চলছে ফেব্রুয়ারি মাস যে মাসে সালাম রফিক জব্বারা প্রাণ দিয়েছিলেন মায়ের ভাষার জন্য। বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বর্তমানকালে আমাদের দেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছড়াছড়ি। সেসব স্কুলে পড়ে ছেলে মেয়েদের শুধু ইংলিশ ভাষাটাই শেখানো হয়। সেসব স্কুলে পড়ে ছেলে মেয়েরা অনর্গল ইংলিশে কথা বলতে ও লিখতে পারে। অথচ মাতৃভাষা বাংলাটাই শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারে না, পারেনা শূদ্ধ বানানে লিখতে।
আচ্ছা কখনো কি ভেবে দেখেছেন আমাদের স্কুলগুলোর নাম কেন 'টোকিও-সিডনি ইংলিশ' কিংবা 'লন্ডন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল' রাখা হয়? কেন স্কুলগুলোর নাম রাখা হয় না 'বরিশাল-রংপুর বাংলা বিদ্যালয়'?
এর কারণটি লেখক চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন 'টগরের হোমওয়ার্ক' গল্পে মারুফ সাহবের মুখে।
''ব্যবসা, বুঝলেন ব্যবসা। আমরা বিদেশি দামি জিনিষের নাম শুনলেই বেহুশ হয়ে যাই। টোকিও-সিডন পৃথিবীর উন্নত দুটি শহর। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরী। আমাদের দেশের পাবলিক এসব নামগুলো আগ্রহ নিয়ে গিলে এজন্য এসব নামকরণ। নামটা যদি 'বরিশাল-রংপুর বাংলা বিদ্যালয়' হতো তাহলে পাবলিক তা পছন্দ করতো না। টাকাওয়ালারা সস্তা নামের স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করতো না; এতে ধনীদের প্রেস্টিজ পাংচার হতো। স্কুলের ব্যবসাও লাটে উঠতো। এমন নাম হলে আপনি কি নাতি নাতনীকে ভর্তি করতেন?"'
তাছাড়া গল্পে টগরের আলোচনাগুলোও আমার আপনার চোখ খুলে দিবে। এই ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা নিয়ে এর চেয়ে সচেতন সৃষ্টিকারী লেখা আর হতে পারে না বলে আমি মনে করি।
এই গল্পটা নিয়ে বলতে গেলে এক কথায় বলতে হয় ফ্ল্যাপের লেখাটি।
"টগরের হোমওয়ার্ক' গল্পে আমাদের অস্থির সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার নগ্ন চিত্র চিত্রায়ন করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছেন লেখক।"
যেহেতু এখন ফেব্রুয়ারি মাস সেহেতু এমন একটি অসাধারণ সচেতন সৃষ্টিকারী লেখা উপহার দেয়ার জন্য লেখককে স্পেশাল একটা ধন্যবাদ।
আচ্ছা, যে অট্টালিকায় বাস করে আর যে টিনের চালের ঘরে বাস করে তাঁদের বহু পার্থকের মাঝেও কি কিছু মিল পাওয়া যায় না?
কিছু সুখস্মৃতি, কিছু দুঃখ কষ্ট সমাজের সব শ্রেণীর মাঝেই বিদ্যমান। জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই সুখ দুঃখের সাদৃশ্য সকলের মাঝেই পরিলক্ষিত হয়। এই ফ্রেমে বন্দি হয় অট্টালিকা থাকা মানুষগুলোর জীবন, টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পড়া ঘরে বাস করা মানুষের জীবন। এই ফ্রেমটাতেই বন্দি হয় রিকশার ড্রাইভারের জীবন, বিমানের ড্রাইভারের জীবন। স্রষ্টার এই খেলাকে, মানুষের এই সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের জীবন চক্রকে আপনি কি বলনে?
লেখক গল্পটা লিখেছেন 'তিন চাকার চক্র' নামে। আমাদের জীবনটা কি আসলেই তিন চাকার চক্র নয়?
