অনেকক্ষণ থেকেই বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ইতি। শেষ বিকেলের এই সময়টা খুব বিষণ্ণ হয়। হঠাত করেই চারপাশ কেমন যেন লালচে আলোয় ভরে যার আর লেপটে থাকা চোখের কাজলের মত একটু একটু করে চারপাশ অন্ধকার হতে থাকে। সারাদিনের সব মেঘগুলো যেন বিন্দু বিন্দু করে আকাশে জমা হতে থাকে। কিছু সময়ের মাঝেই মাগরিবের আজান দিবে। ইতি ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে তার ঘরে ফিরে আসতেই তার সামনে উড়ে এসে হাজির হয় বীথি। চোখগুলো গোল গোল করে নাচিয়ে বলে- তিতিপা, তোর জন্যে পুডিং বানিয়েছে আম্মু। যা গিয়ে চেক করে আয় মিষ্টি ঠিক হয়েছে কিনা...
ইতি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার ছোট বোনকে দেখতে থাকে। বীথি তার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট, ওর বয়স যখন দেড় বছর তখন থেকেই ইতিকে সে তিতি বলে ডাকে, এখন বীথি ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে কিন্তু সেই নামের কোন চেঞ্জ হয়নি। নিজেকে টমবয় টাইপের মনে করে বীথি। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় একদিন ও মেয়ে বলে কোন খেলায় যেন চান্স পায়নি, তাই সে পাশের বাসার ইমান আংকেলের ছেলেকে ঘুসি মেরে ঠোঁট ফাটিয়ে দিয়েছিলো। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ওর বেশ লম্বা চুল ছিল। একদিন
আম্মুর সাথে ঝগড়া করে সে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে তার সব চুল কেটে ঘার পর্যন্ত
করে ফেললো। ইতির বাবা মিঃ সৈয়দ আহসান একজন রিটায়ার্ড কর্নেল, বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল একটা ছেলে হলে উনি তাকে নিজের মনমতো মানুষ করবেন। বীথি হবার পর সম্ভবত তার সেই শূন্যতা কমে এসেছে, কারণ বীথি নিজেকে মেয়ে পরে মানুষ আগে মনে করে। কি হল, তুই এমন হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার কি বাবার মত
গোঁফ গজিয়েছে? বীথির দেওয়া বিশাল একটা ধাক্কায় সম্বিত ফিরে পায় ইতি।- বাবার মত না, দাদামশাইয়ের মত প্যাঁচালো গোঁফ হয়েছে তোর। এবার খুশি??? চল চল, মা বকবেন নইলে...সন্ধ্যা ৭টা। ইতি, বীথি আর তাদের বাবা-মা একসাথে সন্ধ্যার নাস্তা খেতে বসেছে। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প হচ্ছে। বীথি তার ক্লাসের গল্প বলে বাসার সবাইকে হাসাচ্ছে... আপাত দৃষ্টিতে দেখে মনে হবে এইটা একটি পারফেক্ট সুখী পরিবারের দৃশ্য। বাবা-মা সাথে স্নিগ্ধ চেহারার বড় মেয়ে, চঞ্চল দস্যি একটি
ছোট মেয়ে, দিনশেষে একসাথে তাদের সময় কাটানো...হাসি ঠাট্টা করা...আর কি চাই? কিন্তু মূল কাহিনী অন্যখানে। গত দেড় বছর ধরে মিঃ আহসান ইতির সাথে কোন কথা বলেন না। এমনকি ঈদের দিনে ইতিকে সালামও করতে দেননা। গত দেড় বছর ধরে মিসেস আহসান, বীথি, ইতি সবাই ভাবছে হয়ত মিঃ আহসানের রাগ একটা সময় কমে যাবে কিন্তু না, দিনের পর দিন সেই ধারণা কেবলই ভুল প্রমাণিত হচ্ছে।
