স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলাম সেদিন। গাছ গাছালিঘেরা ছোট একটা বাড়ি। মুক্ত বাতাস, আকাশলীনা নীল। যেনো পৃথিবীজুড়ে স্থবিরতা। স্থবিরতায় তবু পাখিদের কোলাহল, পাখিদের গান শোনা যায়। বাড়িটার ছাদে বন্ধু বান্ধব নিয়ে সবুজের সমারোহ বাংলার প্রকৃতি দেখছি। এমন সময় সুন্দর দুটো পাখি আসল। দেখে চোখে শান্তি পাওয়া যায়। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। পাখি আমাদের ভয় পাচ্ছে না একটুও। আমরা পাখির দিকে এগোচ্ছি, তবুও না। উল্টো পাখিই আসল আমাদের কাছে। পাখির সাথে খেলতে শুরু করেছি। ছবি তুলছি। পাখিগুলো অনেক সাহসী। পৃথিবীর রঙ পৃথিবীর সব আয়োজন যেন পাখিদের জন্যেই। নিঃশ্বাস ভরে অক্সিজেন নিতে পারছে। যেনো পৃথিবীটা ওদের জন্যই তৈরি। স্বপ্নটা সত্যিই স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর ছিল যেনো।
স্বপ্নের কথা মনে থাকলে আর সব কাজ ফেলে রেখে স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে থাকি। স্বপ্নের স্মৃতিতে হাতড়ে বেড়াতে ভালো লাগে ভীষণ। কিন্তু সেদিন ভাবনার অবকাশ পেলাম না।
কারণ
টেলিভিশন অন করতেই, সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বুলাতেই করোনা আর করোনার খবর। জাতীয়, বিনোদন, খেলাধুলা, আন্তর্জাতিকসহ সব ধরণের খবরই করোনাকে ঘিরে।
গোলা বারুদের বিষাক্ত গন্ধে; বিস্ফোরণের নিঃশব্দ করে দেয়া শব্দে পৃথিবীটা কেঁপে উঠেছে বহুবার। বহুবার। এতে কত প্রাণ যে হারালো, কত মায়ের অশ্রু ঝরেছে তার হিসেব নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ, কারোই রেহাই নাই গুলি কিংবা বারুদের সামনে।
ভ্রমণপ্রিয় মানুষটা আজ ভ্রমণে বেরোচ্ছে না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো আড্ডাবাজ মানুষটা আড্ডা দেয় না, বোহেমিয়ান ছেলেটাও নিয়ন্ত্রিত জীবন শুরু করেছে। স্বেচ্ছার ঘরবন্দী জীবন মেনে নিচ্ছে। কেন হঠাৎ এমন বদলে যাওয়া? আবারো যে পৃথিবী নামক গ্রহটা কেঁপে উঠেছে। তবে এবারকার কাঁপণে গোলা বারুদের গন্ধ নাই, বিস্ফোরণের গগণবিদারি শব্দ নাই । তাহলে কিসে? কেঁপে উঠেছে মাত্র ১২০ ন্যানোমিটারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনা নামের ছোট্ট একটা অনুজীবের কারণে যেটাকে খালি চোখে দেখা যায় না। ভাবা যায়!
আড্ডাবাজ, বোহেমিয়ানদের যে চিত্রটা উপরে আপনারা দেখলেন সেটাকে পুরো বাংলাদেশের চিত্র ভেবে ভুল করবেন না যেন। এইটে শহরের শিক্ষিত সচেতন মানুষের একটা খন্ডচিত্র হতে পারে, পুরো দেশের কোনভাবেই না।
সমগ্র দুনিয়ার মানুষ মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত, দিশেহারা। পালিয়ে বেড়াচ্ছে যেনো।। পবিত্র নগরী মক্কা মদিনায় জামাত হচ্ছে না। দেবালয়গুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ডাক্তাররাও রোগীর কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে।। দেশে দেশে লক ডাউন চলছে...
করোনার ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কারের জন্য ডাক্তার, বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে গবেষণার পর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীশুদ্ধ মানুষ করোনার করাল ঘ্রাস থেকে বাঁচতে মরিয়া। আমরাও এর বাইরে নয়। ওয়ার্ল্ড মিটার ওয়েবসাইটে চোখ রাখি একটু পরপর। ক্রিকেট সাইটে রিফ্রেস দিলেই যেভাবে নতুন ফলাফল আসে, ওয়ার্ল্ডমিটারেও প্রতি সেকেন্ডে করোনা রোগীর সংখ্যা আপডেট হচ্ছে৷ বেড়েই চলচে ক্রমাগত৷ মৃত্যুহার বাড়তে বাড়তে বিশে পৌছে গেছে।
গতকাল দেখেছি মৃত্যসংখ্যা ৪৬, হাজার। আজকে সেটা ৫০ হাজারেরও উপরে। রীতিমতো যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি। হ্যাঁ, আসলেই এটা যুদ্ধ। এইটে নিরব যুদ্ধ যেখানে রাসায়নিক অস্ত্রের পৃথিবী বিষাক্ত করে দেয়া গন্ধ নাই বুলেট ছোঁড়ার কিংবা বোমা ফাটানোর নিঃশব্দ করে দেয়া শব্দ নাই। কখন জানি করোনা জীবটা আমার শরীরে ঢুকে পড়ে। মৃত্যুভয় ঘুম কেঁড়ে নিচ্ছে। তবে মরতে হলে যুদ্ধ করেই মরবো।
যে জীবটাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কিভাবে করব?