'নিহঙ্গ অ্যাই রক্কু' এবং 'সেকেলে' গল্প দুটিতে লেখকের সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা আর উপলব্ধি ফুটে উঠেছে সুনিপুণভাবে। লেখকের গভীর জীবনদর্শন এর ফসল এই লেখা গল্প দুটি। রাজনৈতিক জীবনদর্শনও বাদ রাখেননি তিনি।
'রঙিন ফানুস' গল্পে তুলে ধরা হয়েছে রাজনীতি মাঠের চরম কিছু বাস্তবতা।
বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা, লাইব্রেরী গড়ার প্রয়োজনীয়তার বার্তাটি পাওয়া যায় 'ধূমকেতু' গল্পে। গল্পটির মারুফ চরিত্রটি নিঃসন্দেহে সবাইকে উৎসাহী করে তুলবে।
লাভ জিহাদ গল্প তো আপনাকে মনে করিয়ে দিবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের কথা। আর বায়স্কোপ এসেছে স্মৃতি ধরে রাখার, স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার প্রবল ব্যাকুলতা।
কিঞ্চিত সমালোচনা: ১১টি গল্পের ১০ টিতেই লেখক একটি বার্তা পৌছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বাদ পড়েছে 'হাকালুকি পাড়ের নেয়ামত হোসেন'।
নাহ, ভুল বললাম। দ্বিতীয় বার গল্পটা পড়ার সময় খেয়াল হয়েছে লেখক এই গল্পটি দ্বারাও একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
এই গল্পটাই লেখকের সবচেয়ে প্রিয় গল্প। শেষটায় এসে কাহিনী লেখক কাহিনী গুলিয়ে ফেলেছেন নাকি আমি প্রথম সারির পাঠক না বলে আমার কাছে এমন মনে হয়েছে, আমি নিজেই সন্দিহান।
গল্প কথক পারভেজ আহমেদের সাথে নেয়ামত হোসেনটা আসলে কে ছিল? কাল্পনিক কিছু, কোন ছায়াসঙ্গী?
যাইহোক, কাহিনীটা আরেকটু পরিষ্কার করা প্রয়োজন ছিল।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
জীবন কি বায়স্কোপ? নাকি বায়স্কোপই জীবন? না। কোনটিই সঠিক উত্তর না।
জীবনে পরতে পরতে থাকে গল্প। গল্পের ভিতরে থাকে গল্প। নানান রকমের গল্প। রঙ বেরঙের গল্প। আনন্দ বেদনার গল্প সুখ দুঃখের গল্প।
এই যে এত গল্পের কথা বললাম। আমার চোখে জীবন হল এই গল্পগুলোর সমষ্টি। আর এসব গল্পকে যদি আমরা বায়স্কোপ বলি তাহলে জীবন হল সেই অনেকগুলো বায়স্কোপের সমষ্টি। আর বায়স্কোপ হলে জীবনের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র।
লেখক জীবনের সেই ক্ষুদ্রাংশ, জীব সেই বায়স্কোপকে এঁকেছেন 'বায়স্কোপ' গল্পগ্রন্থে।
একজন লেখকের বৈশিষ্ট্য কি? একজন লেখকের স্বার্থকতা কোথায়?
আমার মতে লেখকের বৈশিষ্ট্য হল সমাজের ভুল ত্রুটি, কুসংস্কার নিয়ে লিখবেন। পাঠকের কাছে লেখক তার গল্প দ্বারা মেসেজ পোছানোর চেষ্টা করবেন। যদি মেসেজ পাঠাতে সফল হন তাহলে লেখককে স্বার্থক লেখক বলা যেতে পারে।
কাওসার চৌধুরী তার বইয়ে সমাজভাবনা প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেশের জং ধরা সমাজ নিয়ে লিখছেন; আরো লিখেছেন ঘুণে খাওয়া ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। যে মেসেজ পাঠানোর চেষ্টা করেছেন তা সফল হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কাজেই এই দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে আমরা সফল বা স্বার্থক লেখক বলতে পারি।
'হাকালুকি পাড়ের নেয়ামত' হোসেন গল্পে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এটি এমন একটি গল্প যা পড়ে পাঠক নিজেকে গল্পের মাঝে হারিয়ে ফেলবেন। এই গল্পটি পড়ে মনে হয়েছে লেখক ফুরিয়ে যেতে আসেননি। যেকোন প্লট নিয়ে লেখক লিখতে পারবেন, এবং পাঠক ধরে রাখার, মনযোগ ক্ষুণ্ণ না হওয়ার মত গল্প বলার ধরণ এই গল্পে পরিস্ফুটিত হয়েছে।
লেখকের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কামনা করি। এই বইয়ে কিছু উদ্বৃতি আছে। আমার ব্যক্তিগত মতামত, যদি লেখক কোন সময় বিখ্যাত হতে পারেন তাহলে এই বই থেকে কয়েকটি উক্তি বাণী চিরন্তনীতে স্থান পাবে।
নীচে পছন্দের কয়েকটি উদ্বৃতি দিলাম
১। "ভালোবাসা হল মিথ্যা আবেগ। আবেগ কেটে গেলে একটা সময় মানুষ মূল্যহীন হয়ে পড়ে।"