২
ঘটনার শুরু হয়েছিলো প্রায় বছর চারেক আগে। ইতি এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন ফাইভ পাওয়ার পরে মিঃ আহসান আদরের বড় মেয়েকে নতুন কম্পিউটার কিনে দেন আর ইন্টারনেট কানেকশন দিয়ে দেন। এই মেয়েটার জন্যে তার মনে আলাদা জায়গা আছে। তিনি এই মেয়ের চোখে পানি দেখতে পারেন না। বীথি কাঁদলে তার মনে হয় বীথি শক্ত মনের মানুষ নিজেকে সামলে নিতে পারবে কিন্তু ইতির চোখ পানি দেখলে বা
তাকে বিষণ্ণ দেখলে মিঃ আহসানের নিজের ভেতরটা হাঁসফাঁস করতে থাকে। ইতিকে কম্পিউটার কিনে দেওয়ার পরে সে প্রায় ৩০মিনিট তার বাবাকে ঝাপটে ধরে বসে ছিল। মিঃ আহসানের চোখ আনন্দে ভিজে এসেছিলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি নিজের মেয়েকে অনেক অনেক পড়ালেখা করাবেন, পি এইচ ডি করাবেন, ইতি আর বীথি হবে সৈয়দ পরিবারের এমন দুইজন মানুষ যারা সবচেয়ে বেশি পড়ালেখা করেছে। যারা শুধু শিক্ষিত না বরং হবে স্বশিক্ষিত। মাস কয়েকের মাঝেই মিসেস আহসান অভিযোগ করলেন ইতি সারাদিন কম্পিউটারে বসে
থাকে। দিনে রাতে সব সময় একই কাজ তার। দুপুরে ভাত খাবার সময়ও ইয়াহুতে চ্যাট করতে থাকে। মেয়ের চোখের নিচে কালি পড়ে যাচ্ছে, সকালের ক্লাসে রোজ তার দেরী হচ্ছে। মিঃ আহসান সব শুনে ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। আজকাল ইতি সকালের নাস্তার টেবিলে আসতে দেরী করে। অথচ এই বাসার নিয়ম হল সকালের নাস্তা আর রাতের খাবার সবাই একসাথে খাবে। শুধু তাই নয় ইতি গত বেশ কদিন ধরে বিকেলে চা বানায় না। মিঃ আহসান ইতির হাতের চা খেয়ে এতই অভ্যস্ত যে অন্য কেউ চা বানালে উনি খেয়ে শান্তি পাননা। বীথির বয়স কম সে ইতির এসব
দেখে ভুল পথে প্ররোচিত হবে। মিঃ আহসানের হঠাত করেই কেন জানি জানি নিজের মেয়েদেরকে কেমন অচেনা লাগতে থাকে। নিজের ঘরে কম্পিউটার আসার পর থেকেই ইতির জীবন বদলে গেছে। হুট করেই তার
মনে হচ্ছে এই পৃথিবীটা মস্ত বড়। ফেসবুক, টুইটার, ইয়াহু, গান/ নাটক
ডাউনলোডের সাইট, আর বিভিন্ন চ্যাট সাইটে গিয়ে তার সময় কাটে। অনেকগুলো নতুন বন্ধু হয়েছে। এদের মাঝে কয়েকজনের সাথে সেলফোনে কোথাও হয়েছে। সব মিলিয়ে ইতির আজকাল সবসময়ই মন ভালো থাকে। কোনদিক দিয়ে যে দিন হয় বা রাত আসে সে টের পায়না। সমস্যা একটাই হয় আর তা হল রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে যায়, আজকাল বাবা-মাও ব্যাপারটা বেশ অপছন্দ করছেন। মা তো পিসির
সামনে আর সেলফোন হাতে দেখলেই বকা দিচ্ছেন। ইতি বেশ সাবধান হয়ে গেলো, পড়তে বসার সময় ফোন এলে তার খোলা চুলের মাঝে হেড ফোন দিয়ে সে ফিসফিস করে ফোনে কথা বলে, পিসির সামনে বসলে চ্যাটিং করার সময় মা বা বাবা কেউ এলেই উইকি থেকে পড়া রিলেটেড কোন পেইজ খুলে তা মন দিয়ে পড়তে থাকে। আর রাত যত গভীর হয়
