সব ছবিতে টুইস্ট থাকতে হয় না। কিছু কিছু ছবি টুইস্ট ছাড়াই থাকে। খুব সহজ ও সরল কাহিনী থাকে। কিন্তু টুইস্ট ছাড়া সেই সরল ছবিগুলোই আমাদের জীবনের অনেক ভুল ধরিয়ে দেয়, শিখিয়ে দেয় অনেক কিছু। যার ফলে টুইস্ট না থাকলেও, কাহিনী সহজ সরল হলেও আর দশটা ছবির চেয়েও এসব ছবি আমাদের হৃদয়ে বিশেষভাবে ভাবে গেঁথে যায়। আব্বাস কিয়োরোস্তমি পরিচালিত তেমনি একটা মাস্টারপিস ছবির নাম 'Where is the friends home? (1987) যেটির আইএমডিবি রেটিং ৮.১
টুইস্ট যে একেবারেরেই নেই তা কিন্তু নয়। ছবি শেষ হবার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে আহমেদ এর বন্ধু রেজা নেমাতজাদেহ এর কি হবে?
কি এমন মুভি এইটা যেটা আর দশটা মুভির চেয়েও বিশেষভাবে হৃদয়ে স্থান পায়?
শুরুর কাহিনীটা একটু বলছি তবে....
আহমেদ। ইরানের কোক অঞ্চলের এক ছোট্ট বালক। আট বছর বয়স। স্কুল ছুটি হলে বাচ্চারা দৌড়ে বের হয়। এক সময় রেজা হোচট খেয়ে পড়ে যায়। বইপত্রও পড়ে যায়। আহমেদ তাঁকে সাহায্য করে। সে রেজাকে হাত ধরে উঠিয়ে দেয়, পানি দিয়ে তার প্যান্ট মুছে দেয়। ছড়িয়ে থাকা কলম ও বইপত্র উঠিয়ে দেয়।
আহা! বন্ধুর প্রতি শিশুমনের কি দায়িত্ববোধ! কি ভালোবাসা!
উপরে যেটুকু বললাম, সেইটে ৮৩ মিনিটের 'Where is the friends home? (1987)' ছবিটির অষ্টম মিনিটের ঘটনা। বাকি অংশের ঘটনা বললাম না যাতে ছবি দেখার মজাটা না কমে।
তবে আরো একটি দিক না বললেই নয়... আমাদের সমাজে এখনো খুব বাজে একটা দৃশ্য দেখা যায়। সরলতায় ভরা নিষ্পাপ শিশুদের পেঠানোর দৃশ্য। দোষ করলেও তার মার খায়, না করলেও খায়। কারণটা খুব অদ্ভুত। জ্ঞানের কমতি। আরো তেতোভাবে বললে মূর্খতার প্রতিফলন। ওরা মনে করে পেঠানোর মাধ্যমেই শিশুদেরকে আদবকায়দা শেখানো যায়, সুশিক্ষা দেয়া যায়। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য।
সহজ সরল একটা গল্পে সমাজের এই কুৎসিত দিকটি ফুটে উঠেছে ছবির ছোট্ট একটা সিনে, ছোট্ট একটা কথোপকথনে।
আহমেদের দাদার কাছে বিড়ি থাকা সত্ত্বেও সে আহমেদকে বিড়ি আনতে পাঠায়। আহমেদের রুটি আনতে হবে, রুটি আনতে দেরি হলেও ওরা রুটি খেতে পারবে না--ওসব কাজকে, ওসব অনুরোধ অনুনয়ের কোন দাম নেই তার দাদার কাছে। বরং বিড়ি থাকার পরও তাঁকে দিয়ে বিড়ি আনানোটাই তার কাছে মূল্যবান। এই ব্যাপারে আরো পরিষ্কার ধারণা পাবেন আহমেদের দাদার সাথে আরেকজন বৃদ্ধের কথোপকথনটি তুলে ধরলে
----"বিড়ি আমার কাছেও আছে। আসল বিষয় বিড়ি না, আমি আসলে চাই, বাচ্চাটা আদবকায়দা শিখুক, যাতে ভবিষ্যতে সে একজন ভাল মানুষ হতে পারে। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার বাবা আমাকে সপ্তাহে একআনা করে দিতেন, এবং প্রতি পনেরো দিন পরপর তিনি আমাকে পেটাতেন। কখনোকখনো তিনি ইচ্ছে করেই আমাকে টাকা দিতে ভুলে যেতেন, কিন্তু তিনি কখনোই আমাকে পেটাতে ভুলে যেতেন না, যাতে করে তিনি আমাকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারেন। তুমি তো নিজেই দেখলে, আমার নাতিকে বিড়ি আনতে বললাম, সেটা আবার আমাকে তিনবার বলতে হল। তারপরও সে আমার কথা শুনল না। আমি চাই, আমাদের বাচ্চারা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠুক। সে অলস, সে তো সমাজের কোনো কাজেই আসবে না।"
---- "ধরো, সে তোমার কথা শুনল। তুমি কি তখনও তাকে পেটাবে? কারণ তখন তো..."