২। "ভালোবাসার মিথ্যে আবেগে মানুষ আত্মহত্যা করে কিন্তু বিজ্ঞান ও সাহিত্যের আবেগে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে। নিজের বিবেককে শাণিত করে। সমাজ ও দেশকে পরিবর্তন করে।"
৩। "জীবন মানে ধৈর্য, পরিশ্রম ও জ্ঞান অর্জন করা। নিজেকে জানা, দেশকে জানা ও সৃষ্টির রহস্যকে বুঝার চেষ্টা করা।"
৪। "আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চাকরী ও রেজাল্ট নির্ভর। এখানে জ্ঞান অর্জন করাটা গৌণ।"
৫। "দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার উচিৎ যার যার অবস্থান থেকে সমাজ ও দেশকে কিছু ফিরিয়ে দেয়া; সমাজ পরিবর্তনে সহযোগী হওয়া।"
৬। "কেবল বই পড়েই সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব। বই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ধাবিত করে; মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে। নিজের চিন্তা ও বিবেককে শাণিত করে।"
৭। "দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু পাঠ্যবই পড়লে চলবে না, এজন্য প্রয়োজন অপাঠ্য বইয়ের প্রয়োজনীয় অনুশীলন। আর প্রয়োজনের অন্যতম ভাণ্ডার হল লাইব্রেরী।"
৮। "টাকা পয়সার সাথে মানুষের স্ট্যাটাস বদল হয়; সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়; মানুষের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়। আচরণ বদলায়। রুচি ও চাহিদার রদবদল হয়। চেনা মানুষ অচেনা হয়। অচেনা মানুষ আপন হয়। ভালোবাসা আর সম্মানের জায়গায় চিড় ধরে"
৯। "বড় বড় নেতারা সভা-সমাবেশে আমাদের মতো মানুষদের কথা গলা ফাটিয়ে বলে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তেমন কিছু না।
তারপরও প্রতিনিয়ত এসব মিথ্যা আশা, এই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আমরা নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখি হোক তা মিথ্যা।"
১০। "স্বপ্নের কোন দেয়াল নেই, পপরিধি নেই।"
১১। "মানুষের স্বপ্নগুলো মরে গেলে চোখের পানিও নিঃশেষ হয়ে যায়।"
১২। "মানুশ বেঁচে থাকে তার পছন্দের খেয়াল নিয়ে; এটাকে বাদ দিয়ে সংসার, জীবন কোনটিই হয় না।
১৩। "প্রতিটি মানুষ তার কর্মে বেঁচে থাকতে চাই মৃত্যুর ওপারেও।"
১৪। "মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে আর প্রিয় মানুষদের দেওয়া উপহারের স্মৃতি নিয়ে"
শেষোক্ত কথাটি ধরে আমিও না হয় বেঁচে থাকবো প্রিয় কাওসার ভাইয়ের এই ভালবাসার উপহারটি নিয়ে।
বই (গল্পগ্রন্থ): বায়স্কোপ
লেখক: কাওসার চৌধুরী
প্রকাশন : উৎস প্রকাশন
মোট গল্প : ১১ টি
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১১২
মুদ্রিত মূল্য: ২০০
ব্যক্তিগত ব্লগসাইটে রিভিউটি: Click This Link
বিঃদ্রঃ আমি মূলত রিভিউ লেখার আগে বইটির পাঁচ ছয়টা রিভিউ আগে পড়ি। তারপর নিজের ধারণা মিলিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে রিভিউ লিখি। কিন্তু কাওসার ভাইয়ের এই বইটি পড়ার আগে কোন রিভিউ পড়িনি আমি। কাজেই অন্য রিভিউ থেকে এটা অসুন্দর ও অগোছালো হয়ে গেছে। অন্য রিভিউ থেকে ভুলও বেশি থাকতে পারে। ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।
চলছে ফেব্রুয়ারি মাস যে মাসে সালাম রফিক জব্বারা প্রাণ দিয়েছিলেন মায়ের ভাষার জন্য। বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বর্তমানকালে আমাদের দেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছড়াছড়ি। সেসব স্কুলে পড়ে ছেলে মেয়েদের শুধু ইংলিশ ভাষাটাই শেখানো হয়। সেসব স্কুলে পড়ে ছেলে মেয়েরা অনর্গল ইংলিশে কথা বলতে ও লিখতে পারে। অথচ মাতৃভাষা বাংলাটাই শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারে না, পারেনা শূদ্ধ বানানে লিখতে।
আচ্ছা কখনো কি ভেবে দেখেছেন আমাদের স্কুলগুলোর নাম কেন 'টোকিও-সিডনি ইংলিশ' কিংবা 'লন্ডন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল' রাখা হয়? কেন স্কুলগুলোর নাম রাখা হয় না 'বরিশাল-রংপুর বাংলা বিদ্যালয়'?