তার স্বাধীনতা ততই বাড়তে থাকে। বীথির কলেজ আর পড়ালেখা নিয়ে প্রচুর চাপ পড়ছে সে মরার মত ঘুমায় তাই ইতিকে ডিস্টার্ব করার মত আর কেউই নেই। প্রায় বছর খানেক হয়ে গেছে। ইতির এখন ফেসবুকে কয়েক’শ ফ্রেন্ড। নিজেকে দেবার মত সময় নেই কোন। সারাক্ষণ সে ব্যস্ত। ক্লাস/কম্পিউটার/পড়ালেখা/ মুঠোফোনের আড্ডা আরও কত কি!! এর মাঝে দেশের স্বনামধন্য একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছেলের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। ছেলেটার নাম শুভ, শুভ হাসান। খুবই আড্ডাবাজ টাইপের ছেলে, গীটার বাজিয়ে দুর্দান্ত গান গায়। বেশ কিছু গান সে ইতিকে মেইল করে পাঠিয়েছে। গলার ভয়েসটা অসাধারণ সুন্দর। ইতি মাঝে মাঝেই শুভর সাথে মোবাইলে গল্প করে। শুভর কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যায়, আনমনা হয়ে ভাবে শুভর সাথে যেদিন প্রথম দেখা
হবে সেদিন সে কি বলবে??? আচ্ছা শুভ আর ও কি শুধুই বন্ধু!!!
৩
- তোমাকে না বলেছিলাম অনেকগুলো নীল-সাদা চুড়ি পড়ে আসবে আর স্মোকি আইজ করবে? তুমি শুধু নীল চুড়ি পড়েছো কেন? ভরাট গলায় বলল শুভ। - সাদা চুড়িগুলো পাচ্ছিলাম না। আর আমার আম্মুকে তো জানোই, একটু সাজগোজ করতে দেখলে নানা প্রশ্ন করে। অল্প হেসে হেসে বলে ইতি। তোমাকে আকাশী রঙের এই শার্টে অনেক ভালো লাগছে। কেমন যেন মেঘ মেঘ একটা ভাব আছে এই শার্টে।- কিছুদিন আগে চিটাগাং গিয়েছিলাম একটা প্রোগ্রামে, ওখান থেকেই শার্টটা কেনা। সেখানে একটা গান গেয়ে প্রচুর আনন্দ পেয়েছি। বুঝলে ইতি, গান হচ্ছে একটা সাধনার মত, প্রার্থনার মত। আমাকে কখনো দেখেছো ঈশ্বর বা আল্লাহকে নিয়ে বা ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করতে? নাহ, আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ আমাদের মনে বাস করে। আর মানবিকতায় পূর্ণ মানুষই প্রকৃত মানুষ। গানের মাঝে তুমি পৃথিবীর সব রঙ খুঁজে পাবে, গানের মাঝে তুমি রাগ, দুঃখ,কান্না, ভয়, ভালোবাসার সব অনুভূতি খুঁজে পাবে... তোমার প্রিয় রবি ঠাকুর বলেছিলেন- “ অন্তরে বাহিরে হেরিনু তোমারে লোকে লোকে লোকান্তরে...” অর্থাৎ অন্তরে খুঁজে, বাহিরেও খুঁজি, হাজারো লোকের মাঝে জনবহুল ভীরে কেবলই তোমারেই খুঁজি... শুভ ইতির হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে, আর ইতির হাতের চুড়ি গুনছে...ইতি তন্ময় হয়ে বসে আছে তার মাথায় বার বার ঘুরছে, “অন্তরে বাহিরে হেরিনু তোমারে লোকে লোকে লোকান্তরে...”
রাত ৩ টা। ইতি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। হঠাত করেই ফোনটা বেজে উঠলো... ইতি ধড়মড় করে উঠে ফোন ধরলো। ফোনের ওপাশ থেকে শুভর ভরাট গলার গান ভেসে আসছে-
“তোমায় যতটা জানি
তুমি জলে আগুন জ্বালো
বৃষ্টি খোঁজোনি তুমি,
তাই বৃষ্টি তোমাকে খোঁজে...