---- "নিশ্চয়ই পেটাবো। আমি তো তোমাকে বললামই, আমার বাবা আমাকে হাতখরচ দিতে ভুলে গেলেও পেটাতে কখনো ভুলে যেতেন না। বুঝতেই পারছ, এর নাম শৃঙ্খলাবোধ। সমাজের বাচ্চাদের এটা শেখাতে হবে। তাদের বাবা-মা’কে মেনে চলতে হবে, সব ঐতিহ্যকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে হবে।"
----- "ঠিক আছে, বুঝলাম। কিন্তু বাচ্চাটা যদি কোনো ভুল না করে, তখন? তখন তুমি কী করবে?
কোনো না কোনো অজুহাত বের করে ওকে পেটাবো। প্রতি পনেরো দিন পরপর পেটাবো, যাতে সে কখনো এ মারের কথা ভুলতে না পারে।
মানুষ অনেক অনেক যুগ ধরেই কিছু অনৈতিক কার্যাবলী চর্চা করে আসছে। বংশ যে অন্যায় করে আসছে, যে নোংরা দর্শন চর্চা করে আসছে সবাই তা অব্যাহত রাখতে চায়। উপরোক্ত ঘটনাটি কি এখনো আমাদের সমাজ থেকে উঠে গেছে? কই এখনো অনেকেই আছেন সন্তান পড়তে না বসলে পিতা মাতা তাঁদেরকে পেঠায়। সন্তানের ফেলের কারণে মা মার খায় পিতার হাতে। মায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সন্তান আত্মহত্যা করে। এখনও আমাদের সমাজে, শিক্ষিত সমাজেই রয়ে গেছে অপ্রিয় কিছু মুর্খতামি।
চলচ্চিত্রটির পরিচালক সম্পর্কে দুটো কথা:
"আব্বাস কিয়ারোস্তামি সম্পর্কে জাপানি গ্রেট ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়ার আবেগী স্বীকারোক্তি, ‘বাক্যের ক্ষমতা নেই আমার অনুভূতিকে প্রকাশ করার। আমি শুধু বলি তার চলচ্চিত্রগুলো দেখুন। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু কিয়ারোস্তামির ছবি দেখার পর স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি, সত্যজিতের অভাব পূরণের জন্য যথার্থ এক মানুষকে পাঠানোর জন্য।" [এই অংশটা মুখ ও মুখোশ ডট নেট এর একটা আর্টিকেল থেকে নেয়া]
...
ছবিটি দেখার পর মনে একটা আফসোস জন্মেছে।
সেই শিশুকালে আমরা ছিলাম ফেরেশতার মতো। আমরা হিংসুক ছিলাম না, ছিলাম না অহংকারী কোনো। একটা চকলেট কিনলেও বন্ধুর সাথে খেতাম ভাগ করে, যদিও বড়রা নিলে কেঁদে ফেলতাম।.. হাহাহা...