এর কারণটি লেখক চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন 'টগরের হোমওয়ার্ক' গল্পে মারুফ সাহবের মুখে।
''ব্যবসা, বুঝলেন ব্যবসা। আমরা বিদেশি দামি জিনিষের নাম শুনলেই বেহুশ হয়ে যাই। টোকিও-সিডন পৃথিবীর উন্নত দুটি শহর। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরী। আমাদের দেশের পাবলিক এসব নামগুলো আগ্রহ নিয়ে গিলে এজন্য এসব নামকরণ। নামটা যদি 'বরিশাল-রংপুর বাংলা বিদ্যালয়' হতো তাহলে পাবলিক তা পছন্দ করতো না। টাকাওয়ালারা সস্তা নামের স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করতো না; এতে ধনীদের প্রেস্টিজ পাংচার হতো। স্কুলের ব্যবসাও লাটে উঠতো। এমন নাম হলে আপনি কি নাতি নাতনীকে ভর্তি করতেন?"'
তাছাড়া গল্পে টগরের আলোচনাগুলোও আমার আপনার চোখ খুলে দিবে। এই ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা নিয়ে এর চেয়ে সচেতন সৃষ্টিকারী লেখা আর হতে পারে না বলে আমি মনে করি।
এই গল্পটা নিয়ে বলতে গেলে এক কথায় বলতে হয় ফ্ল্যাপের লেখাটি।
"টগরের হোমওয়ার্ক' গল্পে আমাদের অস্থির সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার নগ্ন চিত্র চিত্রায়ন করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছেন লেখক।"
যেহেতু এখন ফেব্রুয়ারি মাস সেহেতু এমন একটি অসাধারণ সচেতন সৃষ্টিকারী লেখা উপহার দেয়ার জন্য লেখককে স্পেশাল একটা ধন্যবাদ।
আচ্ছা, যে অট্টালিকায় বাস করে আর যে টিনের চালের ঘরে বাস করে তাঁদের বহু পার্থকের মাঝেও কি কিছু মিল পাওয়া যায় না?
কিছু সুখস্মৃতি, কিছু দুঃখ কষ্ট সমাজের সব শ্রেণীর মাঝেই বিদ্যমান। জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই সুখ দুঃখের সাদৃশ্য সকলের মাঝেই পরিলক্ষিত হয়। এই ফ্রেমে বন্দি হয় অট্টালিকা থাকা মানুষগুলোর জীবন, টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পড়া ঘরে বাস করা মানুষের জীবন। এই ফ্রেমটাতেই বন্দি হয় রিকশার ড্রাইভারের জীবন, বিমানের ড্রাইভারের জীবন। স্রষ্টার এই খেলাকে, মানুষের এই সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের জীবন চক্রকে আপনি কি বলনে?
লেখক গল্পটা লিখেছেন 'তিন চাকার চক্র' নামে। আমাদের জীবনটা কি আসলেই তিন চাকার চক্র নয়?