প্রতিশোধ নেবে বলে
অভিমানে পুড়ছে নদী
চলনা একটু কাঁদি...
চলনা পালিয়ে বাঁচি...”
ইতি মুঠোফোনটা ভীষণ আবেগ দিয়ে গালে ঠেকিয়ে কানে চেপে ধরে আছে। ভীষণ ভালোবাসার কেউ একজন নির্জন, গভীর, আর ঘুমন্ত একটা রাতে ফোন করে তার প্রেমিকাকে বলছে চলনা একটু কাঁদি... এরচেয়ে অসম্ভব সুন্দর মুহূর্ত কি আর কিছু হতে পারে? এরচেয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর কোন বাস্তব কি হতে পারে? ইতির খুব বলতে ইচ্ছে করছে বৃষ্টি আমাকে খুঁজুক কিংবা না খুঁজুক আমি সবসময় তোমার পাশেই আছি...সব কান্নায় সব আনন্দে সব সময় পাশেই থাকবো...আমরা দুজন সব সময় একসাথে পৃথিবীর সব সুন্দর কিছু দেখবো। একসাথে ফুলের ঘ্রাণ নেবো, তীব্র
জ্যোৎস্না দেখবো, তুমুল ঝরে উত্তাল হওয়া নদী দেখবো, বিষণ্ণ আকাশটাকে আলোকিত করবো...সত্যিই করবো। আমি আমার দেওয়া সব কথা রাখবো...
৪
ইতি মানুষিক ভাবে বেশ এলোমেলো আছে আজকাল। আর মাস কয়েকের মাঝেই গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে যাবে তার। শুভ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ফেলেছে। ওর রেজাল্ট ভালো তাই বেশ কিছু জায়গা থেকে অফার পেয়েছে। খুব দ্রুত কোথাও জয়েন করে ফেলবে। এরমাঝে মা আজকাল আকারে ইঙ্গিতে মাঝে মাঝেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন ইতি যদি কাউকে পছন্দ করে তবে যেন তাঁকে জানায়, বাবা তার ব্যাপার কিছুটা আন্দাজ করতে
পেরেছেন আর উনি ব্যাপারটা পছন্দ করছেন না, তাই ইতির উচিৎ মাকে সব খুলে বলা। নইলে পরিবারে সমস্যা বাড়বে। অথচ গত দু বছরে শুভকে সে যতটুকু চিনেছে ও ভীষণ আবেগপ্রবণ আর স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল এই ছেলেটা কমিটমেন্ট দিতে পছন্দ করেনা। এরমাঝে কিভাবে ইতি সব কিছু সামাল দিবে বুঝতে পারেনা। মেজাজ সারাক্ষণ খিটখিটে হয়ে থাকে তার। বীথির সাথেও ঠিক মত কথা হয়না আজকাল। বীথি শুভর ব্যাপারটা জানে আর কোন এক বিচিত্র কারণে সে শুভকে একদম পছন্দ করেনা। শুভর নাম সে রেখেছে গোবদা মাগুর। আর
সেই গোবদা মাগুরকে ইতি পছন্দ করে বলে ইতির নাম নেকু মাগুর। ইতি বীথির এইসব ছেলেমানুষি দেখে আরও বিরক্ত। কয়েকবার সে বীথিকে শক্ত ধমক দিতেও যেয়েও থেমে গেছে। কারণ তার বোনটা কখনোই ধমক খেয়ে দমে যাবার পাত্রী নয়। তাঁকে ধমক দেওয়া হলে সে দ্বিগুণ উৎসাহে এইসব নামে ডাকাডাকি বাড়িয়ে দিয়ে বাসার পরিবেশকে নরকে পরিণত করে ফেলবে। কয়েকদিনের মাঝে আপ্রাণ চেষ্টা করে ইতি তার মাকে আর শুভকে সামলে ফেলল। সামনের মাসের ৭ তারিখে শুভ আসবে ইতির মায়ের সাথে কথা বলতে। তার কিছুদিন পর শুভ তার পরিবারসহ এসে বাবার সাথে কথা বলবে। ইতি এরমাঝে শুভর সাথে মায়ের কথা বলিয়েছে। মাকে শুভর সাথে কথা বলে সন্তুষ্টই মনে হল। বাগড়া