আমরা তখন ছিলাম সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, নিষ্পাপ। সরলতায় ভরা ছিল আমাদের সেই দিনগুলো।
ওফ, ছবিটি দেখে আমার খুব, খুউব আফসোস।
কেন আমাদের মন এখন কলুষতায় ভরা? যদি এখনো হতাম আমরা সেইদিনগুলোর মতো সহজ ও সারল্যে ভরা। এখনও হতাম যদি সেদিনকার হাস্যোজ্জ্বল নিষ্পাপ সেই শিশুটির মতো ভালোবাসার ফুল হয়ে তবে..... তবে পৃথিবী হতো কি সুন্দর.... জীবন স্বার্থক...
আব্বার কিয়ারোস্তামিকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমন সুন্দর একটা মুভি উপহার দেয়ার জন্য। এইটা কোক ট্রিলজির প্রথম ছবি। খুব শীঘ্রই কোক ট্রিলজির বাকি দুইটা মুভি
"লাইফ, অ্যান্ড নাথিং মোর...(১৯৯১)" এবং
থ্রু দ্য অলিভার ট্রিস(১৯৯৪)" এর রিভিউ নিয়ে আসছি।
লেখা শেষ করবো খুব সুন্দর একটি কবিতা দিয়ে যে কবিতার একটি পঙক্তি দিয়েই চলচ্চিত্রটির নাম দেয়া হয়েছে এবং কবিতাটির থিমেই মূলত এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে.... কবিতাটি লিখেছেন ফার্সি কবি সোহরাব সাপেহরি। নীচে ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ দেয়া হলো।
Address
“Where is the friend’s house?”
Horseman asked by twilight and,
The sky paused.
The passerby presented sands, the branch of light that he had in mouth
And pointed to a poplar tree and said:
“Before reaching the tree,
There is a garden alley that is greener than God’s sleep
And in it, love is as blue as the feathers of honesty.
Go to the end of the alley which stops at the back of adolescence.
Then turn to the flower of loneliness,
Two steps short of reaching the flower,
Stay by the fountain of eternal myth of earth
And you feel a transparent fear.
And in the fluid sincerity of the air, you will hear a scratch:
You will see a child
Who has gone up the pine tree, to grab a bird from the nest of light
And you ask him
Where the friend’s house is.”
[Translated by Mahvash Shahegh]
..............
ঠিকানা
“বন্ধুর বাড়িটা কোথায়?” গোধূলিআলোয় সওয়ারি সুধায়।
একটু থেমে হাসলো বেহেশত।
ছড়িয়ে আলো ঠোঁটের কোণায়, সরিয়ে আঁধার সেই মরুতে,
পপলার এক গাছের দিকে উঁচিয়ে আঙুল বললো পথিক,
“ওই তো ওই গাছের কাছেই
বাগান আছে---সে সবুজ সারির সবুজ দেখে পুড়বে দুচোখ,
সেখানে দেখো, সততার পালক থেকেও ভালোবাসাটা নীলচে বেশি,
সারিটা ধরে এগিয়ে যেয়ো, এগোনো শেষে জাগবে জীবন,
খানিক ফিরে একাকীত্বের ফুলটা দেখো,
ফুলের দিকে দুই পা দিয়ো,
যে ঝর্ণাধারা চলেছে বয়ে পুরাণ থেকে পৃথিবীবুকে, তার পাশেতে একটু বোসো,
যদি ভয় পেয়ে যাও সেখানটাতে, শুকনো পাতা ভয় তাড়াবে, নিবিড়ভাবে শুনলে পরে শুনতে পাবে।
এক দেবশিশু আসবে, দেখো---
সে এসেছে উঁচু গাছের উপর হতে দিব্যজ্যোতির খবর নিয়ে।
শুধাও ওকেই:
“বন্ধুর বাড়িটা কোথায়?” [অনুবাদক: সুশান্ত পাল
-------- আকতার আর হোসাইন [১৮-০১-২০]
বিঃদ্রঃ মুভির লিংক কেউ চাইবেন না। আমি চার পাঁচ মাস আগে ডাওনলোড করেছিলাম কোন সাইট থেকে ডাওনলোড করেছিলাম মনে নাই। তবে যারা মুভিটা দেখতে চান, চিন্তার কোন কারণ নাই। কারণ মুভিটা ইউটিউবে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১:০৪