'নিহঙ্গ অ্যাই রক্কু' এবং 'সেকেলে' গল্প দুটিতে লেখকের সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা আর উপলব্ধি ফুটে উঠেছে সুনিপুণভাবে। লেখকের গভীর জীবনদর্শন এর ফসল এই লেখা গল্প দুটি। রাজনৈতিক জীবনদর্শনও বাদ রাখেননি তিনি।
'রঙিন ফানুস' গল্পে তুলে ধরা হয়েছে রাজনীতি মাঠের চরম কিছু বাস্তবতা।
বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা, লাইব্রেরী গড়ার প্রয়োজনীয়তার বার্তাটি পাওয়া যায় 'ধূমকেতু' গল্পে। গল্পটির মারুফ চরিত্রটি নিঃসন্দেহে সবাইকে উৎসাহী করে তুলবে।
লাভ জিহাদ গল্প তো আপনাকে মনে করিয়ে দিবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের কথা। আর বায়স্কোপ এসেছে স্মৃতি ধরে রাখার, স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার প্রবল ব্যাকুলতা।
কিঞ্চিত সমালোচনা: ১১টি গল্পের ১০ টিতেই লেখক একটি বার্তা পৌছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বাদ পড়েছে 'হাকালুকি পাড়ের নেয়ামত হোসেন'।
নাহ, ভুল বললাম। দ্বিতীয় বার গল্পটা পড়ার সময় খেয়াল হয়েছে লেখক এই গল্পটি দ্বারাও একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
এই গল্পটাই লেখকের সবচেয়ে প্রিয় গল্প। শেষটায় এসে কাহিনী লেখক কাহিনী গুলিয়ে ফেলেছেন নাকি আমি প্রথম সারির পাঠক না বলে আমার কাছে এমন মনে হয়েছে, আমি নিজেই সন্দিহান।
গল্প কথক পারভেজ আহমেদের সাথে নেয়ামত হোসেনটা আসলে কে ছিল? কাল্পনিক কিছু, কোন ছায়াসঙ্গী?
যাইহোক, কাহিনীটা আরেকটু পরিষ্কার করা প্রয়োজন ছিল।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
জীবন কি বায়স্কোপ? নাকি বায়স্কোপই জীবন? না। কোনটিই সঠিক উত্তর না।
জীবনে পরতে পরতে থাকে গল্প। গল্পের ভিতরে থাকে গল্প। নানান রকমের গল্প। রঙ বেরঙের গল্প। আনন্দ বেদনার গল্প সুখ দুঃখের গল্প।
এই যে এত গল্পের কথা বললাম। আমার চোখে জীবন হল এই গল্পগুলোর সমষ্টি। আর এসব গল্পকে যদি আমরা বায়স্কোপ বলি তাহলে জীবন হল সেই অনেকগুলো বায়স্কোপের সমষ্টি। আর বায়স্কোপ হলে জীবনের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র।
লেখক জীবনের সেই ক্ষুদ্রাংশ, জীব সেই বায়স্কোপকে এঁকেছেন 'বায়স্কোপ' গল্পগ্রন্থে।
একজন লেখকের বৈশিষ্ট্য কি? একজন লেখকের স্বার্থকতা কোথায়?
আমার মতে লেখকের বৈশিষ্ট্য হল সমাজের ভুল ত্রুটি, কুসংস্কার নিয়ে লিখবেন। পাঠকের কাছে লেখক তার গল্প দ্বারা মেসেজ পোছানোর চেষ্টা করবেন। যদি মেসেজ পাঠাতে সফল হন তাহলে লেখককে স্বার্থক লেখক বলা যেতে পারে।
কাওসার চৌধুরী তার বইয়ে সমাজভাবনা প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেশের জং ধরা সমাজ নিয়ে লিখছেন; আরো লিখেছেন ঘুণে খাওয়া ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। যে মেসেজ পাঠানোর চেষ্টা করেছেন তা সফল হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কাজেই এই দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে আমরা সফল বা স্বার্থক লেখক বলতে পারি।
'হাকালুকি পাড়ের নেয়ামত' হোসেন গল্পে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এটি এমন একটি গল্প যা পড়ে পাঠক নিজেকে গল্পের মাঝে হারিয়ে ফেলবেন। এই গল্পটি পড়ে মনে হয়েছে লেখক ফুরিয়ে যেতে আসেননি। যেকোন প্লট নিয়ে লেখক লিখতে পারবেন, এবং পাঠক ধরে রাখার, মনযোগ ক্ষুণ্ণ না হওয়ার মত গল্প বলার ধরণ এই গল্পে পরিস্ফুটিত হয়েছে।