বাঁধিয়েছে বীথি সে কিছুতেই শুভর সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না। ইতির আশেপাশে থাকলেই সে ছড়া কাটে-
"গোবদা মাগুর, আস্ত বাদুর
নাম শুনলেই আসে ঢেঁকুর”"
ইতি দুহাতে কান চেপে বসে থাকে। এত কুৎসিত ছড়া কিভাবে একটা মানুষকে নিয়ে কেউ লিখতে পারে!!! ৭ তারিখ রাত ৮টা। ইতি ক্রমাগত শুভকে ফোন করে যাচ্ছে, শুভর নাম্বারটি অফ। দুপুরের পর থেকে বাসার সবাই শুভর জন্যে অপেক্ষা করছে। এমনকি ইতিকে অবাক করে দিয়ে মিঃ আহসান আজ সকালে বেশ কিছু বাজার কিনে এনেছেন আর মাকে বলেছেন- ছেলেটা আসবে, ভালোমন্দ কিছু রান্না কোরো। অথচ ইতি শুভকে খুঁজেই পাচ্ছেনা। শুভর ফেসবুক একাউন্টটিও ডিএক্টিভেট করা, ইতির কাছে শুভর পরিচিত আর কারো নাম্বার নেই। ইতির বুকটা ধক ধক করছে, শুভর কিছু হয়নি তো? শুভ আসবে তো? বাড়ির সামনে প্রতিটি গাড়ির শব্দ শুনলেই ইতি ছুটে বারান্দায় যাচ্ছে। মিঃ আহসান ড্রয়িং রুমে থমথমে মুখে বসে আছেন। নিজের এবং তার সন্তানের জন্যে তীব্র অপমানের একটা অনুভূতি হচ্ছে তার। তেতো লাগছে সবকিছু। বিতৃষ্ণা
লাগছে এই পৃথিবীর উপর। একটু পর পর হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যাচ্ছে তার। ইতি রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নিস্তেজ হয়ে বসে থাকলো। তাঁকে দেখে বিধ্বস্ত লাগছে। চোখের অশ্রু পড়ে পড়ে শুকিয়ে গেছে। বীথি কখনোই তার আপাকে এমন অবস্থায় দেখেনি, আপার কষ্ট দেখে তার চোখ বারবার ভিজে আসছে। শুভ যেখানেই থাকুক ফিরে আসুক, তার আপার সুখ তার সাথে হলে হোক। বীথি নিঃশব্দে এসে ইতির কাঁধে হাত রাখল...ইতি তড়িৎ গতিতে সামনে ফিরে তার ছোটবোন জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে থাকলো...বীথি শক্ত করে তার বোনকে ধরে আছে তার মনে হচ্ছে তার
যদি অনেক ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে পৃথিবীর সব আনন্দ এনে তার বোনকে দিয়ে দিতো। তার যদি সামর্থ্য থাকতো তাহলে সে শুভকে খুন করে ফেলে তার বোনকে কষ্ট দেওয়ার প্রতিশোধ নিতো। মিঃ এবং মিসেস আহসান দুবোনের কান্নার দৃশ্য এসে নিঃশব্দে দেখে গেলেন, দুজনেই এমন অভিনয় করলেন যেন তাঁরা কিছুই দেখেননি...