যুদ্ধ বলতে এখন প্রতিরোধ করা। স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। হাত না ধুয়ে চোখে মুখে হাত না দেয়া। মোদ্দাকথা, পপরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থাকা। যুদ্ধটা কিভাবে করতে হবে, টেলিভিশনে, পত্রিকায় বারবার শেখানো হচ্ছে। এসব দেখে আতঙ্ক খানিকটা কমে। লড়াই করার মানসিকতা জেগে উঠে।
কিন্তু আমার দেশের মানুষের এত সব করার কোন দরকার নাই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা এদের মেনে চলার দরকার নাই। কারণ, এদের আছে ঈমানী শক্তি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার এদের দরকার নাই।
বাঙ্গালী মুসলমানদের সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার দরকার নাই। কারণ ওরা বিশ্বাস করে, আল্লাহ রোগ দিছে আল্লাহই ভালো করবে। এদেরকে এদের বিশ্বাস বাঁচিয়ে দিবে।
বাঙ্গালী মুসলমানদের একজন আরেকজন থেকে তিন ফুট দুরত্বে অবস্থান করার দরকার নাই। কারণ, ইসলামে কোন ছুঁয়াচে রোগ নাই। দাঁড়ান ভাই, আরো কড়া যুক্তি আছে। যে লোকে ছুঁয়াচে রোগ আছে বিশ্বাস করবে তার ঈমান থাকবে না। অতএব এদেশের মানুষদের মুসাফা করা, কোলাকুলি করা থেকে কোন যুক্তিতে বিরত থাকবে?
ডাক্তাররা, বিজ্ঞানীরা ওষুধ তৈরির জন্য দিন রাত এক করে গবেষণা করে যখন ওষুধ পাচ্ছে না তখন আমার বাংলাদেশের মানুষেরা ওষুধ বের করে ফেলছে। মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের মহৌষধ কালোজিরা। অতএব বাঙ্গালীরা কেন ওসব করোনাকে ভয় পেতে যাবে? তাছাড়া থানকুনি পাতা আছে।
শুধু মাত্র মুসলিমরা ওষুদ বের কবে আর হিন্দুরা বুঝি চেয়ে চেয়ে দেখবে গোমূত্র খেলেই ওদের রোগ সেরে যায়। পাশের দেশ ভারতে পার্টি করে গোমূত্র খাওয়ার আয়োজন হচ্চে।
যুদ্ধ করার যে শক্তি সঞ্চয়ে ছিল তা নিমিষেই উড়ে যায় এসব ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মূর্খতামি দেখে। আতঙ্ক ফের ঘ্রাস করে আমায়।। তবে সেটা মহামারির জন্য জন্য, ধর্মান্ধতা ও মূর্খতার জন্য। কোভিড-১৯ আসার আগেই উপলব্ধি হল, মহামারির চেয়ে হাজারগুণ বেশি ভয় পাই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মূর্খতাকে।। এসব কারণেই পৃথিবীটা একদিন ধ্বংস হবে। বলছিলাম স্বপ্নের কথা। কিন্তু এতকিছুর পর স্বপ্ন নিয়ে ভাবনার আর সুযোগ থাকে কই?
আর মহামারি আমাদের তো প্রাপ্যই ছিল। ভাবছেন, কি বাজে বকছি বুঝি! শুনুন তাহলে....
প্রকৃতি আমাদের বড্ড বেশিই ভালোবাসে। আমরা যখন ফসলের মাঠে পস্রাব করি, মল ত্যাগ করি তখনো প্রকৃতি প্রতিবাদ করে না। বলে না যে, তোমরা আমার উপর মলমূত্র ত্যাগ কর অতএব আমি ফসল দিব না তোমাদের। আমাদের প্রতি তার ভালোবাসায় কমতি আসে না। সময় হলে ফসলের ক্ষেতে সোনা ফলে ঠিকই।
গাছের কথাই বলা যাক না। আমাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হল গাছ। আমাদের কোন উপকারটা গাছ করে না? জন্ম থেকেই কার্বন ডাই অক্সাইড তুলে নিচ্ছে। আমাদের সুন্দর ফুল দিচ্ছে। ফল দিচ্ছে। ফুলের সুগন্ধে প্রাণ মেতে উঠে, ফল খেয়ে পুষ্টি গ্রহণ করি। সবচেয়ে বড় কথা হল বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন দরকার হয় সেটা গাছ থেকেই আমরা পাই। এজন্য আমাদের উচিৎ বেশি বেশি গাছ লাগানো। কিন্তু আমরা মানুষ মারাত্মক কৃতঘ্ন জাতি। গাছ না লাগায়ে উল্টো গাছ কাটি। বৃক্ষরোপণের বদলে বৃক্ষ নিধন করে কার্বণ ডাই অক্সাইড বাড়িয়ে দেই। তবু গাছ আমাদের বলে না, তোমরা আমাকে কেটে ফেলো অতএব তোমাদের আর অক্সিজেন দিব না, কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নিব না। সত্যিই, প্রকৃতির ভালোবাসা বড্ড বেশি।
শুধু তাই নয়, আরো যে কত্ত ভাবে পৃথিবীটাকে দূষণ করছি তা লিখে শেষ করা যাবে না। পৃথিবী দূষণের উল্লাসে মেতে উঠেছে মানুষ। দরিদ্ররা না খেয়ে মরলেও কার থেকে কে বেশি করবে এমন প্রতিযোগিতায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে একেকটা দেশ। জাপানের হিরোশিমার কথাটাই ভাবুন না একবার।
তো এত কিচ্ছুর পরে আপনার কি মনে হয় না, একট মহামারি আমাদের প্রাপ্য ছিল?