লেখকের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কামনা করি। এই বইয়ে কিছু উদ্বৃতি আছে। আমার ব্যক্তিগত মতামত, যদি লেখক কোন সময় বিখ্যাত হতে পারেন তাহলে এই বই থেকে কয়েকটি উক্তি বাণী চিরন্তনীতে স্থান পাবে।
নীচে পছন্দের কয়েকটি উদ্বৃতি দিলাম
১। "ভালোবাসা হল মিথ্যা আবেগ। আবেগ কেটে গেলে একটা সময় মানুষ মূল্যহীন হয়ে পড়ে।"
২। "ভালোবাসার মিথ্যে আবেগে মানুষ আত্মহত্যা করে কিন্তু বিজ্ঞান ও সাহিত্যের আবেগে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে। নিজের বিবেককে শাণিত করে। সমাজ ও দেশকে পরিবর্তন করে।"
৩। "জীবন মানে ধৈর্য, পরিশ্রম ও জ্ঞান অর্জন করা। নিজেকে জানা, দেশকে জানা ও সৃষ্টির রহস্যকে বুঝার চেষ্টা করা।"
৪। "আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চাকরী ও রেজাল্ট নির্ভর। এখানে জ্ঞান অর্জন করাটা গৌণ।"
৫। "দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার উচিৎ যার যার অবস্থান থেকে সমাজ ও দেশকে কিছু ফিরিয়ে দেয়া; সমাজ পরিবর্তনে সহযোগী হওয়া।"
৬। "কেবল বই পড়েই সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব। বই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ধাবিত করে; মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে। নিজের চিন্তা ও বিবেককে শাণিত করে।"
৭। "দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু পাঠ্যবই পড়লে চলবে না, এজন্য প্রয়োজন অপাঠ্য বইয়ের প্রয়োজনীয় অনুশীলন। আর প্রয়োজনের অন্যতম ভাণ্ডার হল লাইব্রেরী।"
৮। "টাকা পয়সার সাথে মানুষের স্ট্যাটাস বদল হয়; সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়; মানুষের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়। আচরণ বদলায়। রুচি ও চাহিদার রদবদল হয়। চেনা মানুষ অচেনা হয়। অচেনা মানুষ আপন হয়। ভালোবাসা আর সম্মানের জায়গায় চিড় ধরে"
৯। "বড় বড় নেতারা সভা-সমাবেশে আমাদের মতো মানুষদের কথা গলা ফাটিয়ে বলে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তেমন কিছু না।
তারপরও প্রতিনিয়ত এসব মিথ্যা আশা, এই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আমরা নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখি হোক তা মিথ্যা।"
১০। "স্বপ্নের কোন দেয়াল নেই, পপরিধি নেই।"
১১। "মানুষের স্বপ্নগুলো মরে গেলে চোখের পানিও নিঃশেষ হয়ে যায়।"
১২। "মানুশ বেঁচে থাকে তার পছন্দের খেয়াল নিয়ে; এটাকে বাদ দিয়ে সংসার, জীবন কোনটিই হয় না।
১৩। "প্রতিটি মানুষ তার কর্মে বেঁচে থাকতে চাই মৃত্যুর ওপারেও।"
১৪। "মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে আর প্রিয় মানুষদের দেওয়া উপহারের স্মৃতি নিয়ে"
শেষোক্ত কথাটি ধরে আমিও না হয় বেঁচে থাকবো প্রিয় কাওসার ভাইয়ের এই ভালবাসার উপহারটি নিয়ে।
বই (গল্পগ্রন্থ): বায়স্কোপ
লেখক: কাওসার চৌধুরী
প্রকাশন : উৎস প্রকাশন
মোট গল্প : ১১ টি
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১১২
মুদ্রিত মূল্য: ২০০
ব্যক্তিগত ব্লগসাইটে রিভিউটি: Click This Link
বিঃদ্রঃ আমি মূলত রিভিউ লেখার আগে বইটির পাঁচ ছয়টা রিভিউ আগে পড়ি। তারপর নিজের ধারণা মিলিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে রিভিউ লিখি। কিন্তু কাওসার ভাইয়ের এই বইটি পড়ার আগে কোন রিভিউ পড়িনি আমি। কাজেই অন্য রিভিউ থেকে এটা অসুন্দর ও অগোছালো হয়ে গেছে। অন্য রিভিউ থেকে ভুলও বেশি থাকতে পারে। ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:১১