৫
এরপর দেড় বছর কেটে গেছে, মিঃ আহসান ইতির সাথে কখনোই কথা বলেননি। ইতি এখন মাস্টার্স পড়ছে, তার বন্ধু বান্ধব প্রায় নেই বললেই চলে। অবসরের অধিকাংশ সময় তার কাটে মা আর বীথির সাথে গল্প করে, গান শুনে আর মাঝে মাঝে মেজো খালার বাসায় বেড়াতে গিয়ে। শুক্র ও শনিবার সে একটা ইন্সটিটিউশনে IELTS এর ক্লাস নেয়। কাজ ছাড়া পিসির সামনে বসে থাকা বা সাজগোজ করা তার কাছে বিষাক্ত মনে হয়...মাঝে মাঝেই সে ভাবে বেশ তো দিন কেটে যাচ্ছে যাক না।।
শুধু বাবা যদি কখনো তাকে মন থেকে ক্ষমা করে দেন তাহলে জীবনের কাছে তার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই। দিন দশেক পড়ে একদিন বীথি ক্লাস থেকে এসেই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ইতিকে ডাকতে থাকলো। ইতি কিছুটা অবাক হয়ে বীথিকে বলল- ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন? - তিতিপা, তুমি বিশ্বাস করবে না আমি আজকে কি জেনে এসেছি। অহংকারে বীথির নাক যেন কয়েক ইঞ্চি বেড়ে যায়।
- কি জেনেছিস? আবারো কোন বিম্বো টাইপের মেক-আপ কুইনকে পচিয়েছিস নাকি কোন ছেলেকে শায়েস্তা করেছিস?
- আহহা, তিতিপা এমন কিছুই না। কাহিনী শুনো, তোমার মনে আছে আজকে যে আমাদের রুমানার বাসায় ওর জন্মদিন উপলক্ষে দাওয়াত ছিল? আজকেই তো প্রথম ওর বাসায় গেলাম আমরা। ওর ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্ট হাইড করা, ও বাদে কেউ ওর ফ্রেন্ড লিস্ট দেখতে পারেনা। আজকে ওর পিসিতে আমি বসেছিলাম, তখন দেখি ওর ফেসবুক ফ্রেন্ড লিষ্টে শুভ ভাইয়ের ছবি। আমি তো পুরাই শকড! আমি রুমানাকে জিজ্ঞেস
করলাম যে ইনি কে, তারপর জানলাম গোবদা মাগুরটা ওর বড়ভাইয়ের ক্লাসমেট। একসাথে উনারা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা করেছেন। আর আপা, আমি এখন এইটাও জানি উনি কেন সেদিন আমাদের বাসায় আসেননি...
ইতি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। দু হাতের তালু দিয়ে সে চোখ মুছে ধরা গলায় বলল-বাদ দে বীথি। আমি ওর ব্যাপারে কিছুই জানতে চাইনা। খপ করে ইতির হাত ধরলো বীথি- না তোকে শুনতেই হবে আপা, তুই কি জানিস গোবদা মাগুরের আসল নাম কি? শুভজিৎ রায়। বেটা হিন্দু। তোকে দুই বছর ধরে মিথ্যে বলে আসছে যে ওর নাম শুভ হাসান। ও তোর ইমোশন নিয়ে খেলেছে তারপর সুযোগ বুঝে পালিয়েছে। আগামী মাসে এই মাগুর মাছের বিয়ে। এরেঞ্জ ম্যারেজ, রুমানার বাসার সবাইকে দাওয়াতও দিয়েছে। ইতি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে বীথির দিকে। স্তব্ধ কিছু মুহূর্ত, ভীষণ কিছু মুহূর্ত...শুভ তার মাকে আসসালামু আলাইকুম বলেছিল। প্রতি ঈদে নাকি বায়তুল মোকাররমে জামাত ধরে তাও বলেছিল। একটা মানুষ এতটা প্রতারক কিভাবে হয়?