স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর স্বপ্নটার ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু একটা সুখবর শোনে আবারো মনে পড়ল।
কক্সবাজার সৈকতে মানুষ নেই ক'দিন ধরে। এরইলে ঝাঁকে ঝাঁকে ডলফিন এসেছে সেখানে। রুপোলী রঙের ডলফিনেরও দেখা মেলেছে। এই ডলফিনেরা কোথায় কেন লুকিয়ে ছিল এতদিন মনে কি প্রশ্ন জাগে একটিবারও? ডলফিনে লাফালাফি, ঝাপাঝাপিতে আনন্দ উল্লাসের ঝিলিক দেখি। এতদিন ওদের এই অবাধ স্বাধীনতা আমরা দেইনি। আমরা মাবুষের ভয়ে এতদিন ওরা আনন্দ উল্লাস করতে পারেনি।
স্বপ্নের পাখিটা কিংবা বাস্তবের ডলফিন পুরো পৃথিবীর প্রাণীকুলের দৃশ্যটাই কি বহন করে না? করোনা বদলে দিয়েছে পৃথিবী। আরো বদলাবে। সেদিন ফেসবুকে একটা পোস্টে দেখলাম। মানুষ ঘরবন্দি বলে, আকাশে বিমান উড়ছে না বলে, কলকারখান বন্ধ বলে পৃথিবী দূষণ অনেকটা কমে গেছে। এভাবে কয়েকটা মাস গেলে পঞ্চাশ পার্সেন্ট দূষণ কমনে। করোনা পরবর্তী পৃথিবী ফিরে যাবে আজ থেকে ৫০০ বছর পূর্বে। প্রকৃতি হবে সুন্দর। বাতাস হবে বিশুদ্ধ। প্রাণীরা প্রাণভরে বিশুদ্ধ বাতাসে অক্সিজেন নিবে। ঠিক এখানটাই এসে মনের ভেতর প্রশ্ন জাগে, আমরা প্রকৃতির উপর অত্যাচার করি, নির্যাতন করি তার ফলেই প্রকৃতি আমাদের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে কি? গাছের দিকে তাকালে মনে হয় প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে জানে না। প্রকৃতি শুধু জানে ভালোবাসা বিলাতে। সহায়তা করতে। আবার প্রশ্ন জাগে তাহলে কি প্রকৃতির বেঁচে থাকার জন্যই নয়তো করোনা? ঠিক এইখানে এসে প্রশ্নের অবসান হয়। ইকোলজিকেল ব্যালেন্স যাকে বলে। অর্থাৎ প্রকৃতি নিজেই ব্যালেন্স করে নেয়। এই ব্যালন্স করে নিতে মানুষের ঘরবন্দী হওয়ার প্রয়োজন ছিল। স্থবিরতার প্রয়োজন ছিল। তাইতো আজ প্রকৃতির নিজের নিয়মে করোনার রাহুগ্রাসে পৃথিবী মানুষ আজ স্থবির হয়ে পড়েছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা মনে পড়ে যায় আমার।
"স্বপ্নের ধ্বণিরা এসে বলে যায় : স্থবিরতা সবচেয়ে ভালো"
শেষ কথা: আগে বেঁচে থাকি। বেঁচে থাকাটাই বড়, সুস্থ থাকাটা সবচেয়ে বড়। ক বৌদ্ধধর্মের পঞ্চশীল নীতির একটি এখন কেউ মানবে না। খোদ বৌদ্ধরা নিজেরাও মানবে না। নীতিটা হল জীব হত্যা করো না। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য আমাদেরকে মারতে হবে করোনা নামের জীবটাকে। করোনার পরবর্তী পৃথিবী দেখে রোমাঞ্চিত হবো।আকাশলীনা নীল, সুন্দর সবুজ প্রকৃতির মোহে বিস্মিত হব বিশুদ্ধ বাতাসে প্রানভরে নিঃশ্বাস নিব।তবে অতীব দুঃখের বিষয়, সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা এসে হারিতে যাবে তখন মায়ার এই ধরণী হতে কিছু অমূল্য প্রাণ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৫:১৬