিন রাতের খাবারের পর কুলসুমের বড় ভাই তার মাকে বললেন,তোমার তো ছেলে মেয়ে বলতে শুধু আমি-ই। আমি তোমার দেখাশুনা করব। আমার হঠাৎ করে কিছু টাকার প্রয়োজন, তাই তোমার নামের জায়গাটুকু যদি আমাকে দিয়ে দায় তাহলে ভালো হয়। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বিধবা তার শেষ সম্ভলটুকু ছাড়তে রাজি হলেন না।এই ঘটনার পর হতে বড় ভাইয়ের বউ এর মুখে নানা ধরনের কথা শুনতে লাগলেন কুলসুমের মা।
কুলসুমের মা চিন্তা করলেন তার জায়গায় একটি ঘর তৈরি করে একা একা বসবাস করবেন। সামান্য সঞ্চয় যা তার কাছে ছিল সব ব্যয় হয়ে গেল মাটি কেটে ভিটে তৈরি করতেই। গ্রামের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল এবং ধনী লোকদের কাছে কুলসুমের মা সাহায্য চাইলেন। মোড়ল বললেন, ছেলেদের সাথে থাকলে হয়ত একটু অসুবিধা হবে কিন্তু এতে সম্মান আছে। একা একা ঘর তুলে আলাদা ভিটেতে থাকলে একদিকে ছেলেদের যেমন অসম্মান হবে তেমনি লোকজনও কথা শুনাবে। তারপরেও গ্রাম হতে সামান্য যে সাহায্য পাওয়া গেল তা দিয়ে ঘরের একটি দেয়াল ও তুলা সম্ভব হল না। এই দিকে কুলসুমের খোঁজ-খবর নিতে গেলেও টাকার প্রয়োজন। তাই বিধবা এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিলেন। ঘরের জন্য তৈরি করা ভিটেটা পড়ে রইল শুন্য ফশলবিহীন মাঠের মত।
৩
কুলসুমের মাকে নিয়ে চার ভাইয়ের মধ্যে গণ্ডগোল লেগেই থাকত। কুলসুমের ভাইদের ঘর পাশাপাশি থাকার কারনে ঝগড়া ঝাটির পরিমান দিন দিন বাড়তে লাগল। গণ্ডগোলের সুবাদে কুলসুমদের বাড়িতে গ্রামের মুরব্বি টাইপের লোকদের আনাগোনা ক্রমেই বাড়তে থাকল। একদিন দুই ভাইতে মারামারি হওয়ায় গ্রামের মসজিদের বারান্দায় শালিশ ঢাকা হল। শালিশ চলাকালিন সময়ে একজন বয়স্ক লোক বললেন এই পরিবারে অশান্তি আসার মূল কারন হল আল্লাহর রহমত না থাকা। আল্লাহর রহমত নাই কারন কুলসুমের বাবা জীবিত থাকতে বাড়ির পূর্ব পাশে মসজিদ তৈরি করার জন্য কিছু জায়গা দিয়েছিলেন। অতছ এই জায়গায় কোন মসজিদ তো নাই উল্টো মসজিদের জায়গায় গরূ ছাগল চরানো হচ্ছে। মসজিদের জায়গার সাথে অসম্মান করা হলে কিভাবে শান্তি আসবে? ওই ব্যাক্তির কথার সাথে সকলেই একমত পোষন করলেন। গ্রামের মোড়ল কুলসুমের ভাইদের মসজিদের জায়গা আলাদা করে দেয়ার কথা বলে শালিশ শেষ করে দিলেন।
কুলসুমের ভাই এবং গ্রামের লোকেরা অনেক মাপ-ঝোঁক দিলেন মসজিদের জায়গা চিহ্নিত করার জন্য। একজন বললেন কুলসুমের বাবা মসজিদের জন্য যে জায়গাটি দিয়েছিলেন ঠিক সেই জায়গায় মসজিদটি হতে হবে। তা না হলে ওছিয়ত পূর্ণ হবে না। শেষ পর্যন্ত মসজিদের জায়গা হিসেবে বাড়ির পূর্ব কোণে কুলসুম ও তার মায়ের জমির কিছু অংশ সহ দুই শতক জমি চিহ্নিত করা হল। শুক্রবারে নামাজের পূর্বে মসজিদ তৈরির গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে মোল্লা সাহেব একটি জোরালো বক্তব্য রাখলেন। মসজিদ তৈরির উদ্দেশ্যে মোড়ল সাহেব প্রথমেই বড় অংকের চাঁদা দিলেন। গ্রামের সকল ধনী লোক বড় বড় অংকের চাঁদা দিলেন। মোল্লা সাহেবকে সভাপতি ও মোড়লকে সেক্রেটারি করে তিন সদস্য বিশিষ্ট্য মসজিদ তৈরি সংক্রান্ত কমিটি করা হল। এক মাসের ভিতরেই মসজিদের কাজ শেষ হয়ে গেল। শ্রাবন মাসের এক বৃষ্টি মুখর দিনে নতুন মসজিদ উদ্ভোধনের জন্য মিলাদের তারিখ ঠিক করলেন মোল্লা সাহেব। নির্দিষ্ট দিনে মিলাদ উপলক্ষে বিশাল খাবারের আয়োজন করা হল। মহা দুমদামে মসজিদের উদ্ভোধন হয়ে গেল। খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশগুলো পড়ে রইল কুলসুমের মায়ের অর্ধপ্রস্তুত ভিটের উপর।
৪
গ্রামের সকল লোক-ই অনেক খুশি।নতুন একটি মসজিদ তৈরি করতে পারায় এলাকার মধ্যে কুলসুমদের গ্রামের সুনাম এবং সম্মান অনেকটাই বেড়ে গেল।