-তিতিপা তোর দুইটা পায়ে পরি এখন কাঁদিস না। ভেবে দেখ তোর এর চেয়ে বড় ক্ষতি হতে পারতো। তুই বেঁচে গেছিস। তুই এই ছেলেটাকে এখন একটা উচিৎ শিক্ষা দে যাতে ও সারাজীবন মনে রাখে।
-না, আমি এই বিষয়ে আর কিছুই শুনতে চাই না। শক্ত গলায় বলে ইতি।
-কি বলছিস? অধৈর্য গলায় চেঁচিয়ে উঠে বীথি, তোর সাথে যা হল আজকে অন্য কোন মেয়ের সাথে তা হতে পারে। ভালো ফ্যামিলির শিক্ষিত একটা ছেলে মানেই যে ভালো মানুষ নয় তা সবাইকে জানতে হবে। আমি এই ছেলের মোবাইল নাম্বার নিয়ে এসেছি। রুমানাকে বলেছি ওর বাসার ঠিকানা ও ফোন নং জোগাড় করতে। ও করে দিবে বলেছে। এই ছেলের বাবা-মা নাকি অনেক ওয়েল স্ট্যান্ডার্ড ব্যাকগ্রাউন্ডের। আমি ভাবছি তুই,আমি, বাবা আর মাকে নিয়ে তার ফ্যামিলিকে সব খুলে বলবো। এবং ওর ফ্যামিলির সামনেই তার সাথে কথা বলবো।
-বীথি আমি এসব কিছুতেই জড়াতে চাইছিনা। বাবা এমনিতেই আমার সাথে গত দেড় বছর কথা বলেন না। আমি উনাকে আর হার্ট করতে চাইনা এইসব কিছু সামনে এনে।
- আপা, তোর মনে আছে ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় বাণিজ্য মেলায় একটা লোক আমার গায়ে হাত দিয়েছিলো বলে তুই তার কলার ধরে কষে তাকে থাপ্পড় দিয়েছিলি? আমি সেদিন থেকে বুঝেছিলাম যে এই শহরে টিকতে হলে আমাদের সবাইকে প্রতি পদে পদে সংগ্রাম করতে হবে। অনেক খারাপ ছেলেও যেমন আছে, তেমনি অনেক খারাপ মেয়েও আছে তাই সংগ্রাম করতে হবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার, এই সংগ্রাম আমাদের
আত্মসম্মানের জন্যে। আর আমি যতদূর আমাদের বাবাকে চিনি, উনি যদি জানেন তুই সব কিছু জেনেও দুর্বলদের মত মুখ লুকিয়ে আছিস উনি আরও কষ্ট পাবেন। তুই এগিয়ে যা দেখবি আমরা সবাই তোর পাশে আছি।
ইতি অদ্ভুত এক বিস্ময় আর ভালোবাসা নিয়ে বীথির দিকে তাকিয়ে আছে। তার ছোট্ট এই বোনটা এত বড় হয়ে গেছে কবে???
পরিশিষ্ট :
শুভজিৎ রায়ের পরিবারের সাথে ইতিদের পরিবারের কথা হয়েছে। শুভকে যথেষ্ট হেয় হতে হয়েছে। শুভ কখনো কল্পনাও করেনি তার অতীতের কোন পাপ তার গোছানো বর্তমানকে এভাবে আঘাত করতে আসতে পারে।
মিঃ আহসান রোজ বিকেলে ইতির হাতের চা পান করেন আর গুট গুট করে তাঁর বড় মেয়ের সাথে গল্প করেন। আনোয়ারুল কাইয়ুম পাটোয়ারী নামের এক অতীব শান্ত শিষ্ট ছেলের সাথে ইতির বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ষ্টুয়ার্ট ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি করছে। বীথি ইতিকে আজকাল মিসেস পাটোয়ারী আপা বলে ডাকে। ইতি একদম ক্ষেপে না বরং একটা লাজুক হাসি দেয়।
প্রতিদিন সকালে ও রাতে ইতি, বীথি আর বাবা-মা মিলে একসাথে খাবার খায়।তাদের হাসি ঠাট্টার এই দৃশ্য দেখলে সবাই বলবে একেই বলে পারফেক্ট ফ্যামিলি।
উৎসর্গঃ- এই গল্পের সবগুলো চরিত্রই কাল্পনিক শুধু আনোয়ারুল কাইয়ুম পাটোয়ারী নামের অতীব শান্ত শিষ্ট ছেলেটি বাস্তব। আমার দেখা অন্যতম সাদামাটা অথচ চমৎকার একজন মানুষ ইনি। আমার জীবনে অভ্র দিয়ে বাংলা লেখার শুরু ইনার কারণেই। অনেক দিন থেকেই ভাবছিলাম একটা গল্প তাঁকে উৎসর্গ করবো। আজ তাই করে দিলাম। ইতির মত স্নিগ্ধ আর সুন্দর কোন মেয়ের সাথে এই পাটোয়ারী ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেছে তা আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে।